বিবিধ

তিনে এক - একে তিন



সমীরণ ভৌমিক


আমাদের চরম সত্যিকারের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য - মন ও মুখ এক করাই হলো প্রকৃত সাধন। মুখে এক বলছি ও মনে (কাজে) আর এক করছি। আমরা ঠাকুর, মা ও স্বামীজীর চরণাশ্রিত। আমরা রামকৃষ্ণ মিশনের, আমরা তামাম দুনিয়াজুড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন পরিবারের দীক্ষিত শিষ্য ও ভক্ত। এটা আমাদের প্রত্যেককে সর্বদাই মনে রাখতে হবে। তামাম দুনিয়ার মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমরা ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণের দীক্ষা নিয়েছি মানে সব হয়ে গেল। দীক্ষা কোন সরকারি স্ট্যাম্প নয়। দীক্ষা হল দক্ষতা । গুরু কথার অর্থ হল - 'গু' মানে অন্ধকার আর 'রু' কথার অর্থ হলো আলো। যিনি অন্ধকার থেকে আমাদের আলোতে নিয়ে আসেন তিনিই গুরু। "গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে ভাবলে বুঝি সব হল। তা নয়, কিন্তু তা তো নয়ই যদি নিষ্ঠা সহকারে না পালন করো।" আমরা পূর্বজন্মের সুকৃতির ফলে ঠাকুর, মা ও স্বামীজীর চরণে আশ্রয় পেয়েছি। আমাদের ঘন্টা নাড়া, ধূপ জ্বালা, তিলক কাটা এগুলো ঠাকুর চাননি। ঠাকুর চেয়েছেন - আমাদের আচার, আচরণ, ব্যবহার, সত্য, সততা, নিষ্ঠা, আনুগত্য, নিয়মানুবর্তিতা, সময় সচেতনতা, আমাদের বিবেক, মন এগুলি হলো ঠাকুর, মা ও স্বামীজীর চরণে উৎসর্গীকৃত পুজো।

ঠাকুর আমাদের গৃহী সন্ন্যাসী বলতেন। আমাদের মনের সন্ন্যাস হোক - দেহের সন্ন্যাস নয়। 'সন্ন্যাস' কথাটির ব্যাকরণগত অর্থ হল সৎ-এ মন ন্যস্ত করার নাম সন্ন্যাস। রাস্তা দিয়ে আমরা চলে গেলে লোকে বলতে পারে, ওই দেখো শ্রী রামকৃষ্ণের সন্তান যাচ্ছেন। স্বামীজি বলেছেন "এসো মানুষ হও"। মানুষ মানে এক তাল মাংস নয়। মানুষ হলো সর্বশক্তিমান ও পবিত্র এক অসীম শক্তি। মানুষ রেখে যাবে তার জীবনের কোনো আদর্শ বা চিহ্ন। ইংরেজিতে যাকে বলছে 'Mark'। আমরা আমাদের রক্তের সঙ্গে, হাড়ে হাড়ে, মজ্জায় মজ্জায় ঠাকুর, মা ও স্বামীজীর উপস্থিতি সর্বদাই অনুভব করতে পারি। স্বামীজি আবার বলছেন, "জীবনে এসেছ যখন একটা দাগ কেটে যাও।" কি দাগ? আগেকার মা - ঠাকুমার নীতি শিক্ষা - যা সুতোর কাজে, কাঠের কাঁচের ফ্রেমের মধ্যে লেখা থাকতো, "এমন জীবন করিবে গঠন - মরণে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন।"

বিশ্বমহামানব স্বামী বিবেকানন্দ আবার বলছেন - "ধর্ম এমন একটি ভাব, যা পশুকে মনুষ্যত্বে ও মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে।" স্বামীজি বলছেন, দিনের শেষে নিজের সঙ্গে নিজেকে পাঁচ মিনিট কথা বলতে ও আত্মবিশ্লেষণ (Self Analysis) করতে। কি আত্মবিশ্লেষণ? আমি কাউকে কষ্ট দিইনি তো? আমার দ্বারা কেউ চোখের জল ও দীর্ঘশ্বাস ফেলেনি তো? আমাকে কেউ কষ্ট দিয়েছে ঠিক আছে, কিন্তু আমার দ্বারা কেউ কষ্ট পায়নি তো? আমি কারো সঙ্গে এতটুকু প্রতারণা করিনি তো? এই 'জীবন জিজ্ঞাসা' তিনি আমাদের কাছে আশা করেছেন এবং নিজেদেরকে আত্মসমালোচনা করতে বলেছেন। দিনের প্রতিটি ঘন্টা, আমাদের প্রতিটি কাজের মধ্যে ঠাকুর, মা ও স্বামীজি আছেন। আমরা ঠাকুর, মা ও স্বামীজীর কাজ করছি। জীবন দিয়েছেন যিনি, আবার মৃত্যুও দেবেন তিনি। এই 'জীবন-মৃত্যু'-র মাঝে যা কিছু কর্মযজ্ঞ তিনি করাচ্ছেন। যা কিছু কাজ আমরা করছি সব ঠাকুরেরই কাজ করছি। আমরা ঠাকুর ও মায়ের কাছে প্রার্থনা করব, "আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেলে ঠাকুর ও মা নিজেরা এসে আমাদেরকে সশরীরে দেখা দেন ও আমাদের কোলে তুলে নেন। আমরা যেন আনন্দে 'জয় ঠাকুর - জয় মা' বলে রামকৃষ্ণলোকে চলে যেতে পারি।"

এমন কোনো কাজ আমরা করব না যাতে "তিনে এক - একে তিন" ঠাকুর, মা ও স্বামীজি কষ্ট পান। আমাদের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি পল, প্রতিটি মুহূর্ত এবং প্রতিটি হার্টবিটে আমরা যেন - ঠাকুর, মা ও স্বামীজির উপস্থিতি অনুভব ও উপলব্ধি করতে পারি। ঠাকুর, মা ও স্বামীজি - ওঁনারা "তিনে এক - একে তিন" প্রতিটি মানুষের হৃদয়জুড়ে 'তুমিময়' হয়ে থাকবেন। ঠাকুর আমাদের তনু মন আত্মসাৎ করে নিয়েছেন, তবেই আমরা ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রকৃত শিষ্য ও ভক্ত হয়ে উঠব।

বাইবেলে যীশু খ্রীষ্ট বলছেন, "আমি সকলের দোরগোড়ায় যাই এবং সবাইকে ডাক দিই। যে আমার ডাক শুনে ভেতরে ডাকেন আমি কেবলই তার কথা শুনি।" ঠিক একই রকম ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব তামাম দুনিয়ার মানুষকে বলছেন, "ঈশ্বর কৃপার বাতাস সদা-সর্বদা বইছে কিন্তু গোটানো পালটা তো আমাদেরই তুলতে হবে। বাদবাকি কাজ বাতাস (শ্রীভগবান) করে নেবেন।" তাই সারা পৃথিবীর রামকৃষ্ণ পরিবারের, রামকৃষ্ণ শিষ্যদের সৎ (Honest) হতে হবে। অদীক্ষিতরা আমাদের দিকে সর্বদাই চেয়ে থাকেন কেননা আমরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চরণাশ্রিত ভক্ত ও শিষ্য। তাই একটি কথা আমাদের স্মরণ, মনন করিয়ে দেয় - "There is no substitute for hard work" - কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। তেমনি "Honesty is the best policy". আবার অন্যদিকে Money is lost, nothing is lost; Health is lost, something is lost; but Character is lost, everything is lost! আমরা যেন জীবনের "ঢেউ সাগরে", যৌবনের উত্তাল "ঢেউ সাগরে" গড্ডালিকা প্রবাহের মতো হারিয়ে না যাই। আমরা ঝড়ের মধ্যে এঁটো পাতার মতো রামকৃষ্ণশ্রোতে হারিয়ে যেতে পারি।

এই মুহূর্তে আমরা 'রাধামোহনপুর শ্রীরামকৃষ্ণ মিলন মন্দির বিদ্যায়তন-এর রজত জয়ন্তী বর্ষের সমাপ্তি দিনের ভক্ত সম্মেলনে স্বামী স্তবপ্রিয়ানন্দজী মহারাজের সমাপ্তি ভাষণের একটি নীতিবাচক, আধ্যাত্মিক শিক্ষামূলক গল্প - জীবশ্রেষ্ঠ মনুষ্যজাতির উপর শেষ বক্তব্যটি আমরা স্মরণ ও মনন করি - এক গুরুদেব তাঁর শিষ্যগনকে একটি নারকেল দু'ভাগ করার জন্য কোনো নির্জন স্থানে গিয়ে নারকেল ভাঙতে নির্দেশ দেন, সেখানে কারো উপস্থিতি যেন না থাকে। একেবারে সম্পূর্ণ নির্জন জায়গায় ও নির্জন স্থানে। কেউ যেন দেখতে না পায়। সব শিষ্য নির্জনস্থানে গিয়ে গুরুদেবের নির্দেশমতো নারকেলটি দু'ভাগ করে এনে গুরুদেবের কাছে উপস্থিত হন কিন্তু একটি শিষ্য কোথাও কোনো নির্জন স্থান এবং এমনকি গুহাতে গিয়েও নারকেলটি দু'ভাগ করতে পারলেন না। শেষে সে গোটা নারকেলটি এনে গুরুদেবের কাছে হাজির হয়। ঐ শিষ্যটি বাদে সব শিষ্যরা গুরুদেবের কাছে হাসাহাসি করল। গুরুদেব উক্ত শিষ্যটিকে প্রশ্ন করলেন, "তুমি কি কোনো নির্জন স্থান পাওনি যাতে করে ওই নারকেলটি দু'ভাগ করতে পার?" শিষ্যটি গুরুদেবকে বললেন, "না গুরুদেব আমি কোথাও কোনো নির্জন স্থানের জায়গা পাইনি। যেখানে আমি নারকেলটি দু'ভাগ করব। আমাকে যেন কেউ একজন দেখছেন। আমি তার চোখকে কি করে ফাঁকি দেব?" এখানে বিবেকের কণ্ঠস্বর হলো ভগবানের কণ্ঠস্বর। তার বিবেকের মধ্যে, হৃদয় মধ্যে, ঈশ্বর 'তুমিময়' হয়ে আছেন। তাই তার দ্বারা নারকেলটি দু'ভাগ করা হয়ে ওঠেনি। গুরুদেব সকলের সামনে ওই শিষ্যটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন ও বললেন, "তোর ঈশ্বরের উপর ষোল আনা অনুভূতি হয়েছে।"

"ভাবছো মিছে চলবে কিসে, ভাববার তুমি কে?
তোমার ভাবনা ভাবছেন যিনি তুমি ভাবো তাঁকে।
"