।। ১১ ।।
উপসংহার
রামের কাছ থেকে দশরথের কক্ষে এলে। দশরথকে খুব ব্যস্ত মনে হল। তবু রাজা হাসি মুখে তাড়াতাড়ি উঠে এসে তোমার হাত ধরে বসালো। তুমি শেষ মরিয়া চেষ্টায় তৎপর হলে। "রাজা, আমি তোমার কাছে বর চাইতে এসেছি, তোমার মনে আছে, শম্বাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের পরে তুমি আমাকে দুটি বর দান করে বলেছিলে, আমার যা ইচ্ছা আমি তোমার কাছে চাইতে পারি, তুমি অবশ্যই তা পূর্ণ করবে।" রাজার চোখের চাহনি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল, তবু স্মিত হেসে বলল, "হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, বল তোমার কি চাই? তোমাকে অদেয় তো আমার কিছুই নেই!"
আকুতির সুরে বললে, "তাহলে, রাজা তুমি রামকে চোদ্দ বছরের জন্য বনে পাঠিয়ে দাও, সে রাজা হওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেনি এখনও! নিজের ব্যক্তিগত জীবন আস্বাদন করা, সীতার সঙ্গে নিভৃত সময় কাটানো তার বেশী প্রয়োজন। রাজ্যের এবং প্রজাদের ভালমন্দ বোঝার বয়স তার এখনও হয়নি। চোদ্দ বছর পরে সে যখন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে, তখন সে যেন সিংহাসনে বসে। এই হল আমার প্রথম বর!
আর দ্বিতীয় বরে আমি চাইব, সেই চোদ্দ বছর নাহয় ভরতই সিংহাসনে বসুক।"
দশরথের বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে তোমার নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল, কিন্তু তোমারতো উপায় নেই! দশরথ চীৎকার করে বলে উঠল, "এ হতে পারেনা, কৈকেয়ী, সব আয়োজন হয়ে গেছে, আর আমি কৌশল্যা আর রামকে কথা দিয়েছি! আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি, তুমি অন্য কিছু চাও!"
অনেক বাদানুবাদ চলল, দশরথ তোমাকে বিশ্রী ভাষায় গালি পর্যন্ত দিলেন শেষ অবধি! এবার তুমি এমনকি, বর দান করা ছাড়াও, বিবাহের শর্তের কথাও মনে করিয়ে দিলে, "রাজা! আমি ভুলে গেলেও, তুমি যে, সমস্ত কেকয়াবাসীর সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, আমার পুত্রই হবে ভবিষ্যতে অযোধ্যার রাজা, তারা কিন্ত সেকথা ভোলেনি! যুধাজিতকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা, আমার বিফলে গেছে। অন্তত কিছুদিনের জন্য যদি রামকে সরিয়ে দাও আর ভরতকে সিংহাসনে বসিয়ে রাখো তাহলে, একটা যুদ্ধের হাত থেকে রাজ্যের মানুষ বেঁচে যাবে।"
এই সময়ে কৌশল্যা দরজায় করাঘাত করে ভেতরে প্রবেশ করে।তোমাদের দুজনকে এরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে বিস্মিত সে বলে, "কী হয়েছে তোমাদের?" দশরথ তোমাকে দেখিয়ে বলে, "এই বিকৃতমনা নারী, নিজের সুখের জন্য আমাদের সবার সর্বনাশ করতে চাইছে!" তুমি বলে ওঠ, "না রাজা, এখন তুমি মিথ্যা ভাষনের আড়ালে নিজের দোষ স্বীকার করছ না, কেন তুমি এখানে কাউকে এতদিন ধরে, এমনকি তোমার অন্য দুই রাণীকেও সত্যিটা বলোনি যে, আমাকে পাওয়ার জন্য কী প্রতিজ্ঞা তুমি করেছিলে!"
তারপর কৌশল্যার কৌতুহল মেটাতে অতীতের সমস্ত কথা যখন বললে, তখন কৌশল্যা বলল, "রাজা, তোমার এহেন প্রতিজ্ঞার কথা আগে জানলে আমি কখনোই চাইতাম না, রাম রাজা হোক!" রাজা দশরথ, মূর্ছিত প্রায় হয়ে শয্যা নিলো। তোমরা বৈদ্যদের খবর দিলে।
এরপর একদিন কেটে গেল, সারাদিন তোমরা দশরথের শুশ্রুষা কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে কাটালে, বৈদ্যরা তোমাদের ভেতরে ঢুকতে দিলনা। রাত ভোর হয়ে গেল, তোমাদের কারো চোখে ঘুম এলো না। কৌশল্যা তোমার সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করলেও, সদা হাস্যময়ী সুমিত্রা তোমাকে বিষ নজরে দেখছে, ক্রোধের আগুন তার চোখে-মুখে!
তুমি বুঝতে পারছ, গোটা রাজপ্রাসাদ আজ তোমার বিরুদ্ধে কথা বলছে, চারিদিকের ফিসফাস কথা তোমার কানে আসছে, "রাজার এই শোচনীয় অবস্থার জন্য তুমি দায়ী!" তোমার চোখে জল নেই, কিন্তু অসম্ভব জ্বালা করছে!
পরদিন সকালে রাজার দূত এসে খবর দিল, রাজসভায় তোমার ডাক পড়েছে! আজ ছিল রামের রাজ্যাভিষেকের দিন, রাজ প্রাসাদের চারিদিক নিস্তব্ধ, তুমি শীতল পাথরের দেয়াল ধরে তোমার কক্ষে দাঁড়িয়ে আছ! মন্থরা আর আশা তোমার পরিচর্যা করতে চেয়েছিল, কিন্ত তুমি ওদের বারণ করে দিয়েছ!
স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত রাণী কৈকেয়ী, তুমি কোনও মতে গিয়ে রাজসভায় বসলে। দেখলে বিশ্রস্ত পোশাক আসাক, হতোদ্যম রাজা সিংহাসনে আসীন। কৌশল্যারও আছে। তোমাকে দেখে সভায় গুঞ্জন উঠল! ক্রমে তা ধিক্কার ধ্বনিতে পরিনত হল! তখন রাম তোমার আসনের কাছে এগিয়ে এসে তোমাকে বলল, "মা, আমি জানতাম তুমি অশেষ ক্ষমতার অধিকারী, এই রাজ্যে রাজার পরেই তোমার নির্দেশ চলে। তবে আমি এও মানতাম, তুমি অসম্ভব বুদ্ধিমতী এবং বিবেচক, কিন্ত আজ তুমি এ কী করলে মা? কেন করলে! তুমি তো আমাকে তোমার নিজের ছেলের মতই ভালবাসতে! তাহলে কি এমন হল?"
তুমি অস্ফুটে বলতে চাইলে অনেক কথা, যুধাজিতের কথা, সম্ভাব্য যুদ্ধের কথা, কিন্ত তোমার মনের সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে পাথরের মত, নির্বিকার ভাবে তুমি বসে রইলে! কারণ, তুমি দেখতে পেলে অদূরে উপস্থিত ভরতের চোখে একরাশ ঘৃণা!
রাজা দশরথ, ঠাসাঠাসি ভীড়ে ভরা সভার মাঝখানে ঘোষনা করলেন, "রামের রাজ্যাভিষেক অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত থাকল! এই কুলটা নারীর আক্রোশ মেটাতে তাকে আমি চোদ্দ বছরের জন্য নির্বাসিত করলাম!" একথা বলে রাজা "হা রাম, বলে ডুকরে কেঁদে উঠল! রাম এবং আর সবাই ছুটে এসে তাঁকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল। সভাসুদ্ধ লোক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, রামের নামে তারা জয়ধ্বনি দিতে লাগল। ভরত এগিয়ে এল তোমার দিকে, "আমার ভাল করতে চেয়ে আজ যা তুমি করলে তাতে তোমাকে মা হিসেবে ভাবতে আমার ঘৃণা বোধ হচ্ছে, তুমি যা করলে তাতে তোমার নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে কুচক্রী, ডাইনী হিসেবে !" তুমি অবশেষে সম্বিত ফিরে পেয়ে চীৎকার করে বললে, "ভরত, তুমি একবার আমার সব কথা শোনো। তাহলে তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে আমি কেন একাজ করেছি! আমি শুধু তোমার ভাল নয়, সবার ভালর জন্যই এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। আমার একটাই ভুল হয়েছে, তোমার সঙ্গে এই নিয়ে আগেই কথা বলে নেওয়া উচিত ছিল! তুমি আমার আত্মজ, তুমি যদি আমাকে ভুল বোঝো, আমার কোথাও দাঁড়াবার জায়গা থাকবেনা!" তোমার গলায় অনুনয়ের সুর ঝরে পড়তে লাগল।কিন্তু, ভরত এসবে কান দিল না, পেছনে একবারও না তাকিয়ে সে সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। নির্বাক, নিঃসঙ্গ তুমি সবার মাঝখানে একাকী দাঁড়িয়ে রইলে।
তোমার আর এক ছেলে, লক্ষণ, যে চেহারা এবং স্বভাবের মিলে অনেকটা দশরথ, একনিষ্ঠ ভাবে যে কর্তব্যপরায়ন সে, সভায় দাঁড়িয়ে বলল, "রাম আর সীতার সঙ্গে আমিও যাব নির্বাসনে, তাদের সুরক্ষার জন্যই আমাকে যেতে হবে! নিদ্রাদেবীর আশীর্বাদে এই চোদ্দ বছর আমি জাগ্রত অবস্থায় কাটাব ওদের প্রহরী হিসেবে। আমার স্ত্রী উর্মিলা এখানেই থাকবে, আমাদের মায়েদের দেখাশোনার জন্য।"
শত্রুঘ্ন বলল, "ভাই ভরতের প্রতি আমার কর্তব্য করার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত থাকব।"
তুমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে লাগলে, তোমার পুত্র রাম- লক্ষণ যেন দেহে আরও শক্তিশালী, আরও আনন্দময় মননের অধিকারী হয়ে, চোদ্দ বছর পরে এই রাজসভায় ফিরে আসে। সীতার প্রতি মনে মনে, তোমার আশীর্বাদ বর্ষিত হল এই বলে, "যা তুমি চেয়েছিলে, সর্বাংশে তোমার জীবন যেন তার সব কিছু দিয়ে ভরে ওঠে! প্রেম, ভালবাসায় ভরা তোমার অঙ্গনে চিরবসন্ত বিরাজ করুক!"
রাম সীতা লক্ষণ চলে গেল, বনবাসের পথে, রাজার প্রিয় মন্ত্রী তথা সারথি সুমন্ত্র তাদের রথে চড়িয়ে নিয়ে গেল। শোকস্তব্ধ অযোধ্যা নগরীতে সেদিন কোথাও আলো জ্বলল না!
পরের দিন দশরথ একবার, তোমাদের তিনজনকেই ডেকে পাঠাল। শুশ্রুষা কক্ষে মুমূর্ষু দশরথের দিকে তাকানো যায় না! এই তিন দিনে তার বয়স যেন তিনগুণ বেড়ে গেছে। তোমরা তাঁর শয্যার পাশে গিয়ে বসলে। অতিকষ্টে তোমাদের তিনজনের স্বামী কথা বলতে চাইল, বৈদ্যদের বারণ করা সত্ত্বেও!
"আমার এই পুত্র শোকের জন্য আমিই দায়ী, আজ আমি আমার পুরোনো এক পাপের কথা তোমাদের কাছে বলতে চাই!" রাজার যখন অল্প বয়স ছিল, তখন শিকার করতে গিয়ে, ভুলবশতঃ হরিণ মারতে গিয়ে, শ্রবণ কুমারকে বাণ মেরে হত্যা করেছিলেন। শ্রবণ কুমারের অন্ধ মাতা পিতা তখন, নিজেদের মৃত্যুর আগে দশরথকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিল, "পুত্রশোকে আমাদের যেমন প্রাণ যাচ্ছে, একদিন তোমারও তাই হবে।" এই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রাজার নাভিশ্বাস উঠল। তাও কোনওমতে শেষকথা বলল, "কৈকেয়ী তোমার কোনও দোষ নেই, রাগে দুঃখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তোমাকে অনেক কুকথা বলেছি !" তুমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলে!
তোমার দিন কাটে ঘরবন্দী হয়ে, বৃদ্ধা মন্থরা এখনও তোমার তেমনি যত্ন করে, তার কাছে জানতে পারলে, রাজার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ভরত গেছিল চিত্রকূটে, যেখানে রাম এখন আছে। সেখান থেকে সে রামের পাদুকা দুটি মাথায় করে নিয়ে এসে অযোধ্যার সিংহাসনে বসিয়েছে। সে বলেছে রামের অবর্তমানে সে এইভাবেই রাজত্ব চালাবে।
তুমি বসে থাকো, এই আশা নিয়ে, একদিন আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। সেই ছেলেবেলার মতই তোমার চার পুত্র আবার তোমাকে 'মা' বলে জড়িয়ে ধরবে। রাম-লক্ষণ, সীতা ফিরে আসবে! একদিন ভরত আর শত্রুঘ্ন তোমাকে নির্দোষ বলে স্বীকার করে নেবে। মান্ডবী আর শ্রুতকীর্তি আবার তোমাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে। কৌশল্যা আর সুমিত্রার সঙ্গেও আবার নতুন ভালবাসার সম্পর্ক তৈরী হবে। হাতের মুঠোর মধ্যে দিয়ে বালি যেমন ঝরে যায়, তেমন চোদ্দ বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
(সমাপ্ত)
গ্রন্থের নামঃ কৈকেয়ী (Kaikeyi: A Novel)
লেখিকাঃ বৈষ্ণবী প্যাটেল (Vaishnavi Patel)
ভাষাঃ ইংরাজী
প্রকাশকঃ রেডহুক (Redhook)
বাঁধাইঃ পেপারব্যাক
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫১২ পাতা
মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয় মুদ্রায়): ১,৭৩৪ টাকা