প্রবন্ধ

তুমি কৈকেয়ী [পুস্তক আলোচনা] (দশম পর্ব)



কাকলী দেব


।। ১০ ।।

আরও কয়েক বছর কেটে গেল। চারজন রাজপুত্রই এখন সুপুরুষ তরুণ। রাম সবচেয়ে সুন্দর, চেহারা এবং চরিত্রে।

রাজা তোমাকে নিজের 'বিশেষ সচিব' হিসেবে ঘোষনা করেছেন রাজসভায়। তাতে কৌশল্যা আর সুমিত্রাও খুশী। মহিলা পরিষদের কাজকর্মও ভালই চলছে।

রাজা, তোমার কাছে নিজের বিশেষ ইচ্ছার কথা প্রকাশ করছেন। তিনি চান তার পরে রামই অযোধ্যার রাজা হোক। প্রথম যখন শুনলে, রাজাকে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করলে, বিবাহকালীন করা তার প্রতিজ্ঞার কথা। এই শর্তেই তখন তুমি দশরথের তৃতীয় রাণী হতে রাজী হয়েছিলে, যে তোমার পুত্রসন্তান হলে সেই হবে দেশের রাজা।

কিন্ত এখন তুমি এই মানুষটাকে ভালবাস, তাই সেই প্রতিজ্ঞা মনে করিয়ে দিলেও, রাজার ইচ্ছাকে মান্যতা দিয়েছ শেষে। রাজার প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ থাকা সত্বেও মেনে নিয়েছ। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই তেজস্বনী কৈকেয়ী এখন অনেক নরম সরম। আর তাছাড়া জীবন সম্পর্কে নতুন ভাবে ভাবতে শিখেছ, বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। ভরত আর রামের মধ্যে কোনও পার্থক্যই নেই যখন, তখন কি বা আসে যায়, কে রাজা হল বা না হল, তাই নিয়ে।

বিশ্বামিত্র মুনির খুব নামডাক চারিদিকে। এই সময়ের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ঋষি। ঋগবেদের রচয়িতা, তিনি হঠাৎই একদিন অযোধ্যায় হাজির হলেন। রাম আর লক্ষণের নাম ছড়িয়েছে চারিদিকে, দুর্ধর্ষ ধনুর্ধর বীর হিসেবে! বিশ্বামিত্র মুনির আশ্রম যেখানে, সেখানে অনেক রাক্ষসের উৎপাত হচ্ছে। তাই রাজা দশরথের কাছে তার এই দুই ছেলেকে চাইতে এসেছেন যাতে তার সঙ্গে অরণ্যে গিয়ে রাক্ষসদের বধ করে আশ্রম গুলিকে সুরক্ষা দিতে পারে। বিশ্বামিত্র ভীষণ বদরাগী হিসেবে পরিচিত, তাই তাকে চটানোর সাহস হল না দশরথের। কিন্ত, তোমাদের, মানে মায়েদের বুক কেঁপে উঠল, এইটুকু টুকু ছেলে তাদের, যতই বড় বীর হোক, কেমন করে এত রাক্ষসের সঙ্গে মোকাবিলা করবে? মাত্রই তো সতেরো বছর বয়স! কিন্ত রাজার আদেশ, মানতেই হবে!

বিশ্বামিত্র মুনি ওদের দুজনকে নিয়ে চলে গেলেন। তারপর নানা দিক থেকে নানারকম খবর আসতে লাগল, রামের বীরত্বের কাহিনী মুখে মুখে ফিরতে লাগল! ওরা নাকি যত রাক্ষস ছিল(তাদের নাম ছিল তারকা, মারীচ, সুবাহু) সবাইকে হত্যা করে, আশ্রম গুলিকে বিপদমুক্ত করেছে! দেশে, বিদেশে এই তরুণ বালকদের সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল!

এই সময়, কাছাকাছি একটি রাজ্যের নাম মিথিলা, সেখানকার রাজা জনকের মেয়ে সীতার সয়ম্বর সভা হবে! বিশ্বামিত্র মুনি দূত মারফত খবর পাঠালেন যে, তিনি ফেরার পথে ছেলেদের নিয়ে জনক রাজার সভায় যাবেন। এমন খবরও পাওয়া গেল যে বিশ্বামিত্র মুনি ছেলেদের নিয়ে, গৌতম মুনির আশ্রমেও গেছিলেন, সেখানে তারই অভিশাপে পাথর হয়ে যাওয়া স্ত্রী অহল্যাকে রাম তার দৈব ক্ষমতায় নাকি পুনরায় মানুষ করেছে। ইত্যাকার খবরে তোমরা যারপরনাই চমৎকৃত হতে থাকলে। জনক রাজার সঙ্গে আগে থেকেই দশরথের বন্ধুত্ব ছিল। তাই এহেন সভায় রাম লক্ষণের যাওয়ার সুযোগ হওয়াতে তিনি বেশ খুশিই হলেন।

সেখানে শিবের আরাধনা করে পাওয়া 'হরধনু' ভঙ্গ করার শর্ত রাখা হয়েছিল। যে রাজপুত্র বা রাজা এই কাজ করতে সমর্থ হবে, তার সঙ্গেই সীতার বিবাহ হবে।

জনক রাজার পালিতা কন্যা সুন্দরী, সুশীলা সীতা! জনক রাজার নিজের মেয়ে উর্মিলা এবং রাজার ভাই, রাজা কুশধ্বজের দুই কন্যা, শ্রুতকীর্তি আর মান্ডবীও সয়ম্বর সভায় বসবে! স্বামী নির্বাচনের অধিকার প্রত্যেকেই পাবে।

দশরথ তোমাদের সবাইকে নিয়ে রাজা জনকের সাদর আমন্ত্রনে মিথিলা যাত্রা করল। রাম সবাইকে অতিক্রম করে অবলীলায় সেই হরধনু ভাঙল। আর সর্বগুনান্বিতা, সুহাসিনী সীতা, রামের গলায় বরমাল্য পরিয়ে দিল, কী অপূর্ব দীপ্তিময় দেখতে লাগছিল একসঙ্গে দুজনকে। এরপর একে একে লক্ষণ বিবাহ করল উর্মিলাকে, ভরত, মান্ডবীকে, শত্রুঘ্ন শ্রুতকীর্তিকে।

তোমরা মহাধুমধাম করে শূণ্য মিথিলা নগরীকে পেছনে ফেলে অযোধ্যায় ফিরে এলে। চারজন তরুনীকে পুত্রবধু হিসেবে পেয়ে, তোমাদের সবারই মন ভরে উঠল আনন্দে!

রাম এখন প্রায়ই রাজসভায় গিয়ে বসছে, তার বালিকা বধূ সীতার অনুযোগ থাকে যে, রাম তার সঙ্গে কেন আরও সময় কাটাচ্ছে না? কিন্ত ইদানীং রামের কাছে সবচেয়ে জরুরী কাজ হয়েছে প্রজাকুলকে দর্শন দেওয়া, তাদের খুশী রাখা, তাদের সঙ্গেই বেশী সময় অতিবাহিত করা। তোমার চোখে পড়ছে তরুনী সীতা প্রেমের অভিলাষ নিয়ে একলা দিন কাটাচ্ছে!

তুমি ক'দিন ধরে লক্ষ্য করছো, দশরথকে যেন কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে! রাজাতো তোমাকে নিজের সব কথাই বলে, কিচ্ছু লুকোয়না! তাহলে হঠাৎ কি এমন হল, রাজা যেন তোমাকে একটু এড়িয়ে চলতে চাইছে। তুমি আড়চোখে দেখছ, দশরথের মুখে যেন চিন্তার রেখা!

এই সময় তোমার পিতা মৃত্যুপথযাত্রী অশ্বপতি নাকি তোমাকে একবার শেষ দেখা দেখতে চান, এই কথা জানিয়ে যুধাজিতের পত্র এল রাজা দশরথের কাছে। তুমিও ভরতকে সঙ্গে নিয়ে পরদিনই রওনা দিলে। যাওয়ার পথ কিছুটা দীর্ঘ, পৌঁছানোর সাথে সাথেই পিতার কক্ষে গেলে। করুণায় ভরে গেল মনটা! এই কি সেই দোর্দন্ডপ্রতাপ পিতা যাকে তুমি চিরকাল অপছন্দ করেছ!

পিতা কাছে ডেকে আশীর্বাদ করলেন, বললেন, "আমি তোমাদের সবার কাছে দোষী, নিজের অহংকারের বশবর্তী হয়ে তোমাদের মার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলাম, আমাকে তোমরা ক্ষমা কোরো!" যতক্ষণ না পিতার শেষ নিঃশ্বাস পড়ে তোমরা সবাই তাকে ঘিরে থাকলে, তোমার চোখ জলে ভেসে যেতে লাগল!

সব শেষকৃত্য হয়ে গেলে, যুধাজিত তোমাকে ডাকল, "আমি চর মারফত খবর পেয়েছি রামকে রাজ সিংহাসনে বসানোর আয়োজন চলছে অযোধ্যায়! তবে এর পরিণাম ভাল হবে না। পিতা এই সান্ত্বনা নিয়ে গেছেন যে, অযোধ্যার সিংহাসনে বসবে কেকয়ার রক্ত বহনকারী ভরত। দশরথ নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারেন না, তুমি তাকে বোঝাও! দরকার হলে, আমার সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত আছে, আমি যাব।"

প্রাণপণে যুধাজিতকে বোঝানোর চেষ্টা করলে, "আমার কথা শোনো, যে কৈকেয়ী নিজের বিবাহে এই শর্ত রেখেছিল, সে আর নেই, আমরা সবাই এখন প্রাপ্ত বয়স্ক, অনেক বড় হিতের জন্য নিজের ক্ষুদ্র ইচ্ছাকে বিসর্জন দিতে আমি শিখে গেছি, আশা করি তুমিও তা শিখেছ! রাম আর ভরত দুজনকেই আমি নিজের সন্তান মনে করি, তাই রামের রাজ্যাভিষেকে আমি একই রকম খুশী হব!" কিন্ত না, জীবনে প্রথম এবং শেষবার যুধাজিতের সঙ্গে তর্কে পরাস্ত হলে। তাড়াতাড়ি ফিরতে চাইলে অযোধ্যায়, এই হানাহানি, রক্তক্ষরন আটকাতেই হবে তোমাকে।

অযোধ্যায় ফিরে এসে প্রথমে রামের সঙ্গে দেখা করলে, রাজসিংহাসনে আরোহন করার ব্যাপারে বিশদে আলোচনা করতে চাইলে, বললে, "রাম, আমার মনে হয় তোমার আরও প্রস্তুতির দরকার আছে, তোমার বাবার কাছে শিক্ষা তোমার এখনও সমাপ্ত হয়নি! আর তাছাড়া তিনি এখনও শরীরে, মনে এতটাই সুস্থ যে আরও অনেক বছর সিংহাসনে বসে রাজত্ব করতে সক্ষম!" রাম কিন্ত এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখালো না। সে রাজ কর্তব্যের প্রথম ধাপ হিসেবে অসুর আর রাক্ষসদের বধ করতে বদ্ধপরিকর! কেউ বা কারা তাকে এই ভুল ধারণার বশবর্তী করে তুলেছে যে, অসুররা নাকি কোশল রাজ্যের দখল নিতে চায়, আর রামের মধ্যে যে দেবত্ব আছে তাই দিয়েই একমাত্র এটা প্রতিহত করা সম্ভব! নব বিবাহিত এই তরুণ, কুমারকে, অন্য ছেলেদের সঙ্গে তুমি নিজে হাতে গড়েছ! তুমি ওর চিন্তাকে ছুঁতে পার তাই! তুমি বুঝতে পারছ, ও ভাল নেই, ওর বিশ্রাম দরকার! ওর জীবনে অনেক ঘটনা এক সাথে ঘটে যাওয়াতে ও বিধ্বস্ত, রাম বুঝতে পারছে না, কাকে ও জীবনে প্রাধান্য দেবে? ওর ব্যাক্তিগত জীবনকে নাকি তথাকথিত রাজ কর্তব্যকে!

মন্থরা এবং আশার কাছে জানতে পারলে আর দুদিন পরেই হবে রামের রাজ্যাভিষেক । তার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয়ে গেছে।

(ক্রমশ)

গ্রন্থের নামঃ কৈকেয়ী (Kaikeyi: A Novel)
লেখিকাঃ বৈষ্ণবী প্যাটেল (Vaishnavi Patel)
ভাষাঃ ইংরাজী
প্রকাশকঃ রেডহুক (Redhook)
বাঁধাইঃ পেপারব্যাক
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫১২ পাতা
মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয় মুদ্রায়): ১,৭৩৪ টাকা