পর্ব - ১৩
কলেজের তিনদিকে তিনটি খেলার মাঠ। একদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বীদের গীর্জা, তার পাশে মিশনারী স্কুল, কলেজের সামনে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে বিশালাকৃতির খেলার মাঠ, তার দক্ষিণ দিক দিয়ে চলে গেছে বড়ো সড়ক, সড়কের আরও দক্ষিণে রোমান ক্যাথলিক চার্চ। অত্যন্ত দর্শনীয় এবং ঐতিহ্যবাহী, কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিমে কৃষ্ণনগরের গর্ব রবীন্দ্র ভবন। সবদিকেই চমৎকারভাবে সাজানো আমাদের কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়। প্রতিটি মাঠের চারপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে সুশীতল ছায়া দানকারী নানা প্রজাতির গাছ। এর মধ্যে কিছু গাছ রাতারাতি কেটে গোপনে পাচার করে দিয়েছে গাছ-মাফিয়ার দল। কেউ কেউ বলেন----প্রশাসনের কোনো কোনো কর্তাব্যক্তি এর সাথে যুক্ত। কিন্তু কোনো প্রমাণ না থাকায় কাউকে ধরা যায়নি। কথাগুলি অবশ্য হাওয়ায় ভাসে, অনেকটা ঝোড়ো হাওয়ায় শুকনো পাতা ভেসে চলার মতো। যাঁরা অপরাধীদের চেনেন তাঁরা হয়তো ভয়ে বা নিজে যুক্ত থাকার অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন তাই মুখ খুলতে চাননা। তবে এটা ঠিক যে, সত্য একদিন প্রকাশ পাবেই, সত্য কখনো চাপা থাকে না। আমরাও বসে বসে আলোচনা করি……মাটির সঙ্গে সমান হয়ে আছে গাছের গোড়াগুলো কিন্তু গাছগুলো নেই। বেশ দামি দামি সব গাছ কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। মানুষের এ ব্যাপারে কোনো হেলদোল বা প্রতিক্রিয়া নেই……বড়ো অদ্ভুত একটা জগৎ। কেউ জোর করে জমি দখল করে, কেউ বসতবাড়ী, কেউ পুকুর চুরি, আবার কেউ গরু, বালি, মাটি, কয়লা, খাবার আরও কত-কী! আমি ভাবি আর ভেবেই চলি…….এভাবেই কী পৃথিবীটা চলবে? কোনোদিন কোনো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে উঠবে না? ঢেউ উঠবে না, প্রাণ জাগবে না? বাবা থাকলে প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতাম। তিনি অবশ্য বলে গেছেন----অনেক পড়াশোনা করতে হবে তাহলে সব জানা যাবে। হ্যাঁ, মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।
হঠাৎ দেখি আলো এসে হাজির। আমরা কয়েকজন বসে একটু গল্পগুজব করছিলাম, আলোর উপস্থিতি আমাদের আলোচনাকে আলোকিত করলো। আলো জানালো যে, আজ টাউন হলের মাঠে ঠিক বিকেল তিনটের সময় নাটকের শো আছে, প্রবেশ অবাধ। নাটকটা দেখলে অনেক কিছু শেখা যাবে, অঙ্গন মঞ্চের নাটক, কলকাতার একটা নাট্যদল আজকের অনুষ্ঠানে নাটক মঞ্চস্থ করবে। সবাই খুব উৎসাহিত হলাম, কলেজ থেকে সোজা টাউন হল মাঠ। তিনটের পর আর ক্লাস নেই সুতরাং গেলে মন্দ হয়না। জীবেশ খুব উৎসাহী ছেলে, ও সবাইকে নিয়ে যাবেই, আমার অবশ্য পাঁচটার সময় পড়ানো আছে। আলো জানালো যে, পাঁচটার আগেই শেষ হয়ে যাবে। আমি বেশ উৎসাহিত হলাম। আগে শুনেছিলাম…….জানুয়ারি ফেব্রুয়ারী মাসের প্রায় প্রতিটি রবিবারে বিকেল তিনটের সময় নাটকের উৎসব হয়। কোনোদিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি আজ যে করেই হোক যাবো। শুনলাম বাদল সরকার আসছেন। বাংলা ভাষায়, বাংলা নাটকের ধারায় উনি এই নাটকের স্রষ্টা। তা সেই স্রষ্টাকে দেখার সুযোগ পেয়ে হারানোটা ঠিক হবে না। “এবং ইন্দ্রজিৎ”—নাটকের মাধ্যমে বাদল সরকারকে জেনেছি। তাই বসে না থেকে সবাইকে একটু তাড়াতাড়ি করতে বললাম। উদ্যোক্তারা নাকি সময় সম্পর্কে খুবই সচেতন। যে সময় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ঠিক সেই সময় অনুষ্ঠান শুরু করেন, একটুও নড়চড় হয়না। তাই দেরী না করাই উচিত।
নাটকের নাম ‘স্পার্টাকাস’-----কী অসাধারণ উপস্থাপনা, টীম ওয়ার্ক, পুরো নাটকটাই দাঁড়িয়ে আছে আঙ্গিকের ওপর। নাটকের সাজপোশাক বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু নেই, কোনো লাইট বা ক্যামেরার ব্যবহার নেই, সম্পূর্ণ খালি গলায়, ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক ছাড়া এত সুন্দর পরিবেশনা আমি এই প্রথম দেখলাম। নাটকের প্রয়োজনে মুখে কিছু শব্দের ব্যবহার করে এবং পর্দার পিছনে দুই একটা ড্রাম বা ঢোল জাতীয় কিছু বাজিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তৈরী করা হয়েছে। আরও একটা বিশেষত্ব হলো----তিন দিক খোলা মঞ্চ, একটা দিকে একটা সাদা কাপড় দিয়ে আড়াল করা। সেখান থেকেই নাটকের কুশীলবেরা দুটো পাশ দিয়ে প্রবেশ ও প্রস্থান করছে। যে তিনটি দিক খোলা আছে সেই খোলা তিনদিকে দর্শক শ্রোতারা বসে আছেন। একেবারে মুক্ত মঞ্চ, এটাকেই অঙ্গন মঞ্চ নাম দেওয়া হয়েছে। এতে খরচ খরচা খুবই কম এবং দর্শক বন্ধুদের সাথে নাটকের কুশীলবদের দূরত্ব একেবারেই নেই। নাটক দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। এভাবেও নাটক করা যায়! বিষয় নির্বাচন করে নাটক রচনা করে গাঁ-গঞ্জের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়াও সহজ। দর্শক বন্ধুরা খুব কাছ থেকে এটা দেখে সহজে বুঝতেও পারবে। ওদের সমস্যা নিয়ে তৈরী করলে ওরা আরও আকৃষ্ট হবে, নাটককে একটা সামাজিক গণমাধ্যমের কাজেও ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু কাদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলা যায়। আলো যখন আমাদের জানিয়েছে তাহলে ওর কাছে সব খবর পাওয়া যাবে। কাল কলেজে ওকে জিজ্ঞেস করা যাবে। নাটক শেষ হলে উদ্যোক্তাদের মধ্যে থেকে চারজন লোক চাদর ধরে মেইন গেটের মুখে দাঁড়িয়ে পড়লেন, আর মূল মঞ্চে একটা কাপড় পেতে দিয়ে দর্শকদের নিকট আবেদন জানালেন----নাটক অভিনয়ের জন্য নয়, এই টীম চালানোর জন্য আমাদের কিছু খরচ খরচা হয়। আপনাদের স্বতঃস্ফূর্ত দানে আমাদের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়। তাই আপনারা যে যা পারবেন আমাদের রাখা কাপড় বা গেটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের চাদরের উপর দেবেন। আপনাদের মূল্যবান সহযোগিতাই আমাদের পাথেয়।
উপস্থিত দর্শকমণ্ডলী দু’টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকা করে দিতে শুরু করলেন। আমি পাঁচ টাকা দিলাম, ওদের একজন সদস্যবন্ধুর সাথে কথা বললাম, তিনি আমাকে কৃষ্ণনগর ‘তীরন্দাজ’ নাট্যগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করতে বললেন। আমি খুব উৎসাহিত হলাম, আলো নিশ্চয় জানে, ওকেই ধরতে হবে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো নম্বর হলো না। জানিনা কোন এক অজ্ঞাত কারণে রেজাল্ট ইনকমপ্লিট এলো। ইতিপূর্বে কলেজে সবার মুখে মুখে আলোচনা চলছে জয় এবার দুর্দান্ত রেজাল্ট করেছে। কলেজের বিগত কুড়ি বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, সবাইকে বলছি---তোদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, কিন্তু কে কার কথা শোনে? আমার সহপাঠীরা আনন্দে আত্মহারা, আমার তো ভীষণ টেনশন হচ্ছে। অবশেষে সবাইকে অবাক করে দিয়ে দেখা গেল ইনকমপ্লিট রেজাল্ট। সবাই হতাশ হয়ে পড়লো, কোথা থেকে কে এই ভূঁয়ো খবর ছড়িয়েছে কে জানে? এদিকে আমার তো দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। জানিনা কী হবে, এমন একটা অশ্বস্তিকর অবস্থায় কোনোদিন পড়িনি তাই চিন্তাটা আরও বেশি। কলেজে একটা গুমোট ভাব, প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, কারও মুখে কোনো কথা নেই, সবার চোখে যে বিস্ময়ের ঘোর তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের রেজাল্ট এবার খুবই খারাপ। সাড়ে তিনশো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে মাত্র এগারো জন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে। পঞ্চাশ জনের কাছাকাছি ব্যাক পেয়েছে, বাকিরা দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে। গড় নম্বরেও অনেক পিছিয়ে। বরং কলা বিভাগের ফল তুলনামূলক ভাবে ভালো। সেখানে পাসের হার অনেক বেশি, গড় নম্বরও বেশ ভালো। যাদের অসম্পূর্ণ ফল এসেছিলো তাদের মধ্যে আমি একজন। মাসখানেক বাদে আমাদের ফল প্রকাশিত হলো। খুব ভালো না হলেও খারাপ নয়, তবে আমার রেজাল্ট আশানুরূপ না হওয়ায় আমার পছন্দের বিষয়ে সাম্মানিক নিয়ে ভর্তি হতে পারলাম না। যে বিষয়টা বেছে নিলাম সেটা আমার দ্বিতীয় পছন্দের বিষয় ছিলো। যাইহোক সাম্মানিক নিয়ে আমরা মোট বাইশ জন ভর্তি হলাম। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ থেকে আগত বন্ধুরা পরস্পর পরস্পরের সাথে পরিচয়ের পর্ব সারতে লাগলো। হ্যাঁ, আলো অনেক কষ্টেসৃষ্টে উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডিটা পেরিয়ে গেল। রেজাল্ট হাতে নিয়ে ওর সে কী আনন্দ…….যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। ও তো বলেই ছিল-----পাশ করলে একটা কাজ পাবে। সেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো সে, এবার ওদের অভাব কিছুটা হলেও ঘুচবে, একটু শান্তিতে দু’বেলা দু'মুঠো খেতে পারবে। ঠিকমত মায়ের সেবাযত্ন করা যাবে। আমার মনটাও ওর খুশিতে খুশী হয়ে উঠলো। ওকে অভিনন্দন জানিয়ে বললাম-----ভালো থাকিস, সবার খেয়াল রাখিস, মাকে যত্ন করিস, ভাইকে ওর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করিস। আর প্রয়োজন হলে আমাকে একটু জানাস।
আমার কথা শুনে ওর চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। সজল চোখে বললো---তোদের মতো এমন বন্ধু পেয়েছিলাম ব’লে আজ আমি সফল হতে পেরেছি। তোদের অবদানের কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না। একদিন পারলে বাড়িতে আসিস। অনেক কথা বলা হয়নি, সেদিন সব বলবো। আমার মা’কে একটু দেখে যাস।
সম্মতি জানালাম। যাবো একদিন। হ্যাঁ যেতে আমাকে হবেই। আমাদের গ্রুপে যারা ছিলো তাদের প্রত্যেকের পারিবারিক অবস্থা জানি। আলোর সংগ্রামী জীবনের কথা শুনে সবাইকে ভালোভাবে জানার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠলো। জানার ইচ্ছে হলে গভীরভাবে জানা উচিত। বাড়ি কোথায়, নাম কী, বাবা কী করেন—এসব প্রশ্ন থেকে একজনকে কতটুকুই বা জানা যায়?
আলোর পাখিরা গান গায়। কিন্তু তার ভেতরের যন্ত্রণা ক’জন বোঝে?
(ক্রমশ)