গল্প ও অণুগল্প

দ্বিধা



মৌসুমী মৌ (বাংলাদেশ)


একদিন শাড়ি পরে দেখা করতে আসবে?

প্রত্যুত্তরে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো সেঁজুতি। এরপর ধীরে ধীরে জবাব দিলো।

- কবে দেখা করবে?

- তোমার সুবিধা মতো এসো একদিন। আমি তো শুক্র, শনি ফ্রি থাকি। অন্য কোনোদিনও চাইলে ম্যানেজ করতে পারবো।

- আচ্ছা আমি জানাবো।

সেঁজুতির শাড়ি খুব পছন্দ ছিল। মাঝেমধ্যেই হুটহাট শাড়ি পরতো, উপলক্ষ্য লাগতো না। সে কারণে হাতে একটু টাকা জমলেই ওকে শাড়ি দিতো তন্ময়। সেঁজুতিও প্রচণ্ড খুশি হয়ে যেত। বরাবর সেঁজুতির পছন্দমতোই শাড়ি কিনতো তন্ময়। কিন্তু সেবার...

"তাই সে এখানকার ক্লান্ত মানবীয় পরিবেশ
সুস্থ ক’রে নিতে চায় পরিচ্ছন্ন মানুষের মতো,
সব ভবিতব্যতার অন্ধকারে দেশ
মিশে গেলে; জীবনকে সকলের তরে ভালো ক’রে
পেতে হ’লে এই অবসন্ন ম্লান পৃথিবীর মতো
অম্লান, অক্লান্ত হ’য়ে বেঁচে থাকা চাই।"

- বুঝলে, অম্লান, অক্লান্ত হয়ে বেঁচে থাকা চাই, বলে তন্ময় আলতো করে সেঁজুতির হাতের উপর হাত রাখলো।

এসে পর্যন্ত সেঁজুতি চুপ করে আছে। এমনিতে এত চুপচাপ থাকার মেয়ে ও না। নিশ্চয় কিছু ঘটেছে, কী যে সেটাও আঁচ করতে পারছে না। এদিকে এবার একটা দুঃসাহসের কাজ করেছে তন্ময়, সেটা এখনো বলতে পারেনি। তন্ময়ের জলপাই রং খুব পছন্দের, কিন্তু সেঁজুতি সবসময় বলতো জলপাই না-কি বিষাদের রং। তবুও সেবার তন্ময় একটা জলপাই রঙের শাড়ি কিনেছে। ওর খুব ইচ্ছে প্রিয় মানুষটাকে পছন্দের রঙে দেখা। প্যাকেটটা পাশেই আছে। সেঁজুতির চোখ এড়িয়েছে এমনটা বলতে পারে না। কিন্তু ও কিছু বলছেও না। একটু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে তন্ময় বলল, এটা কার কবিতা জানো?

- না, জানিনা।

- জানো। বাংলা সাহিত্যে একজনই এমন কবিতা লিখতে পারে।

ম্লান হেসে জবাব দিয়েছিল সেঁজুতি, জীবনানন্দ দাশ।

- এই তো। দ্যা গ্রেট, জীবনানন্দ দাশ।

- কিন্তু মানুষ অম্লান, অক্লান্ত হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না তন্ময়।

- ওই যে জীবনকে সকলের তরে ভালো করে পেতে হলে তোমাকে অম্লান, অক্লান্ত হয়ে বেঁচে থাকতেই হবে।

- আমার দরকার নেই ভালো করে পাওয়া।

তারপর দুজনে যেন হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল। সন্ধ্যার মতো নীরবতা নেমে এসেছিল টুপ করে। সেই নীরবতা থেকে ক্ষীণস্বরে ভেসে এসেছিল, 'কাল আমার বিয়ে হয়ে গেছে, তন্ময়।'

খুব সন্তর্পণে শুধু হাতটা সরিয়ে নিয়েছিল তন্ময়। যেন কারো হাতই টের না পায় যে এ হাত ও হাতকে একবার স্পর্শ করেছে।

তন্ময়ের সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছিল, ও আসলে কী বললো সেটা ভেবে। তন্ময় কিছু জিজ্ঞাসা করার মতোও শক্তি সঞ্চয় করতে পারছে না। অনেকক্ষণ পর আবার সেঁজুতিই বললো, আমি পারবো না তন্ময়, বলে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।

তবুও তন্ময় চুপ।

- কিছু বলো।

- না পারার কী আছে? বিয়ে যখন হয়েই গেছে...

চোখ তুলে তাকিয়েছিল সেঁজুতি।

আর কিছু বলতে পারলো না তন্ময়। সেদিন দুজনের মাঝে আর কোনো কথা হয়নি। টালমাটাল পায়ে উঠে চলে গিয়েছিল। শাড়িটা ওভাবেই পড়ে ছিল।

তারপর আর কেউ কারো খোঁজ রাখেনি বহুবছর। দুজনের মাঝেই অভিমানের বেঁড়া এত তীব্র হয়েছিল যে কেউ তা ডিঙোতে পারেনি। কিন্তু সেবার হুট করেই দেখা হয়ে গেল নির্বাচিততে। এক মুহূর্তের জন্য চোখ ফেরাতে পারেনি তন্ময়। এত ম্লান, বিমর্ষ সেঁজুতিকে কখনো দেখেনি ও। চিনতেও যেন কষ্ট হয়। এগিয়ে গিয়ে কথা বলেছিল, কিছু শোনার সাহস করে উঠতে পারেনি। শুধু নাম্বারটা নিয়ে এসেছিল।

সেঁজুতি সংসারটা টিকিয়ে রাখতে পারেনি, খুব নির্বিকারভাবে বলেছিল। মানুষটাকে কোনোভাবেই ভালোবাসতে পারেনি। বাড়ি থেকে সেদিন জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। কিছু বলা বা করার সুযোগ পায়নি। তাই পরদিনই ছুটে গিয়েছিল তন্ময়ের কাছে। কিন্তু তন্ময় ওভাবে মুখ ফিরিয়ে নেবে কল্পনাও করেনি। একবার জানতেও চাইলো না কীভাবে কী হয়েছে। ওর অমন নির্বিকার থাকা অপমানের মতো মনে হয়েছিল।

এই একই গ্লানিবোধ নিয়ে তন্ময়ও কুঁড়ে কুঁড়ে মরছে এতটা বছর, সেদিন কেন ওভাবে কথাটা বলতে গেল। কেন কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। কেন ওভাবে চলে এসেছিল। এর জবাব মেলে না ওর কাছেও।

এরপর থেকেই টুকটাক কথা হয় দুজনের মাঝে। এরইমধ্যে তন্ময় দেখা করতে বললো...

অনেক বছর আগে এখানেই শেষ দেখা করেছিল ওরা। সেঁজুতি জলপাই রঙের একটা শাড়ি পরে এসেছে। কী চমৎকার দেখাচ্ছে মেয়েটাকে, এটা কি ওর বিষণ্ণতার জন্য? যেন শাড়িটা ওর জন্যই! তবে কি সেঁজুতি ঠিকই বলতো, জলপাই বিষাদের রং!

এটা কি সেই শাড়িটা? তন্ময়ের ঠিকঠাক মনে পড়ে না।

বসো, বলেই কথা হারিয়েছে তন্ময়।

আজ আবার তন্ময়ের ইচ্ছে করছে সেঁজুতির হাত ধরতে। শক্ত করে কিছুক্ষণ ওর হাতটা ধরে রাখতে পারলে একটু শান্তি পেতো বোধহয়। কিন্তু তন্ময় সে অধিকারবোধ খুইয়েছে অনেক আগেই।

এসে পর্যন্ত সেঁজুতি একটা কথাও বলেনি। ও কি একটু আনকমফোর্টেবল ফিল করছে! শেষমেশ সেঁজুতি কথা শুরু করলো। এক দু প্রশ্নের পর বলল,

- বিয়ে করেছো?

- না।

- কেন?

- "কেউ ভালবাসি বলে যদি স্পর্শ করে বসে ফের!
ফলে আমি যদি ফের হলুদ কুটুম পাখি হয়ে যাই!
আমি যদি ফের মানুষ হওয়ার কথা পুরো ভুলে যাই!
আমাকে যদি ফের বহুকাল জংলায়
গাছে গাছে
কাটাতে হয়!" এই ভয়ে।

- আমাকে ক্ষমা করবে সেঁজুতি?

সেঁজুতির চোখে জল চিকচিক করছে।