[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]
পর্ব - ১৮
অনেকদিন পর দুই অসমবয়সী বন্ধু পাশাপাশি বিছানায়, নিভৃতে মুখোমুখি। শুধু বয়সের কারণেই অসম নয়, একজন ধীর স্থির, উচ্ছ্বাস বর্জিত গম্ভীর ব্যক্তিত্ববান পুরুষ, অথচ বটবৃক্ষের মতো প্রসারিত তাঁর স্নেহচ্ছায়া। সেই অভিভাবকত্বের আশ্রয়ে নিশ্চিন্তে নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়া যায়। অপরজন বেহিসাবী, খামখেয়ালী, দুরন্ত ঘোড়সওয়ার। বুকের মধ্যে টইটম্বুর উপচে পড়া ভালোবাসার ঢেউ, সবার জন্য দিলখোলা উদারতা। এই উদারতার জন্য তাঁকে মূল্য চোকাতে হয়েছে বিস্তর। মনে পড়ে তালতলার ঘরে বিদ্রোহী লেখার সেই রাত। সারা শরীর জুড়ে কাব্যের উন্মাদনা, বুকের মধ্যে এক বীর্যবান বিশাল পৌরুষ প্রকাশের উত্তেজনা। কিন্তু সেই ঢেউয়ের প্রকাশে পাশের তক্তপোষে থাকা নিকট মানুষটির কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। হোক মহীরূহ সমান অভিভাবকত্বের আশ্রয়, কিন্তু উথাল করে ধেয়ে আসা আবেগের উচ্ছ্বাস সঙ্গে ভাসবার মতো সঙ্গী খোঁজে। উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া তরী কোন কূলে গিয়ে ভিড়বে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। মুজফফর আহমদের সঙ্গ ছেড়ে যাওয়া নজরুলের তরী দেওঘর, কুমিল্লা, দৌলতপুরের নানান রোমাঞ্চকর ঘাটে ভিড়েছে বটে কিন্তু কোনটারই পরিণতি সুখকর হয়নি। বরং কুমিল্লায় গিয়ে নজরুলের টাল মাটাল ডুবুডুবু জীবনতরীকে এই মুজফফর আহমদই কলকাতা থেকে গিয়ে উদ্ধার করে এনেছিলেন। অল্প হলেও নজরুলের মনে এক অপরাধবোধ জাগে।
- আপনার শরীর কিন্তু অনেকটাই ভেঙ্গে গিয়েছে। শরীরের প্রতি অনাচারের মাত্রাটা বেশি করেছেন। মুজফফর আহমদ কম্বল জড়িয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে কথা শুরু করলেন।
- আপনার কথা যথার্থ। জীবনে কোনও আচারই তো আমার ঠিকঠাক পালন করা হয়ে উঠল না, সুতরাং অনাচার আমার জীবনসঙ্গী হয়ে গিয়েছে। এর থেকে নিস্তার পাবো বলে মনে হয় না।
- না, না। তা কেন হবে? আপনার ভিতরে প্রাণ আছে, শক্তি আছে। কিছুটা যত্ন নিন, সতর্ক থাকুন, ঠিক হয়ে যাবে। সামনে আপনার অনেক কাজ যে কাজ অন্যকে দিয়ে হবে না। আমি কানপুর থেকেই আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে আসছি। তাছাড়া এখন আপনার সংসার হয়েছে। শরীর আর আপনার একার নেই। আমাদের অনেকেরই তাতে অংশ আছে, অধিকার আছে।
নির্জনতা ভেঙে নজরুল সশব্দে হেসে উঠলেন। 'সত্য বলেছেন, শরীরটা সত্যিই আর আমার নেই। আমার কোনও কথাই সে শুনতে চায় না। কিন্তু আপনিও যথেষ্ট রোগা হয়ে গিয়েছেন। আলমোড়া থেকে আপনার চিঠি পেয়ে খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এটা স্বীকার করতে হবে যে আপনার প্রাণশক্তির জোর যথেষ্টই বেশি। এরকম একটা কঠিন ব্যাধিকে এই অল্প সময়ের মধ্যেই জয় করতে পেরেছেন।
- আমার নিজের কাছেও কিছুটা আশ্চর্য লাগে। আসলে জেল থেকে যখন ছেড়ে দিল তখন শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ। তাছাড়া ক্ষয়রোগ বলে কথা। শুধু অসুস্থ বলে ইংরেজ শাসক কি কাউকে ছাড় দেয়? বাঁচার ভরসা আছে মনে হলে কি আর ছেড়ে দিত? তবে অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্য যে মনের মধ্যে একটা জেদ চেপে গিয়েছিল - যে করেই হোক, আমাকে সুস্থ হতেই হবে। জেলে তো আপনিও গিয়েছেন। শাসকবিরোধী আন্দোলনে পথে নামলে তাকে জেলের ঘানি টানতেই হবে সেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই থাকতে হয়। কিন্তু কমিউনিস্ট ছাপ গায়ে পড়লে তার যে কী অবস্থা দাঁড়ায়, জেলের ভিতর কী নিদারুণ কুকুর বিড়ালের মতো আচরণ সহ্য করতে হয় - সে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।
- কিরকম? তারা কি আলাদা গ্রহের বাসিন্দা নাকি?
- একদমই তাই। জেলের ভেতর স্বদেশী করা বিপ্লবী বন্দীরাও আমাদের দিকে কিরকম কৌতূহলী চোখে তাকাত - অন্যদের মতোই আমাদেরও দুটি হাত, দুটি পা আছে কিনা!
মুজফফর আহমদের বলার ভঙ্গিতে নজরুল আবারো হেসে গড়িয়ে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন, 'কানপুরে আপনাদের চারজন বন্দীকে কি একই জায়গায় রেখেছিল?
- ব্রিটিশ সরকার এতই বোকা? বলশেভিক মামলায় আমাদের চারজনকে শেষমেশ কারাদণ্ড দেওয়া হলো। এম. এন. রায় তো জার্মানিতে, তাকে ধরবার সুযোগ নেই। নাম হলো কানপুর জেল - কিন্তু অল্প দিনেই আমি গেলাম রায়বেরেলি, নলিনীকে পাঠালো গোরক্ষপুর, শওকত উসমানীকে বেরেলি আর শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গেকে পাঠানো হলো সীতাপুর জেলে।
অনেক রাত পর্যন্ত কথাবার্তা হলো। কলকাতা ফেরার আগে কানপুরের কমিউনিস্ট কনফারেন্স মুজফফর আহমদ অংশগ্রহণ করে এসেছেন। দুঃসাহসী কমিউনিস্ট কর্মী সত্য ভক্তের উদ্যোগে কানপুরে বলতে গেলে প্রথম প্রকাশ্য কমিউনিস্ট কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হলো। ব্রিটিশের চোখে মার্কামারা রাজদ্রোহী বলশেভিক শওকত উসমানী, শ্রীপাদ ডাঙ্গে, মহাম্মদ শফিকেরা তখনো কারাগারে। বলতে গেলে কানপুরের এই কনফারেন্সের কথা সংবাদপত্র মারফত ছড়িয়ে পড়ার ফলেই দেশবাসী প্রথম কমিউনিস্ট আন্দোলন ব্যাপারটা সম্পর্কে একটু বিশদে জানতে পারল। প্রবাসী এম এন রায়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী কয়েকজনকে কারাগারে নিক্ষেপ করেই ব্রিটিশ সরকার উল্লাসে মেতেছিল - ভারতবর্ষ থেকে বলশেভিক দের উৎখাত করা গিয়েছে। সত্য ভক্তের কানপুর কনফারেন্স ছিল সেই উল্লাসের উপর জোরালো এক থাপ্পড়। বিভিন্ন প্রদেশে এই ভাবধারায় আকৃষ্ট মানুষজন গোপনে সংগঠিত হচ্ছে। সরাসরি কমিউনিস্ট নাম দিয়ে প্রকাশ্যে কোনও সংগঠন চালানো এখন মুশকিল। সমভাব ধারার রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে এই ভাবধারা প্রসারিত করতে হবে - এটাই এখন কৌশল।
'তবে একটা বিষয়', মুজফফর আহমদ চিন্তিত স্বরে বললেন, 'মানবেন্দ্রনাথ রায় যাই বলুন, ভারতবর্ষে হুবহু রাশিয়ার মতো কেবল শ্রমিকের প্রতি ফোকাস দেবার মতো পরিস্থিতি আমাদের দেশে এখনো আসেনি এই বাংলায় ক'জন শ্রমিক? কৃষকরাই মূলত চারিদিক থেকে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। সুতরাং শুধু লেবার স্বরাজকে ফোকাস না করে কৃষকদের সঙ্গে নেওয়ার ভাবনাটা জোর দিতে হবে। হেমন্ত সরকার আর কুতুবুদ্দিনের সাথে এ নিয়ে একাধিকবার কথা হয়েছে। তারাও একমত। সামনে তো কৃষ্ণনগরে কনফারেন্স। আপনারা প্রস্তাবনাটি নিয়ে ভাবুন'।
- আমাদের ইশতেহারটা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন কানপুর কনফারেন্স এর আগে থেকেই কমিউনিস্ট ও বলশেভিক নীতির কথা প্রায় সবই সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে এই প্রসঙ্গে যার কথা মনে হচ্ছে - হক সাহেবের ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়? তিনি তো কৃষক-প্রজা নিয়েই আন্দোলনে আছেন। এসেম্বলিতে তারই উদ্যোগে কৃষক বিল আসতে চলেছে। নজরুল হঠাৎ করেই হক সাহেব এর প্রসঙ্গটি তুললেন। মুজফফর আহমদ একটু থেমে বললেন - 'আমি অনুমান করছিলাম এ প্রসঙ্গে হক সাহেবের কথা আপনার মাথাতেও আসবে। বাংলার মানুষ কৃষকের নেতা বলতে ফজলুল হক সাহেবকেই চেনে, জানে। কিন্তু যেটি অপ্রিয় বাস্তব তাহলো তিনি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে নিজেকে মেলাতে পারবেন না। তার অকৃত্রিম ও উদার অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলার কৃষক সমাজের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু তিনি খুবই উচ্চাভিলাষী এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক - যা কমিউনিষ্ট ভাবাদর্শের পরিপন্থী। পার্টির শৃঙ্খলায় তাঁকে আটকানো মুশকিল। তাঁর শুভেচ্ছা আমরা পাবো, কিন্তু সাহচর্যের আশা করা বোকামি হবে।
গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকা - তবু ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল। অল্প কয়েক ঘন্টা ঘুম, তবু শরীরে একটা ফুরফুরে ভাব, একটা ভালোলাগার প্রশান্তি। দেশ সমাজ রাজনীতি নিজের শরীর সব মিলিয়ে একটা জট পাকানো বিভ্রান্তির মধ্যে কাটছিল সময়টা। মুজফফর আহমদের সাথে কথাবার্তার পরে এলোমেলো ভাবটা যেন অনেকটা কেটে গিয়েছে। বেশি দেরি না করে সোজা শেয়ালদা এসে মুর্শিদাবাদ প্যাসেঞ্জারে উঠে বসলেন নজরুল। রেললাইনের ধারে ধারে কত নাম না জানা লতাপাতা, গাছপালা। অজস্র জংলী ফুল নিজের আনন্দে নেচে নেচে শীতের রৌদ্র স্নান করছে। তাদের ভিতরে কত কথার কানাকানি চলছে। লতাপাতা আর ফুলেদের কথা স্পষ্ট হয়ে কানে ভেসে আসছে। সম্ভবত এই প্রথম রেল যাত্রায় নজরুলের সঙ্গে কোনও বন্ধু-সাথী নেই। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা হইচই নেই। চূর্ণীর সাঁকো পেরোলে ধান কেটে নেওয়া বিস্তীর্ণ মাঠ যেন দুহাতে জড়িয়ে ধরে। গুনগুনিয়ে সুর উঠে আসে। কতদিন এমন নির্জন তন্ময়তা উপভোগ করা হয়নি। কাব্য সুন্দরীরা যেন ভ্রমরের মতো গুনগুনিয়ে যেন অভিমানের কথা শুনিয়ে যাচ্ছে - কবিতা কই? রাজনীতির ডামাডোলে ভালো করে কবিতাও লেখা হয়ে উঠছে না।
কৃষ্ণনগর স্টেশনে নামতেই পিছন থেকে ডাক শুনলেন, 'কাজী সাহেব!'
সৌম্য সুদর্শন দীর্ঘদেহী ব্যক্তিটিকে দেখামাত্রই চিনতে পারলেন নজরুল - আকবর উদ্দীন। দত্তনিবাসের সাহিত্য আসরের পরে আর দেখা হয়নি।
'পাশের কামরাতেই ছিলাম। আপনিও যে এই ট্রেনে আছেন ভাবতেই পারিনি।' - এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন। 'আজকে আর ছাড়াছাড়ি নাই। আগে আমার কুটিরে আপনার আতিথ্য, পরে আপনার বাসায় ফেরা'।
এই দুপুরে আপনার বাড়ি গিয়ে অত্যাচার করা ইত্যাদি কিছু বলার চেষ্টা নজরুল করলেন বটে, কিন্তু ভদ্রলোকের আন্তরিক আহ্বানের কাছে তার তেমন গুরুত্ব রইল না। তাছাড়া প্রথম দিন দেখা থেকেই মানুষটির প্রতি একটা ভালো লাগা তৈরি হয়ে আছে। সুতরাং বিশেষ কথা না বাড়িয়ে আকবরউদ্দীনের হাতে ছেড়ে দিলেন নিজেকে।
মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান। তাঁর জন্য বিশেষ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চারিপাশ খোলা কিন্তু মাথার উপর সুদৃশ্য ও শক্তপোক্ত একটা ছাউনি। ওর ওপর দিব্যি চড়ে বসা যায়। দু'পাশে ছায়াঘেরা এলাকা, ফাঁকে ফাঁকে ঘরবাড়ি। প্রথম দিনে কাশেম আলির গাড়ির কথা মনে পড়ল।
'ক'দিন থেকেই ভাবছিলাম আপনার গোলাপট্টির বাসায় গিয়েই আপনাকে ধরে নিয়ে আসব। কী আশ্চর্য, সে পর্যন্ত আর যেতে হলো না, পথের মধ্যেই আপনাকে পেয়ে গেলাম!
শহরে প্রবেশের আগেই গাড়ি ঘুরে গেল বামদিকে চাঁদ সড়কের পথে।
(ক্রমশ)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।