বিবিধ

দুঃসাহসী মহিন্দার অমরনাথ



দেবাশিস সেনগুপ্ত


ছবির 'ভদ্রলোক' আমার চোখে ক্রিকেট হিরো ছিলেন ৪০ বছর আগে। তার জন্য ভালবাসা আজ আর সেদিনের মতো একইরকম নেই। বরং অনেকগুণ বেড়ে গেছে, আজকের বিনা লড়াইয়ে কার্যসিদ্ধির ক্রিকেট দিনকালে। লড়াই দেবার দাবীমুখর পরিস্থিতি আজও মনে পড়িয়ে দেয় মহিন্দার ভরদ্বাজ অমরনাথ নামের এই 'ভদ্রলোক'টিকেই। আরও বেশী করে। সেই তাঁকে নিয়েই এই লেখাটা।

বিখ্যাত বাবা ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট তারা লালা অমরনাথের প্রভাব তাঁকে ক্রিকেটের দিকেই ঠেলে দিয়েছিল। অনেক বেশী প্রতিভার অধিকারী বলে মান্যতা পাওয়া দাদা সুরিন্দার অমরনাথ বাবার মতোই টেস্ট আবির্ভাবেই শতরান করেছিলেন (যা ছিল তাঁদের জীবনের একমাত্র টেস্ট শতরান)। তবু তাঁর কেরিয়ার ১০টি টেস্ট আর ৩টি ওডিআই-তেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।

মহিন্দার অমরনাথ ৬৯টা টেস্ট (২৪/১২/১৯৬৯ থেকে ১১/০১/১৯৮৮) আর ৮৫টা ওডিআই (০৭/০৬/১৯৭৫ থেকে ৩০/১০/১৯৮৯) খেলেছিলেন তাঁর ক্রিকেটজীবনে। স্প্যানটা লক্ষ্য করুন। ১৮+ বছরের টেস্ট কেরিয়ার আর ১৪+ বছরের ওডিআই কেরিয়ার। মোট প্রায় ২০ বছর সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে চলাচল ছিল তাঁর, দৃপ্ত স্পর্ধায়। তার চেয়েও আকর্ষণীয় তথ্য হল আমার নিজের ১১ বছর থেকে ৩১ বছর অবধি খেলেছিলেন তিনি। এবং তাঁর নিজের ১৯ থেকে ৩৯ অবধি।

৪,৩৭৮ রান (এর মধ্যে ১১টি শতরান আর ২৪টি অর্ধশতরান) আর ১,৯২৪ রান (এর মধ্যে ২টি শতরান আর ১৩টি অর্ধশতরান) করেছিলেন তিনি টেস্ট আর ওডিআই-তে, যথাক্রমে। আর ওই ক্রমেই উইকেট ছিল ৩২ আর ৪৬টা। ৪/৬৩ আর ৩/১২ (১৯৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে) ছিল তার কেরিয়ারের বেস্ট টেস্ট আর ওডিআই বোলিং, যথাক্রমে। যা আজকের মাপে কিছুই না। 'বিশেষ স্নেহ' পেয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদের কাছ থেকে আর তা সুদে আসলে ফিরিয়েও দিয়েছেনও ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদেরই।

ভারতের ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জেতায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রয়োজনীয় অবদান ছিল তাঁর। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ড আর ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে 'ম্যাচপুরুষ' হয়েছিলেন তিনিই। এছাড়াও ১৯৭৬-এ পোর্ট অফ স্পেনে ভারতীয় দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিজয়ে তাঁর অবদান সশ্রদ্ধভাবে আলোচিত হয়, আজও।

১৯৮৩-র বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ২২-০৬-১৯৮৩ তারিখে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টসে জিতে আগে ব্যাট করে ফাউলার-ট্যাভারে জুড়ির ১ম উইকেটে ৬২ রানের দৌলতে একসময়ে ১০৭/২ হয়ে যাওয়া ইংল্যান্ডের মিডল অর্ডার (গাওয়ার-ল্যাম্ব-গ্যাটিং-বথাম) ধ্বংস হয়ে যায় ভারতের পেস-স্পিন দাপটের সামনে। ঠিক ৬০ ওভারের মাথায় মাত্র ২১৩ রানে ইংল্যান্ডের নটে গাছ মুড়িয়ে যায়। দলের সর্বোচ্চ রান ছিল ৩৩, করেছিলেন ফাউলার। কপিলদেবের ৩৫/৩, বিনির ৪৩/২, মহিন্দারের ২৭/২-এর সামনে সেদিন ভেঙ্গে পড়েছিল ইংল্যান্ড। জবাবে সুনীল গাভাসকার (২৫) আর শ্রীকান্ত (১৯) তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ায় ৫০/২ হয়ে গিয়ে ভারতীয় শিবিরে সৃষ্টি হওয়া উদ্বেগ কাটিয়ে দেন তৃতীয় উইকেটে ৯২ রানের মহিন্দার-যশপাল জুটি আর চতুর্থ উইকেটের ৬৩ রানের যশপাল-সন্দীপ জুটি। মহিন্দার, যশপাল আর সন্দীপ করেন যথাক্রমে ৪৬ রান (৯২ বলে), ৬১ রান (১১৫ বলে) আর অপরাজিত ৫১ রান (মাত্র ৩২ বলে)। সেদিন ৫৪.৪ ওভারে ২১৭/৪ রান করে ৩২ বল বাকি থাকতেই অতি সহজেই ম্যাচ জিতে নিয়েছিল ভারত।

২৫-০৬-১৯৮৩ তারিখে চাপের মুখে বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভেঙ্গে পড়া আর ভারতের সেদিন থেকে চার বছরের জন্য ক্রিকেটের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহনের পিছনেও ছিল মহিন্দারের উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাঁর ৮০ বলে ৩টি চার সহ শিটঅ্যাঙ্কর রোলে ২৬, আর প্রতিপক্ষের কোমর আর লেজ ভেঙ্গে দিয়ে ৭ ওভারে ১২ রান দিয়ে দুজন, মার্শাল আর হোল্ডিংয়ের ৩ উইকেট তোলা, যার সুবাদে সেমিফাইনালের মতই 'ম্যাচপুরুষ' খেতাব। যদিও বাকিরাও আপ্রাণ নির্ণায়ক ছিলেন সে ম্যাচে। সানি গাভাসকারের ১২ বলে ২ রান আর ল্যারি গোমস ও মার্শালের ২টো ক্যাচ। কৃষ শ্রীকান্তর বিশ্বত্রাস রবার্টসকে হাঁটু গেড়ে মারা কভার ড্রাইভ সমেত ৭টি চার আর রবার্টসকেই মারা ১টি ছয় মিলিয়ে ম্যাচের সর্বোচ্চ ৩৮ রান, ৫৭ বলে। ইয়াশ শর্মার ৩২ বলে ১টি চারের সাহায্যে চাপ নেওয়া ১১। স্যান্ডি পাতিলের চারহীন ইনিংসে ল্যারি গোমসকে মারা ১টি ছয় সহ ২৯ বলে ২৭। অধিনায়ক ক্যাপস নিখাঞ্জের ৮ বলে ৩টি চারে উজ্জ্বল ১৫, সেমি দৌড়বীর হয়ে ডিপ মিড উইকেটে রিচার্ডসের ক্যাচ এবং একস্ট্রা কভারে লয়েডের ক্যাচ এবং ১১ ওভারে ২১ রান দিয়ে রবার্টসের উইকেট। কীর্তিবর্ধন আজাদের ৩ বলে ০ রান, কোন ক্যাচ না নেওয়া আর ৩ ওভারে ৭ রান দিয়ে উইকেটহীন থেকে নিখুঁত দর্শকের ভূমিকা পালন করা। রজার মাইকেল হামফ্রে বিনির ৮ বলে ২ রান, হেনেসের ক্যাচ আর লয়েডের উইকেট। মদন শর্মার চারহীন ইনিংসে ল্যারি গোমসকে মারা ১টি ছয় সহ ২৭ বলে ১৭ আর একমাত্র ১২ ওভারের কোটা শেষ করা ভারতীয় বোলার হিসেবে ৩১ রানে মোট ৩ উইকেট নেওয়া, যার মধ্যে ছিল নির্ণায়ক রিচার্ডসের উইকেট ছাড়াও হেনেস ও গোমসের উইকেট। সৈয়দ কিরির শেষ দু' উইকেটে মদন শর্মা ও বল্লু সান্ধুর সঙ্গে জুটি বেঁধে মরণপণ লড়াইয়ে ৪৩ বলে চার-ছয়হীন ১৪ রান করার পরে ফাউদ বাক্কাসের ক্যাচ নেওয়া। বল্লু সান্ধুর হোল্ডিংকে মারা ১টি চারের সহায়তায় ৩০ বলে ১১, গ্রিনিজকে স্বপ্নের ইনস্যুইঙ্গারে জাজমেন্টে বোল্ড করা ছাড়াও ফাউদ বাক্কাসের উইকেট নিয়ে ২ উইকেট, ৯ ওভারে ৩২ রান দিয়ে আর সবার আগে মার্শালের আগুনগতির বাউন্সারে হেলমেট হয়ে কানে তীব্র চোট পেয়েও দুজনকে দু'বার সহানুভূতিমূলক সহায়তা করা থেকে বিরত করা ও তার পরেও শেষ উইকেটে সৈয়দ কিরির জুটিতে স্বপ্নের প্রতিরোধে ২২ রান, সবই নির্ণায়ক ছিল সেদিন। তবু আজও ঐ ম্যাচ ও টুর্নামেন্টে আলোচিত সর্বোচ্চ উজ্জ্বল চরিত্রর নাম মহিন্দার অমরনাথ।

কিন্তু এ' সবকিছু ছাপিয়ে তিনি মানেই... লড়াই।

একটা অফিসে একটা কাজের দিনে লিফট যতবার ওঠে আর নামে, তার চেয়েও বেশি বার বাদ গিয়ে আবার দলে ফিরেছিলেন তিনি... লড়াই।

সর্বাঙ্গে সেই সময়ের দ্রুততম বোলারদের 'আদর' চিহ্ণ নিয়েও পরের বলটা হুক করার 'ধক' রাখতেন তিনি... লড়াই।

নির্বাচকদের 'বাঞ্চ অফ জোকারস্' বলার 'সাহস' ছিল তাঁর... লড়াই।

১৯৮৩ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল আর ফাইনালে 'ম্যাচপুরুষ' হয়েছিলেন তিনি... লড়াই।

১৯৮৩ বিশ্বকাপ জেতায় বিশেষ ভূমিকা ছিল তাঁর... লড়াই।

নিজের ক্ষমতায় মাঠে আর মাঠের বাইরে 'বিদ্রোহ' করার 'স্পর্ধা' ছিল তাঁর... লড়াই।

হেরে যাওয়াটা নিয়ম বানিয়ে ফেলা একটা দল আর দেশকে পালটা মার দিয়ে বেশ কয়েকটা উল্লেখযোগ্য জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি... লড়াই।

'আইডলসৃ' বইয়ে সুনীল গাভাসকার তাঁকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন, হেডিং ছিল 'Courage thy name is Jimmy'... লড়াই।

তিনি খেলা ছাড়ার ৩৫ বছর পরেও আজও চোখ বুজে দেখতে পাই, প্যান্টের ব্যাক পকেটে লাল রুমাল বেরোনো তিনি ঢিমেতালে দৌড়ে আসছেন বল করতে, তুলছেন উইকেট, আটকাচ্ছেন রান। অথবা বাউন্সারে চোট খাওয়ার পরের বলটা হুক করে ৬ মারছেন। অথবা চকিতে নীচু হয়ে ক্যাচ নিচ্ছেন বা চার বাঁচাচ্ছেন। খেলা ছাড়ার ৩৫ বছর পরেও তাই আমার কাছে লড়াইয়ের প্রতিশব্দ এবং ভারতীয় ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা 'আনসাং হিরো'র নাম মহিন্দার অমরনাথ।