৯ আগস্ট একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৪২ সালে ইংরেজের বিরুদ্ধে 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলন শুরু হয়েছিল এইদিন ভোর থেকে। আর, ২০২৪-এর ৯ আগস্ট স্বাধীন ভারতের সরকারি হাসপাতালে খোদ কলকাতায় কর্মরতা অবস্থায় রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হল এক ডাক্তার মেয়ের। মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা তার ঘরে, পাঠকেন্দ্রে এবং কর্মক্ষেত্রে। মেধাবী স্বপ্নদর্শী ডাক্তার মেয়েটি একদল সহপাঠী তথা সহকর্মী ছাত্র ও শিক্ষকের চক্রান্তের যোগসাজশে নারকীয় নজিরবিহীন খুন ও ধর্ষণের শিকার হলেন (আইনের প্রমাণ সাপেক্ষে)।
তার আগে এবং তার পরেও খোদ পশ্চিমবঙ্গে ও ভারতে অনেকগুলো শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। 'ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো'র রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২২ সালের তথ্য বলছে, ভারতে প্রতি ১৬ মিনিটে একটি করে ধর্ষণ ঘটে যাচ্ছে পথেঘাটে, ধানক্ষেতে, জঙ্গলে, হোটেলে এবং ঘরে। এ তো গেল নথিভুক্ত পরিসংখ্যান, যা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। এর বাইরেও কত যে ধর্ষণ ও যৌন আক্রমণ সংঘটিত হচ্ছে তা ভাবলেও ভয়ে মন শিউরে ওঠে।
ধর্ষণ কি হঠাৎ আকাশ থেকে পড়া একটি ঘটনা? এই প্রেক্ষিতেই ধর্ষণের মতো ঘটনার পেছনে কাজ করা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলোর দিকে আলো ফেলার চেষ্টা করা যাক।
প্রথমত ধর্ষণ কাকে বলব? সংবিধানের ৩৭৫ ও ৩৭৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী যদি কোনও পুরুষ কোনও মহিলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, অনুমতি না নিয়ে, ভয় দেখিয়ে বা বল প্রয়োগ করে অথবা প্রতারণা করে যৌন সঙ্গম করে তাকে ধর্ষণ বলা হয়। ২০১৩ সালে ৩৭৫-এর সাথে ৩৭৫ এ বি সি ডি ধারা যুক্ত করে ধর্ষণের বিষয়টিকে আরও স্বচ্ছ ও বিস্তৃত করে তোলা হয়। এই বিস্তৃত ধারণায় লিঙ্গ যোনিপথে অনুপ্রবেশ ছাড়াও নানা উপায়ে বলাৎকারও ধর্ষণের আওতায় এসেছে। "ধর্ষণ কোনো মানসিক অসুস্থতা নয়, ধর্ষণ একটি অপরাধ" (ডায়গনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকাল ম্যানুয়াল)।
ধর্ষকামী মানসিকতা (Rapist Mentality)
ধর্ষণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ধর্ষকামী মানসিকতা। ধর্ষকাম ব্যক্তিত্বের এমন একটা বৈশিষ্ট্য যা অন্যের যন্ত্রণায় আনন্দ পায়। হতে পারে, অন্যকে কষ্ট পেতে দেখে আনন্দ পাচ্ছে অথবা নিজে অন্যের সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করছে যাতে সেই মানুষটি কষ্ট পায়। অন্যকে দুঃখ দেওয়া, নির্যাতন করা, বাক্য জ্বালায় জর্জরিত করা, অপরকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, মস্করা, ইয়ার্কির ছলে মনোবেদনা দেওয়া (bullying), ভার্চুয়াল দুনিয়ার আড়াল নিয়ে নানা কটূক্তি, প্রকাশ্যে দাদাগিরি, ক্ষমতা দেখানো ও তার অপপ্রয়োগ থেকে শুরু করে ধর্ষণ, খুন পর্যন্ত সবকিছুই - যা অন্যকে শারীরিক, মানসিক, আবেগগত ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে তা-ই হল ধর্ষকামী মানসিকতা। এর মূলকথা, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্বিক বৈশিষ্ট্য
এই ধর্ষকামী মানসিকতার একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যে সবসময় উন্মুক্ত হয়, তা নয়। কোন পরিবেশে বা সমাজে কোন ধরনের আচরণ কতটা স্বীকৃত তার ওপর নির্ভর করে নির্যাতনের প্রকাশ কী রকম বা কতটা হবে। তবে অনেক মানুষের মধ্যেই কোনও না কোনও মাত্রায় অপরের কষ্ট আঘাতের ঘটনায় খুশিভাব অনুভব করার অভিজ্ঞতা হয়। পুরুষ-নারী উভয়ের মধ্যেই এটা দেখতে পাওয়া যায়। বড়রা ছোটদের ওপর, ঊর্ধ্বতন অধস্তনের ওপর, ক্ষমতাশীল ক্ষমতাহীনের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে।
যে সমাজ সহযোগিতার বদলে প্রতিযোগিতার দাঁত-নখ বের করে একে অন্যের মুখোমুখি দাঁড়ায়, যে সমাজে সরকারি চাকরিতে ৬ জন পিয়ন নেওয়ার বিজ্ঞপ্তিতে ৩৮ হাজার ইঞ্জিনিয়ার দরখাস্ত করে, যে সমাজে এমএ-এমএসসি করে ১২ ঘন্টার ডেটা এন্ট্রি করে যেতে হয়, যে সমাজে টার্গেট পূরণ করলে আরও টার্গেট বাড়ে, পূরণ করতে না পারলে চাকরি চলে যায় - সেই মনো-সামাজিক সংঘর্ষের পরিসর ধর্ষকামী মানসিকতা প্রকাশের রাস্তা উন্মুক্ত করে দেয়।
ফলে, ধর্ষণ ও ধর্ষকামী মানসিকতার পেছনে যে মনস্তত্ত্ব কাজ করে তা ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের কল্পনা থেকে উদ্ভূত। দুনিয়াজুড়ে দেখা যাচ্ছে প্রধানত পুরুষের দ্বারা নারীকে নির্যাতন আজও একটি জ্বলন্ত সমস্যা। এই নির্যাতন বা ধর্ষকামিতার প্রকাশ ঘটানোর রসদ বা সুযোগ কোথা থেকে পায় তারা? পায় আমাদের সমাজ-মানস থেকেই। নারীকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে দেখার মন এখনও তৈরি হয়নি। লিঙ্গবৈষম্যের ধারণা শুধু নিরক্ষর অসচেতন মানুষের ধারণা নয়, তথাকথিত শিক্ষিত ডিগ্রিধারী মানুষও নারী ও পুরুষকে আলাদা দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে বিচার করে। পুরুষের পক্ষে যা যা শোভা পায়, নারীর তা পায় না। প্রায় তিন হাজার বছর আগে মনুর বাণী আজও আমাদের মস্তিষ্কের গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে। "নারী শৈশবে বাবার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমহর্তি।" অর্থাৎ গোটা পৃথিবীজুড়ে যে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমরা বহন করে চলেছি তার কেন্দ্রে ছিল প্রগাঢ় নারী-অবমাননা।
ধর্ষণ সংস্কৃতি (Rape Culture)
১৯৭০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদী লেখিকা নরীন কননেল ও কাসানড্রা উইলসন সম্পাদিত 'রেপ - দি ফার্স্ট সোর্সবুক ফর উইমেন' বইতে এই অভিধাটি প্রথম ব্যবহৃত হয়।
'ধর্ষণ সংস্কৃতি' একগুচ্ছ জটিল বিশ্বাস ও মনোভাবের সমাহার। এই বিশ্বাস নারীর বিরুদ্ধে যৌন হিংসাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মনে করে এবং তাকে নিঃশর্ত সমর্থন যোগায়। যেমন,
১. যৌন নির্যাতনে নির্যাতিতাকেই দোষারোপ করা (Victim Blaming)
২. যৌন হিংসা পুরুষের পক্ষে স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করা
৩. পুরুষের যৌন আক্রমণাত্মক ব্যবহারকে উৎসাহ দেওয়া (মেয়েটা খুব বেড়েছে, রেপ করে দে...)
৪. নারী শরীরকে ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখা
৫. যৌন হিংসাকে মহিমান্বিত করা
৬. নারীবিদ্বেষী ভাষা ব্যবহার করা
৭. লিঙ্গবৈষম্যের ভূমিকাকেই সিলমোহর দেওয়া
৮. উগ্র পৌরুষ (Hypermasculinity)
শিকারকে (মূলত নারী) দোষারোপ করা (Victim Blaming)
এখানে ভিক্টিম ব্লেমিং বিষয়টি একটু খুলে বলছি। কোনো অন্যায়ের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগী মেয়েটির উপরেই দোষারোপ করে মূল অপরাধীর অপরাধ হালকা করাকে বলা হয় ভিক্টিম ব্লেমিং। যেমন, তোর সঙ্গেই কেন হল, কেন রাত করে বাড়ি ফিরিস, কেন ওড়না নিসনি, কেন লিপস্টিক পরেছিস, রাস্তায় এত হাসিস কেন, ছোট জামা, কাঁধ খোলা জামা কেন পরিস - তাই তো লোকে সুযোগ পায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এই নির্যাতিতাকে দোষারোপ বা 'Victim Blaming' অভিধাটি ১৯৭১ সালে প্রথম ব্যবহার করেন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম র্যান। দোষারোপের বোঝা অপরাধীর বদলে নির্যাতিতার কাঁধে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে চাপিয়ে দেওয়াকেই তিনি 'ভিক্টিম ব্লেমিং' হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। অর্থাৎ নিজের দোষেই তারা ভুগছে। যারা নির্যাতিতাকে দোষারোপ করে তাদের বিশ্বাস, একটু চেষ্টা করলেই সে এই খারাপ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। একটু নিজের দিকে খেয়াল রাখলে এমন ঘটনা এড়ানো যেত।
আমাদের সমাজ-মন শুধু নির্যাতিতার দিকে আঙুল তুলছে না, নির্যাতিতা নিজেও নিজের দিকে আঙুল তুলছে। "হয়ত আমারই দোষ, আমিই বাজে, সস্তা..." - একে বলে 'আত্ম-দোষারোপ' (Self Blaming)। এই সেল্ফ ব্লেমিং ধর্ষণ সংস্কৃতিরই অংশ। মনোসামাজিক সত্তার ভিতরে সহস্র বছরের জমে থাকা সংস্কার।
আমাদের চারপাশে একটু নজর করলেই ধর্ষণ সংস্কৃতির রমরমা দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিদিন মিমের মধ্যে, জোকস্-এ, মস্করায়, টিভির অনুষ্ঠানে, গানের ভাষায়, বিজ্ঞাপনে, ফেসবুকে, আইনি ভাষায় - আমরা নানাভাবে এই ধর্ষণ সংস্কৃতিকে সুড়সুড়ি দিতে দেখি। অর্থাৎ, "যখন সমাজ যৌন-হিংসাকে স্বাভাবিক কাজ হিসেবে মেনে নেয়, তখনই তা ধর্ষণ সংস্কৃতির জন্ম দেয়। এখানে হিংসা ও যৌনতা হাত ধরাধরি করে চলে। মেয়েরা সবসময়ে একটা হিংসার আবহাওয়া টের পায়। সে, যৌনগন্ধী মন্তব্য থেকে শুরু করে শরীরে অবাঞ্ছিত স্পর্শ, এমনকি ধর্ষণ পর্যন্ত হতে পারে। ছেলেমেয়ে উভয়ই মনে করে যে যৌন-হিংসা জীবনের একটি বাস্তব সত্য, অবশ্যম্ভাবী... তবুও, যেটাকে আমরা অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নিচ্ছি, তা আসলে বিশেষ মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। এবং এই মূল্যবোধ পরিবর্তন করা যেতে পারে।" (এমিলি বুচ ওয়ার্ল্ড - 'ট্রান্সফর্মিং এ রেপ কালচার)
নারী-হিংসার বিরুদ্ধে আন্দোলন
উনিশশো ষাটের শেষ থেকে সত্তরের দশকের মধ্যে আমেরিকায় নারীর প্রতি হিংসা দমনে বড়সড় আন্দোলন হয়। আন্দোলনের বিষয় ছিল নির্যাতিতাকে দোষারোপ, আত্ম-দোষারোপ ও ধর্ষণমূলক অপরাধকে মুছে ফেলতে মূল্যবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা। ধর্ষণ হলে মেয়েটির কোনো দোষ নেই, একথা বারবার সামনে আনা। আইনে ধর্ষণের ধারাতেও পরিবর্তন এনে অপরাধীকেই দায়ী করা।
এরপর ২০০৬ নাগাদ আসে 'Me too' আন্দোলন। এটা মূলত যৌন হিংসা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার। ২০১৭ সালে এই প্রচারমূলক আন্দোলন আন্তর্জাতিক রূপ নেয়। প্রত্যেক মেয়ে তাদের নিজেদের জীবনে কোনও না কোনও সময়ে ঘটে যাওয়া যৌন হিংসার কথা মুখ ফুটে বলতে শুরু করে।
আজ ২০২৪-এ তিলোত্তমার নারকীয় মৃত্যু আবার নতুন করে ধর্ষণ সংস্কৃতি, দুর্নীতি ও হুমকি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনের দরজা খুলে দিল। এই আন্দোলনকে প্রকৃতপক্ষে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে একদিকে যেমন তা হবে পথে নেমে সোচ্চার স্লোগান; অন্যদিকে এই সমাজে নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠার যে মনো-সামাজিক প্রেক্ষিত, তার সূচনা, ব্যুৎপত্তি ও প্রসার নিয়ে অধ্যয়ন, আলোচনা, চর্চা ও বিভিন্ন শিবিরের আয়োজন করতে হবে। পুরুষের হিংসাত্মক অনুভূতি আসলে তার দীর্ঘকালীন চিন্তা ও বিশ্বাসের ধরন থেকে উঠে আসে। সেই চিন্তা, বিশ্বাস বা অনুভূতিগুলো ঠিক কীভাবে মন ও সমাজের রসায়নে জারিত হচ্ছে এবং আচরণ ও মানসিকতার পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব তা দীর্ঘ গবেষণা ও সমাজ সংস্কারের কাজ।
শেষত, মনে রাখতে হবে অনন্ত আকাশের নীচে মায়াভরা পৃথিবীতে নারী ও পুরুষ দুই যুযুধান বাসিন্দা নয়। একটি মেয়ে ধর্ষিত হলে মানসিক আঘাতে আতঙ্কে জর্জরিত হন তার বাবা দাদা ভাই স্বামী পুত্র তথা পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। পুরুষও ধর্ষণের অভিশাপ থেকে মুক্তি চান। আমরা চোখের সামনে দেখছি রাজ্যজুড়ে দেশজুড়ে পৃথিবীজুড়ে হাজার হাজার পুরুষ ধর্ষণ বিরোধী মিছিলে হেঁটে চলেছেন, স্লোগান দিচ্ছেন। তাই এ লড়াই দীর্ঘকালীন লড়াই, নারী-পুরুষ উভয়ের একসাথে লড়াই।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।