বিবিধ

রবীন্দ্র-কথা




আমিত্ব

এই যে আমার বাহিরের মানুষটা, জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানকার অতি ক্ষুদ্র এই মানুষটা এ কেবল মাথাটাকে সকলের চেয়ে উঁচুতে তুলে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে চায়। সকলের চেয়ে আমি তফাৎ থাকবো, সকলের চেয়ে আমি বড়ো হব, এতেই তার সকলের চেয়ে সুখ। তার একমাত্র কারণ এই, আপনার মধ্যে তার আপনার স্থিতি নেই। বাইরের বিষয়ের ওপরেই তার স্থিতি। যত জিনিস বাড়ে ততই সে বাড়ে; নিজের মধ্যে সে শুন্য; সেখানে তার কোন সম্পদ নেই এইজন্য বাইরের ধন যত জমে ততই সে ধনী হয়। জিনিসপত্র নিয়েই যাকে বড় হতে হয় সে তো সকলের সঙ্গে মিলতে পারে না। জিনিসপত্র তো জ্ঞান নয়, প্রেম নয়; সকলকে দান করার দ্বারাই তো সে আরও বাড়ে না, ভাগ করার দ্বারাই তো সে আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠেনা। তার থেকে যা যায় তা যায়, সে তো আর দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে না। তার যা আমার তা আমার, যা অন্যের তা অন্যেরই- এইজন্যে যে মানুষটা উপকরণ নিয়েই বড়ো হয় সকলের থেকে তফাৎ হয়েই সে বড়ো হয়। আপনার সম্পদকে সকলের মধ্যে মেলাতে গেলেই তার ক্ষতি হতে থাকে। এইজন্য যতই সে বড় হয় ততই তার আমিটাই উঁচু হয়ে উঠতে থাকে, ততই চারিদিকের সঙ্গে তার যোগ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে এবং তার সমস্ত সুখই অহংকারের রূপ ধারণ করে অন্য সকলকে অবনত করতে চায়। এমনি করে বিশ্বের সঙ্গে বিরোধের দ্বারাই সে যে দুঃসহ তাপের সৃষ্টি করে সেইটিকেই সে আপনার প্রতাপ বলে গণ্য করে।

আমেরিকা ও চীন

যে সাধনায় মানুষ আপনাকে আপনি ষোলআনা ব্যবহার করবার শক্তি পায়, তার কৃপণতা ঘুচে যায়, নিজেকে নিজে কোন অংশে ফাঁকি দেয় না, সে যে মস্ত সাধনা। চীন সুদীর্ঘকাল সেই সাধনায় পূর্ণভাবে কাজ করতে শিখেছে, সেই কাজের মধ্যেই তার নিজের শক্তি উদারভাবে আপনার মুক্তি এবং আনন্দ পাচ্ছে- এ একটি পরিপূর্ণতার ছবি। চীনের এই শক্তি আছে বলেই আমেরিকা চীনকে ভয় করেছে, কাজের উদ্যমে চীনকে সে জিততে পারে না, গায়ের জোরে তাকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়।

আরও

একদিন মানুষ পৃথিবীতে বড় ভয় করেছিল। কে যে প্রসন্ন হলে জীবন সুখে স্বচ্ছন্দে কাটে, কে যে অপ্রসন্ন হলে দুর্যোগ উপস্থিত হয়, তা মানুষ কোনমতেই সেদিন ভেবে পায়নি। যে শক্তির সঙ্গে আত্মার যোগ নেই তাকে প্রসন্ন রাখবার জন্য বলির পশু নিয়ে তখন ভয়াতুর মানুষ একত্র মিলেছে। তখনকার সেই ভয়ের পূজা তো উৎসব নয়। ডাকাতের হাতে পরলে ভীরু বলে ওঠে, 'আমার যা আছে সব দিচ্ছি কিন্তু আমায় প্রাণে মেরো না', তেমনি পৃথিবীর মধ্যে অদৃশ্য শক্তিকে খুশি রাখার জন্য সেদিন মানুষ বলেছিলঃ আমি তোমাকে সব দেবো, তুমি আমায় সংকটে ফেলো না; কিন্তু সে তো আনন্দের দান নয়। আনন্দের দেবতাকে উপলব্ধি করলে আর ভয় নেই। কারণ, এই আনন্দের দেবতাই যে 'আরও', এইতো সকলকে ছাড়িয়ে যায়। যা কিছু পেয়েছি, বুঝেছি, তার চেয়ে তিনি আরও; তিনি ধনের চেয়ে আরও, মানের চেয়ে আরও, আরামের চেয়ে আরও। তাইতো সেই আরো'র পূজায়, আরো'র উৎসবে মানুষ আনন্দে বলেছেঃ আমার ধন নাও, প্রাণ নাও, সম্মান নাও।

সৌজন্যেঃ অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।