নিয়ম নিজের মতো থাক। সে নিয়মে বড় হোক ঘর, মানিপ্ল্যান্ট, ডাইনিং টেবিল আর ব্যালকনি। খোলা জানলাকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ুক বর্ষার জল। বিছানার এক পাশে বইবে আদরের নদী অন্যপাশে বসন্তের অভিমানে রুক্ষ হবে ভালবাসার পাহাড়।
নিয়মের কড়া চোখরাঙানির ভয়ে কখনও চুম্বন, কখনও সহবাস, কখনও তুমুল ঝগড়া। সারারাত ধরে আলো জ্বলবে বেডরুমে আর সকাল হলেই নীল ভারী পর্দা টানা অন্ধকারে ঘুমিয়ে পড়বে অনিয়ন্ত্রিত নিয়মের শরীর। মনের মুখ ও মুখোশ একাকার হয়ে যায় দিনের আলোয়। সেই পথে কতটা এগিয়ে কতটা পিছিয়ে এলে ভালবাসা দৃঢ় হয় তা জানে না অভিমান। মনখারাপের বিকেলে মেঘ আসে জানলায়, ব্যালকনিতে অন্ধকার মুখগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উলটো দিকে বহুতলের একে একে জ্বলে ওঠা আলো গোণে। অগণিত তারা ঢাকা পড়ে থাকে মেঘের চাদরে। সে আদরে স্মৃতি জ্বলে ওঠে আচমকাই। নিচের ঘর থেকে ভেসে আসে রবীন্দ্রসংগীত 'তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা'। পাড়ার মোড় থেকে ভেসে আসে মাইকের আওয়াজ। গলি দিয়ে সম্মিলিত তরুণ কণ্ঠস্বরে বিচার দাবি করে স্লোগান ওঠে "উই ওয়ান্ট জাস্টিস"। ফিসফিস করে ঝরে পড়া বৃষ্টি রূপ বদলায়। ঝমঝম করে পড়ে চলে অঝোরে বারিধারা। আজ ক্ষোভ তার নিয়মের চিৎকার করছে কখনও মাইকে, কখনও খালি গলায়। মনখারাপের ঘর আলোকিত করতে মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ চমকায়। নিয়মবিরুদ্ধ বিরোধী স্বরকে কখনও কখনও ধমকায় হাওয়া। সে জানে তার থেমে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। নিয়মের রাজনীতি সময়ে ভুলিয়ে দেয় শোষণের ইতিহাস। আসলে বিপ্লব শুধু শাসক পরিবর্তনের খেলার একটা নিয়ম মাত্র। এসব জানার পর কেউ কেউ নিয়মবিরুদ্ধ পথে নামে। তার অরাজনৈতিক স্বরে বাতাস কেঁপে ওঠে, বর্ষা থমকে যায় প্রতিবাদী স্লোগানে। ভিজে মাটি থেকে উঠে আসা রক্তপাতের গন্ধে এক নতুন আলো স্লোগানে স্লোগানে কাঁপিয়ে তোলে অপরিচিত আকাশ। স্লোগান চুরি যায় মূল্যবোধ বন্ধক রেখে। নিয়ম সওয়াল করে চোরের স্বপক্ষে। ডাকাত থেকে বাঁচতে পুলিশ নয়, চোরই নাকি আমাদের ভবিষ্যৎ। আমরা ভুলে যাই ভিত্তি হারিয়ে ভবিষ্যতের পথে হাঁটার কোনও নিয়ম নেই। এইসব বেনিয়ম নিয়মকে নিজের মতো থাকতে দেয় না। নিয়ম বদলায়। বদলায় আইন। ঘরে থাকার আইন বদলায়, পথে চলার ফাইনও বদলায়। এইসব বদল সহ্য না করতে পেরে একদিন মানিপ্ল্যান্টের পাতা শুকিয়ে যাবে। লুকিয়ে যাবে আদরের নদী আর অভিমানের পাহাড়। আর কিছু ধান্দাবাজ রোবট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে গণতন্ত্রের নিয়ম বদলাবে মানুষকে নিয়মে শাসন করার চক্রান্তে।
গোপনে গভীরে একটা চক্রান্ত সবসময় চলছে নিয়মের বিরুদ্ধে। এমনই চলে সবসময়। অথচ এরাই নিয়মের কথা বলে। বেনিয়মের বিরুদ্ধে চোখ রাঙায়, স্লোগান তোলে। মানুষ ভোলে প্রতিটি দুর্ঘটনা। তার যন্ত্রণা জমতে থাকে। অভিমান যেমন জমতে জমতে পাথর তেমনই যন্ত্রণা জমতে জমতে ক্ষোভ। সম্মিলিত মানুষের ক্ষোভের উপর নজর দেয় রাজনীতির লোভ। রাজনীতি যা আসলে ভাল থাকার লড়াই থেকে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পরিবর্তিত। এসব বিষয়ে আলোচনা করার মতো লোক কম। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই তো কানার মধ্যে ঝাপসা বাছতে অক্ষম! তাতে কী? ভিড় বাড়াও। ভিড়ে মিশে যাও। যেভাবে মেশানো হয় দুধে জল, তেলে বিষাক্ত রাসায়নিক সেভাবেই ক্ষোভের ফলন বাড়াতে অনেক কিছুই মেশানো হচ্ছে নাগরিক মিছিলে। এসবই নিয়ম কিনা তা আমরা জানি না। জানব কী করে? আমাদের শিক্ষার হাল নিম্নগামী। যতই দামী হচ্ছে শিক্ষা ততই গভীর চেতনা থেকে দূরে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির দুয়ারে সে লাইন দিচ্ছে ক্রীতদাস হতে। আবার শিক্ষাহীন মানুষেরা বাধ্য হচ্ছে দু'টাকার চাল আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের লাইনে দাঁড়াতে। খেটে খাবার নিয়ম বদলে কারা আজ কাজের বাজার থেকে কাজ ভ্যানিস করে নিশ্চিন্তে হাওয়া দপ্তরের মোরগ সেজে দিন কাটাচ্ছেন তা আমরা জানি। তাদের ভীষণ দামী ভাষণে ভাষণে মিথ্যা গল্পের বেসাতি, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির রাজনীতি। এটাই এখন নিয়মের সংসার। ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া অবশ্যই অনিয়ম। যদিও আমি সেই দলে নাম লিখিয়েছি। নিয়ম যত সহজে ভাঙা যায়, অনিয়ম তত সহজে নয়। সবার মনের মধ্যে ভয় থাকে। সে ভয় সবটা রাজনৈতিক। কারণ অনিয়ম আর অনৈতিক একই লাইনে দাঁড়ায় না। মানুষ হারায় না বোধ। হয়তো তার পিছনে কিছুটা হলেও তার ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকে। অবশ্য সেই পাঁকে তার ডুবে যাবার সুযোগও বেশি। সত্যি কথা বলবার পর সেই সত্যিকে অপ্রাসঙ্গিক লেবেল সাঁটানোর ইচ্ছে বেড়ে যায়। ক্ষমতা দখলের ইতিহাস পালটানো আর মুছে দেবার স্বৈরাচার চলতে থাকে আর সেই ফাঁকে নিয়ম বেড়ে ওঠে অরাজনৈতিক শিবিরে।