পূর্ব পরিকল্পনা মতো আগের দিনের দুপুরেই আমরা পৌঁছে গেলাম কেদারনাথ নিকটবর্তী 'ফাটা'য়। সেখানে একটি হোটেলে রাত্রিবাস করে পরের দিন ২২শে অক্টোবর ভোর সাড়ে চারটেতে আমরা রওনা দিলাম শোনপ্রয়াগের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি রাস্তায় দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি আমাদের আগে অসংখ্য গাড়ী এগিয়ে চলেছে ওই একই গন্তব্যের দিকে। অবশেষে সেই গাড়ির সারির পিছনে শোনপ্রয়াগ চেকপোস্ট থেকে অনেক অনেক দূরে প্রায় দু'হাজার তীর্থযাত্রীর পিছনে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। উল্লেখ্য, কেদারনাথ যাত্রার অনেক পূর্বে সকল তীর্থযাত্রীকেই উত্তরাখণ্ড সরকারের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে তাদের নিজ নিজ নাম, ঠিকানা ইত্যাদি তথ্য নথিভুক্ত করাতে হয়। চেকপোস্টে তখন ওই তথ্যের যাচাইকরণ চলছে। অপ্রত্যাশিতভাবে প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম চেকপোস্টের দরজায়। সেখানে উপস্থিত সরকারী কর্মীটি অত্যন্ত মানবিকভাবে তাঁর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে অতি দ্রুত কাগজপত্র নিরীক্ষণ করে আমাদের মন্দির দর্শনের ছাড়পত্র প্রদান করলেন।
আবার শুরু হ'ল আমাদের হাঁটা। প্রায় এক কিলোমিটার অধিক হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম শোনপ্রয়াগ থেকে গৌরীকুন্ড যাওয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত চারচাকা গাড়ীর স্ট্যান্ডে। সেখানেও আবার দীর্ঘ লাইন। সে যাইহোক, অবশেষে ন'জনের ক্ষমতাসম্পন্ন ঐ গাড়িতে তেরো জন যাত্রীকে চাপিয়ে চলতে শুরু করল 'ফেভিকল' কোম্পানির বিজ্ঞাপনের সেই গাড়ী, যার ভাড়া মাথাপিছু ৫০ টাকা। কিন্তু অল্প কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর সেই গাড়ীরও হাওয়া বেরিয়ে গেল। পথিমধ্যে আবার গাড়ি পরিবর্তন। এবারে অবশ্য ঐ পরিবর্তিত গাড়িতেই আমরা পৌঁছে গেলাম গৌরীকুন্ড, থুড়ি, গৌরীকুন্ড থেকে প্রায় দু'কিলোমিটার আগে। কারণ সেখানেও তখন অগ্রবর্তী গাড়ীর দীর্ঘ লাইন।
আবার এগিয়ে চললাম পদব্রজে। পথিমধ্যে দুই অশ্বচালকের দেখা পেলাম, আলোচনা সাপেক্ষে সরকার নির্ধারিত দরে তাদেরকে বুক করলাম। পদব্রজে আবার এগিয়ে চললাম সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের গৌরীকুন্ড বাজারের উদ্দেশ্যে, সঙ্গে চললো দুই অশ্বসমেত দুই অশ্বচালক। গৌরীকুন্ড বাজারে এসে সামান্য কিছু জলযোগ সেরে আবার এগিয়ে চললাম অশ্ব ভাড়া করার সরকারী কাউন্টারের দিকে, যার দূরত্বও ছিল সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার। গৌরীকুন্ড গেটের কাছে অবস্থিত সেই কাউন্টারে মাথাপিছু ৩,২০০ টাকা জমা করে যে রশিদ পেলাম তা চলে গেল অশ্বচালকদের দখলে, পরিবর্তে আমাদের দু'জনের গলায় ঝুললো অশ্বচালকদের দুটি সরকারী সচিত্র পরিচয়পত্র। সেখান থেকে আবার এগিয়ে চললাম প্রায় পাঁচশো মিটার দূরের অশ্বারোহণের নির্দিষ্ট ঘাঁটিতে।
সকাল প্রায় সাড়ে ন'টা, আমরা অশ্বারোহণ করলাম। অত্যন্ত দুর্গম এবং পিচ্ছিল, কর্দমাক্ত সেই পাহাড়ি পাথুরে বন্ধুর রাস্তায় কেদারনাথের পথে এগিয়ে চলল আমাদের সেই অশ্বদ্বয়। আমার সহধর্মিণীর ঘোড়াটি নিরন্তর হোঁচট খেতে খেতে এবং পিছলে পড়তে পড়তে এগিয়ে চলল, আর তার পিছনে সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে দেখতে দুরু দুরু বুকে আমিও এগিয়ে চললাম। অত্যন্ত সংকীর্ণ সেই ভয়াবহ রাস্তার বাঁদিকে সুউচ্চ পর্বত আর ডানদিকে গভীর খাদ, সেই খাদ দিয়ে বয়ে চলেছে কেদারনাথ পাহাড় থেকে নেমে আসা মন্দাকিনী নদী। বাঁদিকের সেই পর্বত থেকে মাঝে মধ্যেই ঝরে পড়েছে ঝর্ণার জল, যা আমাদের মতো তীর্থযাত্রীদের শরীর আর সংকীর্ণ রাস্তা ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ডানদিকের গভীর গিরিখাতে। সংকীর্ণ সেই রাস্তা দিয়ে একইসাথে উপরে উঠছে পদাতিক ও অশ্বারোহী তীর্থযাত্রী এবং একইসাথে নীচে নেমে আসছে আরও দুটি পদাতিক ও অশ্বারোহী তীর্থযাত্রীর দল, সে যেন এক চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। এইভাবেই চলতে চলতে আমরা অর্ধেক পথ অতিক্রম করলাম। ইতিমধ্যেই দর্শন করে ফেলেছি উপর থেকে অবতরণ প্রত্যাশী এক বয়স্ক মহিলার পথিমধ্যে অশ্ব থেকে পতনের দৃশ্য।
এবারে দশ মিনিটের বিরতি। বিরতি শেষে অশ্বপৃষ্ঠে আবার আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের আজকের চূড়ান্ত গন্তব্যে। এবারের পথ আরও কঠিন, আরও বিপজ্জনক। এবারে আবার পথিমধ্যে শুরু হ'ল তুষার বৃষ্টি। মিনিটখানেকের বিরতিতে স্থানীয়ভাবে ক্রয় করা দুটি বর্ষাতিতে দুজনেই দুজনকে ঢেকে নিলাম এবং মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলা অসংখ্য হেলিকপ্টারকে সাক্ষী রেখে অবশেষে বেলা প্রায় দেড়টা নগদ বাবা কেদারনাথের মন্দির থেকে প্রায় দু'কিলোমিটার দূরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে আমরা ঘোড়ার পিঠ থেকে অবতরণ করলাম। সেখানে তখন চলছে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা ঝড় আর তুষার বৃষ্টি। কোনওক্রমে পার্শ্ববর্তী একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নিলাম। দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে ঝড় বৃষ্টি থামলে, ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরটিকে আবার আমরা পদব্রজে টেনে নিয়ে চললাম মন্দির সংলগ্ন আমাদের তথাকথিত হোটেলের উদ্দেশ্যে এবং প্রায় বিকেল তিনটে নাগাদ অবশেষে সেখানে পৌঁছে গেলাম।
হাঁসের ঘর সদৃশ সেই হোটেলে, যার ২৪ ঘণ্টার ভাড়া ১২ হাজার টাকা! সামান্য কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ আমরা আবার বেড়িয়ে পড়লাম আমাদের বহু প্রতীক্ষিত বাবা কেদারনাথ মন্দিরের উদ্দেশ্যে। প্রায় পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে আমরা যখন সেই মন্দিরের চাতালে এসে উপস্থিত হলাম, সেখানে তখন জনসমুদ্র বয়ে চলেছে, চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠেছে বাবা কেদারনাথের জয়ধ্বনিতে। উল্লেখ্য, বর্তমান সময়ে প্রত্যহ প্রায় ১৪ হাজার পুণ্যলোভা মানুষের আগমন ঘটছে এই মন্দিরে। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে ঘোরাঘুরি, ফটোগ্রাফি আর ভিডিওগ্রাফি করে আমরা এবার বিকেল সাড়ে চারটের সময় দাঁড়িয়ে পড়লাম বিগ্রহ দর্শনের নির্দিষ্ট লাইনে, সে পথের শেষ কোথায় তখনও পর্যন্ত আমরা কেউই তা জানি না। এবারে আবার শুরু হ'ল তীব্র তুষার বৃষ্টি, সেই বৃষ্টিতে কখনও ভিজতে ভিজতে আবার কখনও না-ভিজতে ভিজতে দস্তানা-পাদুকাবিহীন আমরা ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে লাইনের সম্মুখবর্তী হলাম। আশ্চর্যজনকভাবে, প্রায় আধ ঘন্টাতেই পৌঁছে গেলাম মন্দিরের গর্ভগৃহে। সেখানে তখন উপস্থিত অনেক পুরোহিতের (যাঁদের স্থানীয় নাম 'রাওয়াল' এবং অবিশ্বাস্যভাবে যাঁরা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত) একজন (না জানি কেন) অনেক যত্নে নাম-গোত্রসহযোগে আমাদের পুজো গ্রহণ করলেন এবং দু'জনকে দুটি রুদ্রাক্ষ ফল উপহার স্বরূপ প্রদান করলেন। এবারে গর্ভগৃহে বিরাজমান পঞ্চপাণ্ডবের মূর্তিকে প্রদক্ষিণ করে আমরা যখন দেবতার সম্মুখে এসে উপস্থিত হলাম, সেখানে তখন চলছে তীব্র ধাক্কাধাক্কি আর সেকেন্ডের ভগ্নাংশে দেবতা দর্শন। কিন্তু, দীর্ঘদিনের লোকাল ট্রেনে যাতায়াতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা বেশ সুন্দরভাবেই দেবতা দর্শন সম্পন্ন করলাম।
বিকেল ৫:১৫ নাগাদ বাইরে বেরিয়ে এলাম। তখনও সেখানে চলছে তুষার বৃষ্টি। ইতিমধ্যে, সন্ধ্যাও নেমে এসেছে। সেই আলো আঁধারিতে তীব্র ঠান্ডা আর বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ঘুরে দেখলাম ভীম শিলা, শিবের ত্রিশূল, একটি কুন্ড (যেখানে দেবতার মাথায় ঢালা জল এসে সঞ্চিত হয়), মহাকাল মন্দির ইত্যাদি। এবারে শুরু হল আমাদের পাদুকা খোঁজার চেষ্টা। অনেক চেষ্টায় সম্পূর্ণ তুষারাবৃত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করলাম। চারিদিকে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে।
সন্ধ্যা ৬:১৫, মন্দিরে আরতি শুরু হল। মন্দির চাতালে দাঁড়িয়ে সেই আরতি শুনলাম (দেখতে পেলাম না, কারণ গর্ভগৃহে প্রবেশের তখন আর কোনও উপায় ছিল না)। সন্ধ্যা ৭টা, বাইরে থেকে রাত্রিকালীন আহার শেষ ক'রে আমরা ফিরে এলাম আমাদের সেই তথাকথিত হোটেলে।
এরপর শুরু হ'ল এক দীর্ঘ রাত্রিযাপনের পালা। বাইরে তখন তীব্র ঠান্ডা, সেই ঠাণ্ডায় গিজারের জলও গরম হতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোনক্রমে, কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লাম আর সারা রাত ঘুমোনোর ভান করে কাটিয়ে দিলাম। ভোর সাড়ে চারটেতে ঘুমোনোর নাটক থেকে নিজে মুক্তি দিয়ে উঠে পড়লাম। বাইরের তাপমাত্রা তখন -৩ ডিগ্রি।
এবারে আমাদের পুনর্যাত্রার পালা, এবারে কিন্তু পুরোটাই পদব্রজে। ২৩শে অক্টোবর, সকাল সাড়ে ছ'টা। বাইরের তাপমাত্রা তখন -২, আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। চারিদিকে তখন মেঘমুক্ত নীল আকাশ, বরফাবৃত নানাবিধ পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য দর্শন করতে করতে আমরা ঐ বন্ধুর পথ ধরে নীচে নামতে শুরু করলাম। প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ছ'ঘণ্টায় নীচে নামার, অর্ধেক রাস্তা প্রায় তিন ঘন্টায় নেমেও এলাম। এরপর, আবার শুরু হলো দফায় দফায় তুষার বৃষ্টি। এই বৃষ্টি আর পথিমধ্যে পেরিয়ে আসা হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট একাধিক ঝর্ণায় ভিজতে ভিজতে আমার সহধর্মিণীর পায়ের তলায় ফুটে উঠল একটি প্রকাণ্ড ফোসকা। পায়ের তীব্র যন্ত্রণা আর কষ্ট নিয়েই তীব্র মানসিক শক্তিকে সম্বল করে একটু হেঁটে আর একটু বসে এগারো ঘন্টা শেষে প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় আমরা গৌরীকুণ্ডে পৌঁছতে সক্ষম হলাম। ফিরতি পথে আবার একই পদ্ধতিতে শোনপ্রয়াগ হয়ে মনে অপার তৃপ্তি নিয়ে রাত্রি আটটায় আমরা আবার ফিরে এলাম আমাদের সেই 'ফাটা'র হোটেলে। ফেরার পথে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল আজ সকালে পথিমধ্যে শোনা একটি কথা, "কেদারনাথে সকলে কাঁদতে কাঁদতে ওঠে আর হাসতে হাসতে নামে।"