আমেরিকায় জাদুবিদ্যা (১৭৩৪-১৮৭৫)
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জাদুবিদ্যা আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৩৪ খৃষ্টাব্দে নিউ ইয়র্কের 'Weekly Journal'-এ একটি বিজ্ঞাপনে ঘোষনা করা হল যে জোসেফ ব্রুম (Joseph Broome) নামে এক জার্মান জাদুকর তাঁর হাত সাফাইয়ের আশ্চর্য জাদু প্রদর্শন করবেন, শহরের একটি ব্যক্তিগত বাড়ীতে। উত্তর আমেরিকায় এটিই জাদু ও জাদুকরের প্রথম বিজ্ঞাপন ছিল। বহু জাদুকর ব্রুম-এর এই সাড়াজাগানো বিজ্ঞাপন দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আর তাই এইসব জাদুকরেরা নতুন পৃথিবীতে নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করতে হাজির হন। তাঁরা জাদু প্রদর্শন করলেন, দূর থেকে কথা বলা কণ্ঠস্বরের (Ventriloquism) কারুকার্য শোনালেন, পশুদের শেখানো খেলা দেখালেন আর সেইসঙ্গে যান্ত্রিক কলাকৌশলের কিছু। এর মধ্যে ১৭৯৮ খৃস্টাব্দের প্রথম দিকে উইলিয়াম ফ্রেডরিক (William Frederick), বোস্টন (Boston)-এ শুকরছানা দিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন।
জ্যাকব মায়ার (Jacob Meyer) ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় জন্মগ্রহন করেন এক ইহুদী পরিবারে। কিন্তু তাঁর পেশাদারী জীবন বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জে। তারপর ইউরোপ মহাদেশে জীবন কাটিয়েছিলেন। এরপর খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করার পর মায়ার তাঁর জাতীয় শহরের নাম গ্রহণ করেন। ফিলাডেলফিয়া (Philadelphia) নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী, পর্তুগাল ও স্পেনে সফলতার সঙ্গে সফর করেন তাঁর জাদু নিয়ে। রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথরিন (Catherine II)-এর সম্মুখে তিনি উপস্থিত হন এবং কনস্ট্যান্টিনোপলের সুলতান তৃতীয় মোস্তফা (Mostapha III)-র সন্মুখে উপস্থিত হন। ফিলাডেলফিয়ার বিশেষত্ব ছিল, জাদু লণ্ঠনের আলোয় বাষ্পীয় মেঘের ছায়া দ্বারা ভৌতিক আকৃতির অবয়ব তৈরী করা। ফিলাডেলফিয়ার এই জাদু প্রদর্শনী সে যুগে এক অদ্ভুত বিদ্যা ছিল যাতে উচ্চমানের যন্ত্রপাতির বৃহৎ প্রদর্শনীর ব্যবহার করা হয়।
'Salem', 'Massachusetts' প্রভৃতি পত্রিকায় প্রদর্শনকারীদের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে, যাতে সমসাময়িক জাদু ও জাদু সম্বন্ধীয় মনোরঞ্জনের ইঙ্গিত দেওয়া ছিল। জাদুকর ও স্বরক্ষেপক বোস্টন থেকে আসছেন, যেখানে তিনি একটানা ৬০ রাত্রি প্রদর্শনী দেখিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, অত্যাশ্চর্য ঘড়ির খেলা দেখাবেন। তিনি একটি বড় হাতুড়ির সাহায্যে দর্শকদের ১০/১২টি সোনা বা রুপোর ঘড়ি (যেগুলি কোম্পানির দেওয়া ঘড়ি) ভাঙবেন এবং তারপর সেগুলো যথারীতি অক্ষত অবস্থায় দর্শকদের আবার ফিরিয়ে দেবেন। সেই সময় মি. র্যানি (Mr. Rannie) নামে এক জাদুকর একটি মাছের খেলা দেখাতেন। দর্শক এক প্যাকেট তাসের মধ্যে থেকে কতকগুলি তাস পছন্দ করবেন। এই বিশেষভাবে শিক্ষিত মাছটি দর্শকদের পছন্দের তাসের নামগুলি মুখে একটি কলম ধরে লিখে দেবে। এছাড়াও দর্শকদের মনের কথা বা সংখ্যাও বলে দিতে পারবে। এই মাছটি আবার নিজের দেশের পরিচয় দেবার জন্য 'ওয়াশিংটন' (Washington) কথাটি লিখে দেবে।
মি. র্যানি সালেম (Salem)-এ খুব জনপ্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে তাঁর প্রশিক্ষিত কিছু প্রাণীদের নিয়ে খেলায়। এর মধ্যে একটি ছাগলছানা উল্ল্যেখযোগ্য। এই ছাগলটির মধ্যে গাণিতিক ও ভাষাগত গুণের সমন্বয় ঘটেছিল। তাই ছাগলটি পড়তে, বানান করতে, যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ করতে, সময় বলতে, তারিখ বলতে, রং চিনতে এবং দর্শকদের টানা তাসটি তাসের গোছা থেকে সঠিকভাবে বার করে আনতে পারত।
সালেম-এ এইসময় অন্য জাদুকররাও আসতেন। অবশ্যই র্যানি-র প্রদর্শনীর বিজ্ঞাপনের পর। তাঁদের সবার নাম জানা যায় না। কিন্ত এঁরা শব্দ বা ধ্বনি (Ventriloquism) এবং দৃষ্টিশক্তি সম্বন্ধীয় খেলাগুলি দেখাতেন। এর মধ্যে 'Peace of Machinery' বলে একটি খেলায় একটি বালককে দিয়ে ম্যাজিক দেখানো হতো। ১৮১১ খ্রিষ্টাব্দে বোস্টন (Boston) শহরে আসেন ম্যাসাচুসেটস (Massachusetts)-এর রিচার্ড পটার (Richard Potter). তিনি ঐ অঞ্চলে ২০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে সাধারণ জাদুবিদ্যা প্রদর্শন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে তখন তিনি একজন প্রথিতযশা ও সক্রিয় জাদুকর ছিলেন। এইসময়ে যেসব প্রদর্শনগুলি বিজ্ঞানভিত্তিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পরিপূর্ণ ছিল, সেইগুলিই আমেরিকাবাসী দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। গৃহযুদ্ধ (Civil War)-র পূর্বে বা পরে স্বয়ংক্রিয় বা মেকানিকাল খেলাগুলিই আমেরিকায় প্রদর্শিত হতো। এইরকম একটি ছিল স্বয়ংক্রিয় দাবা খেলোয়াড়। এর আবিস্কার করেছিলেন ব্যারন উলফগ্যাং ভন কেম্পেলেন (Baron Wolfgang Von Kempelen)। তিনি এটি ইউরোপে প্রদর্শন করেছিলেন। পরে আমেরিকায় এটি দেখান জোহান মায়েলজেল (Johann Maelzel), ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে। এই স্বয়ংক্রিয় দাবাড়ু সবসময় বিজয়ী হতেন। এডগার অ্যালেন পো (Edgar Allan Poe) এই খেলার স্বয়ংক্রিয় কৌশলগুলি দেখেছিলেন এবং এই খেলার রহস্য উদঘাটন করেছিলেন। তিনি নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রগুলি কাজ করে একজন মানুষ দাবাড়ু দ্বারা, যিনি খুব চতুরতার সঙ্গে যন্ত্রপাতিগুলি চালনা করতেন। ১৮৩০ এবং ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় দুজন ইউরোপীয় জাদুকর বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন সিগনর আন্তোনিও ব্লিটজ (Signor Antonio Blitz)। যিনি পূর্বে বহু ইউরোপীয় দেশে উপস্থিত হয়েছিলেন। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আমেরিকায় এসেছিলেন।
(ক্রমশ)