বিবিধ

গ্রন্থলোক পাঠাগার



সমীরণ ভৌমিক


স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে। বই ঐক্য, বই বাক্য, বই মানিক্য - বই পড়ো এবং নিজেকে গড়ো। সমাজের তিন মেরুদন্ড হলেন শিক্ষক, ডাক্তার এবং উকিল। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হাউর নিবাসী মাননীয় শিক্ষক, বাংলার গর্ব, বাংলা ভাষার গর্ব এবং সর্বোপরি বাংলা সাহিত্যের একজন দিকপাল স্তম্ভ কালিপদ চৌধুরী যিনি এখনো ৯১ বৎসর বয়সেও মা সরস্বতীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে জ্ঞান বিতরণ করে চলেছেন। লেখনীর হাত বন্ধ করেননি। কালিপদ চৌধুরীর বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা প্রসঙ্গ যেটি মাধ্যমিক স্তরের, উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক। বাংলাভাষী ছাত্র-ছাত্রীদের হৃদয়সঙ্গী। শুধুমাত্র বাংলা বললেও ভুল হবে। ত্রিপুরা রাজ্যেও পর্যন্ত ওঁনার রচিত পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য বই বহুল প্রচলিত। কালিপদ চৌধুরী বাংলা অভিধান, বহু স্বরচিত গল্প, ছোটদের গল্প লিখেছেন।

উনি ১৯৬৭ সালের ১১ই জানুয়ারি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হাউর স্টেশন সংলগ্ন ঘোষপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। উক্ত বিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ের ওপর, বাংলা ব্যাকরণের ওপর, বাংলা রচনার ওপর, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর অসম্ভব দাপট, দক্ষতা ও যশের সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। ওঁনার ক্লাসে যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা অধ্যয়ন করেছেন এবং উক্ত বিষয়ে মনোযোগ সহকারে শুনেছেন তারা কখনো ওঁনাকে ভুলতে পারবেন না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওঁনার বোঝানো ছাত্র-ছাত্রীদের মুগ্ধ করত। কালিপদ চৌধুরী (মাস্টার মহাশয়) ইংরাজী ১৯৯৩ সালের ৩১শে ডিসেম্বর উক্ত স্কুল থেকে অবসর নেন। অসম্ভব দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন, অথচ ওঁনার ভিতরে একটা ভালো মনের মানুষ সবসময় বিরাজ করতেন।


শ্রী কালীপদ চৌধুরী

লম্বা, ছিপছিপে, ফর্সা গড়ন এবং সময় সচেতন মাস্টার মহাশয় কালিপদ চৌধুরী জীবনের সবকিছুতে নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলতেন। কালিবাবু 'হাউর সাহিত্য পাঠচক্র'-এর প্রাণপুরুষ এবং ওই পাঠচক্রের সাপ্তাহিক এবং মাসিক বৈঠকের সংখ্যা চার শতাধিক। কালিপদ চৌধুরী ৯১ বছর বয়সেও গল্প, ছোটগল্প, স্কুল সিলেবাসের মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্য পুস্তকের বই লিখে চলেছেন।

উনি বাংলার ৩রা চৈত্র, ১৪১৯ ইংরেজি ২০১৩ সালের ১৭ই মার্চ রবিবার নিজের বাড়ির নিকটে প্রায় ১২০০ স্কোয়ার ফুটের তিনতলা পাকা বাড়ি নির্মাণ করেন এবং যার নাম দেন 'গ্রন্থলোক পাঠাগার'। উক্ত পাঠাগারটি উদ্বোধন করেন প্রাক্তন গ্রন্থগারিক মাননীয় আজাহার উদ্দিন খাঁ মহাশয় (নজরুল গবেষক এবং প্রাবন্ধিক) এবং প্রয়াত প্রখ্যাত কবি ও কথা সাহিত্যিক অনিল ঘড়াই মহাশয়। গ্রন্থাগারটিতে বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ১৬ হাজার পুস্তক বিদ্যমান। এলাকার বিভিন্ন গল্পপিপাসু মানুষ এবং পুস্তক পাঠকের পাঠাগারে প্রবেশের অবাধ স্বাধীনতা। সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত 'গ্রন্থলোক পাঠাগার' সব বয়সের, সবার জন্যে বইয়ের বিশাল ভান্ডার। বসেও পড়া যায়, ঘরেও নেওয়া যায়। উক্ত গ্রন্থাগারের দেখভালের জন্য মাস মাইনেতে দুইজন ব্যক্তি নিযুক্ত আছেন। গ্রন্থাগারটির একতলাটি হলো পুস্তকালয়, দোতলাটি হল পঠন-পাঠন গৃহ এবং সভাকক্ষ, তিন তলাটি হল গবেষণাগৃহ। শ্রী কালিপদ চৌধুরীর বহু কষ্টার্জিত সৃষ্টির ফসল এই 'গ্রন্থলোক পাঠাগার'। এই পাঠাগারটিতে আছে বনৌষধির বই, উপকথা, জেনারেল নলেজ, বিজ্ঞান, ভূগোল, রাজনীতি, রচনাবলী, অভিধান, বিবেকানন্দ সমগ্র, কাব্য আলোচনা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, সাহিত্যের আলোচনা, জীবনী, আধ্যাত্মচিন্তা, উদ্ভিদবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, বিভিন্ন কবিতার বই, লোকসংস্কৃতির বই, জনজাতি, সমাজবিজ্ঞান বই, নাটক, ইতিহাস, প্রবন্ধ, চাষবাস সংক্রান্ত বই, পরিবেশ সংক্রান্ত বই, বিশেষ রচনা সম্ভারের বই, কিশোর গল্প, হাসির গল্প, রূপকথা, মহাপুরুষদের জীবনী, অ্যাডভেঞ্চার বই এবং কিশোর রামায়ণ ও মহাভারত বই, কিশোর নাটক ও নীতিকথা ও বাণী বিদ্যমান। এছাড়াও আছে দর্শন, মনস্তত্ত্ব, প্রদর্শনশালা (জাদুঘর) সংক্রান্ত বইসমূহ। আছে ধাঁধা, ম্যাজিক, লোকশিল্প, শ্লোক, যোগব্যায়াম, স্মৃতিকথা, কুটিরশিল্প, রসসাহিত্য, কীটপতঙ্গ, নেশা/মাদক জনিত সমস্যার বই, খেলাধুলা, কম্পিউটার বই সমূহ, বিভিন্ন পত্রাবলী ও চিঠি, জীবজন্তু, গ্রন্থপঞ্জি, সাময়িক পত্র-পত্রিকা, কল্পবিজ্ঞান, উপন্যাস, জোকস, নৃত্য, চলচ্চিত্র, সংগীত, বিনোদন, পুরাতত্ত্ব, ভুতের গল্প, ছন্দ লেখা, কার্টুন, বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের বই এই পাঠাগারে বিদ্যমান। এই পাঠাগারটিতে আছে একটি অফিস যেখানে তিনটি কম্পিউটার বিদ্যমান। কোথায় কোন বই রাখা আছে ইনডেক্স অনুযায়ী কম্পিউটারে তা লিপিবদ্ধ। পরবর্তী আকর্ষণ এই গ্রন্থাগার থেকে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত গ্রন্থাগারের ওয়েবসাইট সম্পর্ক। ভারতের বাইরে, বিদেশ থেকেও ওয়েবসাইট খুললে কালিবাবুর গ্রন্থলোক পাঠাগারটিতে কি কি বই আছে তা একনজরে দেখা যাবে। আরও ত্রিশ হাজার বই উক্ত পাঠাগারটিতে সংরক্ষিত হবে। অসম্ভব সৃষ্টি, এলাকার গর্ব, বাংলার মানুষের গর্ব, দুই মেদিনীপুর জেলার স্বনামধন্য প্রিয় মাস্টার মহাশয় কালিপদ চৌধুরীর একাগ্রতা, কর্মনিষ্ঠা এবং সৃষ্টিসুখের ফসল এই 'গ্রন্থলোক পাঠাগার'। হাউর, পূর্ব মেদিনীপুরের এক অবিস্মরণীয় বিস্ময়। ভগবানের কাছে আমাদের একান্ত প্রার্থনা এই মহান মাস্টার মহাশয় কালিপদ চৌধুরী মহাশয় মানুষটি দীর্ঘজীবী হন। তাঁর রচনা এবং অমূল্য সংগ্রহ আমাদের আরো বেশি করে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করুক।

"ধর্ম (কর্ম) যখন ফুটবে তোমার নিষ্ঠা, নীতি, ব্যবহারে;
প্রতিষ্ঠাও আসবে তেমনি, পারবে নাকো রুখতে তারে।
"