বিবিধ

কলকাতা ফুটবল নস্টালজিয়া



দেবাশিস সেনগুপ্ত


প্রশ্ন: “দাদা, ও দাদা, পাশ না অনার্স?” উত্তর: “মোহনবাগান।” কারোর মনে আছে এই কথোপকথন? খুলে বলা যাক ঘটনাটা।


সত্যজিৎ রায় পরিচালিত 'জন-অরণ্য' (১৯৭৬) ছবির একটি দৃশ্যে উৎপল দত্ত ও প্রদীপ মুখোপাধ্যায়।

সাতের দশকের কলকাতা ময়দান। মোহনবাগানের লীগ ম্যাচ মোহনবাগান মাঠে শেষ হয়েছে সদ্য। মোহনবাগান জিতেছে ৩-১ গোলে। খেলা শেষে মানুষের ঢল মাঠ থেকে বেরিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে (অন্য ফল হলে অশান্তি অনিবার্য ছিল) বেরিয়ে যাচ্ছে যে যার গন্তব্যের দিকে। মাঠের বাইরে, কিছুটা দূরে একটু উঁচু বেদীতে বসা দুই বেকার বন্ধু।মাঠফেরত একজনকে ঐ দুই বন্ধুর একজন প্রশ্ন করলেন: “দাদা, ও দাদা, পাশ না অনার্স?” উত্তর ভেসে এল: “মোহনবাগান।” বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের 'জন-অরণ্য' ছায়াছবিতে এভাবেই ধরা দিয়েছিল কলকাতা ময়দানের ফুটবল।

গত শতাব্দীর সাতের দশকের কলকাতা ময়দানের ফুটবল। সে যেন নিজেই ছিল একটা বাঙ্ময় চরিত্র। সে ছিল একটা অলৌকিক রূপকথার গল্প, যেটা মুখে মুখে আর লেখায় লেখায় যেন বয়ে চলেছে গত চার দশক ধরে। কলকাতা ময়দানের তিনটে ঘেরা মাঠকেই তখন আমাদের হৃদয় অস্থায়ী বাসস্থান করে নিয়েছিল। জীবনের সফলতা বলতে তখন বিদেশ যাওয়া (পেশাগত তাগিদে বা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে), বড় বড় গাড়ী চড়া (কোথায় তখন?), শপিং মলের বিরাট বিরাট ক্রয়ক্ষমতা (তখনও) ভবিষ্যতের গর্ভে বা ২০০০ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া (বাক্সবাড়ি তখনো দূরকল্পনা) বোঝাত না। বরং ঐ তিনটে ঘেরা মাঠের ফুটবল ম্যাচের একটা টিকিট (৬০ পয়সা বা ১ টাকা ১০ পয়সার টিকিট অথবা সদস্য কার্ড অথবা ডে স্লিপ) কারো হস্তগত হলে তাকেই জীবনে সফল মেনে নিত সেই সময়ের কলকাতা তথা বাংলা। বাস ট্রামের 'বডি' তখন ঢেকে যেত ময়দানমুখী জনতার শরীরে। এভাবেই জীবন হাতে করে ঘেরা মাঠে খেলা দেখতে যেত তখন কলকাতা ফুটবলের আসল স্পনসররা, মানে দর্শক সমর্থকরা।


সাতের দশকে মোহনবাগান মাঠের বাইরে দর্শকদের লাইন।

আজ যুবভারতীতে সরে যাওয়া বড় ম্যাচ তথা কলকাতা ফুটবলে লেগেছে আধুনিকতার রঙ, টিফো, স্মোকের ছোঁয়া। কিন্তু বিগত সাত আর আটের দশকের ময়দানের সেই নষ্টালজিয়া আজও কেউ ভুলতে পারেন নি। আজও স্মৃতির ট্র্যাফিক পুলিস ফুটবল বিধাতা যেন অদৃশ্য সিগনালে দাঁড় করিয়ে রাখেন আমাদের সাত আর আটের দশকে, বেশ কিছুক্ষণের জন্য। জীবনের অর্জন অনেক ভাইরাস যেন দূর করে দেয় ঐ সময়ের নিখাদ ফুটবলের গল্পে ডুব দেওয়া অ্যান্টিভাইরাস। নিমেষে রিফ্রেশ হয়ে যায় জীবনের চলা, পথের সব গ্লানি উড়িয়ে দিয়ে। কারণ তখন কলকাতা ময়দান এমনই ছিল। সোজাসাপটা। সরাসরি। মুখোসহীন।

তখন কলকাতা ময়দানে কলকাতার ফুটবল আবেগ বিকেল চারটের খেলা দেখতে লাইন দিত ভোরে। অন্য খেলাকে দশ গোল দিত। সারারাত জাগিয়ে রাখত। শেষ সম্বল দিয়ে খেলার টিকিট কাটত। শেষ পারানির কড়ি হয়ে ঘুরত স্মৃতির পেনাল্টি বক্সে। শেষ বয়সের জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকত শেষ সম্বল হয়ে। জয়ের পরে তৈরী করত চোখের জল। হারের পরে শেষ করিয়ে দিত টাটকা জীবন। একমাত্র ছেলেকে দাহ করে সরাসরি মাঠে টেনে আনত। মেয়ের বিয়ের বিকেলবেলাতেও নিয়ে যেত মাঠে। হারা খেলা শেষের বহু পরেও কাঁদাত গ্যালারীতে বসে। বিজনেস মিটিং ছেড়ে মাঠে নিয়ে যেত ভিন শহরে। রাত দুটোয় রাস্তা ভরে দিত দলকে স্বাগত জানাতে। আর মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-মহমেডান ছাড়া সবকিছু জুড়ে দিত।

কত গল্প জমে আছে ঐ সময়ের এবং তার কিছুটা পরের, এমনকি তার আগেরও ময়দানী ফুটবল ঘিরে। পরতে পরতে। আবছায়ার মতো সেই গল্পগুলি প্রবাদের মতো ভেসে বেড়ায় এসপ্ল্যানেড থেকে ইডেনের পাশের ক্লাব হয়ে গঙ্গাপারের ক্লাব ছুঁয়ে ফোর্ট উইলিয়ামের পাশের ক্লাব অবধি বিস্তীর্ণ “হাওয়ায় হাওয়ায়”।


* ব্যবহৃত দুটি ছবিই সামাজিক মাধ্যম থেকে নেওয়া।