[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]
সহধর্মিণী প্রমীলা ও জ্যেষ্ঠপুত্র সব্যসাচী ও কনিষ্ঠপুত্র অনিরুদ্ধ-র সাথে নজরুল।
পর্ব-১৯
পাকা রাস্তা থেকে সুরকি ঢালা পথে নামতেই পরিবেশটা যেন বদলে গেল। দুই পাশেই আম কাঁঠালের গাছ আর ফাঁকে বাঁশের ঝাড়। অল্প খানিকটা এগোতেই পিছনে শহরের রাস্তাটা হঠাৎই যেন আড়ালে চলে গেল। লাল ইঁটের কুচি ছড়ানো রাস্তাটা বেশ এবড়ো খেবড়ো। সম্ভবত ঘোড়ার খুরে সুরকির পথ সবসময় তটস্থ হয়ে থাকে। ক'দিন আগেই ঠিক উল্টো দিকের বাড়িটিতে নজরুল এসেছিলেন। দত্তনিবাস - পাকা রাস্তা থেকে সুরকি ঢালা পথটি ছিল মসৃণ, কারো গায়ে আঁচড় নেই। দুপাশের সারিবদ্ধ বিলিতি তালগাছগুলিও ছিল ভদ্র এবং শৃঙ্খলায় পরিপাটি। সেখানেই আকবরউদ্দীনের সাথে আলাপ। দত্তনিবাসের ঠিক উল্টোদিকের পাড়াটি যেন সম্পূর্ণই বিপরীত। অগোছালো গ্রাম্যতা আর বিশৃঙ্খলার চিহ্ন ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। বাঁদিকের কলতলায় আট-দশজন বিভিন্ন বয়সী মেয়ে স্নান করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা ইত্যাদি নিয়ে কোলাহলে মত্ত। তাদের কথাবার্তা আর পোশাক-আশাক দেখেই অনুমান করা যায় এলাকায় দরিদ্র মানুষের বাস যথেষ্ট। দরমার বেড়া আর টালির ছাউনি দেওয়া ঘরবাড়িগুলোও তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। ডাইনে বেশ বড়ো একটা ঘেরা জায়গার ভিতরে বেশ কয়েকটি আমের গাছ। বাঁদিকেও একটা আমবাগান। বাগানটা পেরিয়েই একটা বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামল।
গায়ে গায়ে লাগা জিওল আর সজনে গাছের সারি দিয়ে ঘেরা বাড়িতে ঢোকার আগে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা। ঘোড়ার গাড়ি সেখানে দাঁড়ানো মাত্র 'আব্বু আব্বু' বলে ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে বছর চারেকের ফুটফুটে একটা ছেলে। বেশ ছটফটে। অচেনা মানুষ দেখে একটু থমকে গেলেও সে খুবই সামান্য সময়ের জন্য। আকবর উদ্দীন দ্রুত কোলে তুলে নিয়ে নজরুলের দিকে তাকিয়ে বললেন - এই যে আমার সুপুত্র। খুবই দুষ্টু, সবসময় লাফালাফি লেগেই আছে!
নজরুল তার গাল টিপে দিয়ে জিগ্যেস করলেন - নাম কী তোর?
বাবার দিকে একবার তাকিয়ে শান্তভাবে সে জবাব দিল - বদর।
- তুই কি দুষ্টু? দেখে তো মনে হচ্ছে না! গাছে চড়তে পারিস?
আকবর উদ্দীন বেশি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কিভাবে যেন নজরুলের সাথে বদরের ভাব হয়ে গেল। কাঁধের ঝোলা থেকে কাগজের একটা ঠোঙা বের করে ছেলের হাতে দিতেই 'দাদু, গজা গজা' বলে আনন্দে চীৎকার করতে করতে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল।
আলাদা প্রাচীর বলে কিছু নেই। তবে জিওল, সজনে, আমড়া ইত্যাদি গাছগুলি সীমানা বরাবর বাড়িকে ঘিরে আছে। সেগুলোকে জড়িয়ে বেশ পরিপাটি করে বাঁশের বেড়া দেওয়া। প্রবেশপথে ইঁটের থাম দিয়ে কাঠের দরজা। ইঁটের দেওয়ালের উপর পাকাপোক্ত টিনের ছাউনি। সামনে বড়ো উঠোন, ইঁদারা, তার পাশে বারান্দা দেওয়া আরেকটি ঘর। সম্ভবত বাইরের লোকজনের জন্য বৈঠকখানার মতো করে বানানো। সেটিও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। নজরুল একটু অবাকই হলেন। চারিদিকে একটা রুচির ছাপ স্পষ্ট। বইপত্রও আছে সাজানো। শিক্ষিত হলেও মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়িতে সাধারণ ভাবে পরিচ্ছন্নতা এবং রুচির অভাব চোখে পড়ে। বালতির জলে হাত-পা ধুয়ে নজরুলকে ঘরে বসিয়ে আকবর উদ্দীন বাড়ির ভিতর গেলেন।
নজরুলের ভালো লাগলো বেশ। পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান, খুব সামনের সারিতে না থাকলেও রাজনীতির সাথে নিশ্চয় ভালো ভাবেই যুক্ত। কিন্তু বাইরে থেকে দেখে মানুষটিকে সেরকম বোঝা যায় না। সৌম্যদর্শন, ভদ্র, কম কথা বলেন, কিন্তু পড়াশোনাও আছে বেশ। ঘরে প্রবাসী ছাড়াও মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকা কাঠের তাকের উপর রাখা দেখা যাচ্ছে। পোস্ট অফিসের ছাপ মারা লাঙল পত্রিকার তিনখানা কপিও টেবিলের একদিকে সাজানো আছে। একপ্রকার নিজের হাতে সম্পাদনা করা লাঙলের কপিগুলোই টেনে নিলেন সামনে। প্রথম সংখ্যাটি নেড়েচেড়ে দেখে নিজের লেখায় নিজেই কেমন মুগ্ধতায় ডুবে গেলেন। সাম্যবাদীর কবিতার কথাগুলো কিভাবে যে এসে ভর করছিল - এখন ভাবলে নিজেই বিস্মিত হয়ে পড়েন। একদিকে জ্বরের কোপে মাথায় যেন পাথরের মতো ওজন চাপিয়ে দিয়েছে কেউ। চোখের পাতা বেশি তুলতে গেলে ব্যথা। নারী ও বারাঙ্গনা নিয়ে লেখা শুরু করতে সেই যন্ত্রণায় নুইয়ে পড়া মাথা যেন ঘোরের মধ্যে একের পর এক কথা সাজিয়ে তুলে দিচ্ছে কলমের ডগায়। শোভাবাজারের রাস্তায় বিকেলবেলা মুখে রঙ মেখে দাঁড়িয়ে থাকা মুখগুলির ছবি যেন স্পষ্ট ভেসে উঠতে লাগল।
- দাদু!
বদরের কন্ঠস্বরে নজরুল যেন ঘোরের ভিতর থেকে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে চাঁদসড়কে ফিরে এলেন। দাদুর হাত ধরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছেন আকবর উদ্দীনের পিতা - অনুমানে অসুবিধা হয়না। শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই বৃদ্ধ খুব মোলায়েম স্বরে বললেন, 'বোসো বাবা, বোসো। তোমার মতো নামীদামি মানুষকে আকবর যে বাড়িতে ধরে আনতে পেরেছে তাতে আমি বেশ অবাকই হয়েছি।'
মুখে হাল্কা সাদা দাড়ি। সাদা ফতুয়ার উপরে সাদার উপরে কালো ডোরাকাটা একটা চাদরের মতো জড়ানো। দেখেই মনে হয় ধর্মপ্রাণ নিরীহ মানুষ। নজরুলের মনে পড়ে গেল প্রথম দিনেই বিজয়লালের বাবার সাথে সাক্ষাতের মুহূর্তের দৃশ্য। তাঁর কথা বলার স্বরে একটা জোর, একটা ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ছিল। কিন্তু বদরের দাদুর হাসিমুখে নিরীহ নরম ভাব থাকলেও নজরুলকে ইনি কিন্তু আপনি বলেন নি, সরাসরি তুমি বলেছেন। কোথাও কোনো ইতস্ততভাব নেই। ব্যক্তিত্বের এও আরেক প্রকাশ।
- বদরের কাণ্ড দেখো। কাকুটাকে দেখতে যাবে না? বলে একরকম জোর করে ধরে নিয়ে এলো। অতদূর থেকে এসেছ, একটু বিশ্রাম করারও তো সময় দিতে হবে!
নজরুল সারাদিনে এই প্রথম তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় হো হো করে হেসে উঠলেন। বদরের হাত ধরে কাছে টেনে বললেন,
- কীরে দুষ্টু? দাদুকে কষ্ট দিয়েছিস? তবে খুব ভালো কাজ করেছিস। কখন থেকে ভাবছি চাচাজান কোথায়, তাঁর সাথে কখন দেখা হবে। আকবর সাহেব তো রেখে চলে গেলেন।
- না বাবা, আমাদের বৌমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বেশ কিছুদিন ধরেই খুব দুর্বলতায় ভোগে, হাঁপিয়ে যায়। আকবরের মা তো বারো বছর আগেই চলে গিয়েছে। অল্পবয়সেই এই বৌমা এসে পুরো বাড়িটা একা হাতে সামাল দিয়ে রেখেছে। আকবর তো কোর্টের চাকরিটা কোনোমতে করে আর দিনরাত কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। কোথায় যাত্রাদলে, কোথায় ক্লাবে, কোথায় ভোটে। এখন তো ক'বছর ধরে পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছে। ঘরসংসারে নজর দেবার সময় নাই। ছোটো ছেলেটাও অনেকদিন কলকাতায় পড়ে থাকে। উকিল হবার পড়াশোনা করছে, কোর্টে উকিলদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে। এই বৌমা সারাদিন পরিশ্রম করে। রান্নাঘর, ঘরবাড়ি গোছানো, পরিষ্কার করা - এসবই তার কাজ। কিন্তু কী যে অসুখে ধরল, কয়েক মাস হয়ে গেল, দিন দিন আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
- চিকিৎসা নিশ্চয় হচ্ছে।
- নগেন ডাক্তার তো দেখছে। কিন্তু বৌমাটি খুব উদাসীন। কাউকে রোগের কথা বলতে চায়না। ওষুধও মনে হয় ঠিকঠাক খায় না। আর এই অসুস্থ শরীরেই সব ঘর ঝাড়ু দেওয়া, জামাকাপড় গোছানো ইত্যাদি করতেই থাকে। হাবির মা কাজ করে দিয়ে যায় রোজ, তবু মন ভরেনা। আমি বকাঝকা করি, এটা তোমার কিন্তু একেবারেই ঠিক হচ্ছে না। নিজের শরীরটা তো আগে ঠিক রাখতে হবে! এই দ্যাখো আমি বকর বকর করেই যাচ্ছি। তুমি বলো নতুন জায়গায় এসে কেমন লাগছে?
নজরুলও অনুমান করেছেন, কথা বলার লোক পেলে আর নিজের বাড়ির সমস্যার কথা উঠলে বয়স্ক মানুষের কথা থামতে চায়না। বললেন, 'হুগলির চেয়ে অনেক ভালো আছি। হেমন্তদা কোনো অসুবিধে রাখেন নি। ছেলেগুলোও বেশ ভালো।'
- তোমার কোনো নতুন লেখা পেলেই আকবর আমাকে দেখায়, পড়েও শোনায়। তোমার শাতিল আরব আর খেয়াপারের তরণী আমি তো মাঝে মাঝেই পড়ি। আমাদের মুসলমান লেখকদের মধ্যে এতো সুন্দর করে লেখা আগে কোনোদিন দেখিনি।
- আপনি খেয়াপারের তরনীও পড়েছেন? নজরুল বিস্ময় প্রকাশ করেন।
- সেতো কবেকার ব্যাপার। ক'দিন আগে লাঙল পত্রিকা পেয়ে আমি তো খুবই অবাক আর যাকে বলে একেবারে মুগ্ধ। 'খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়' - সত্যিই এরকম কথা আগে কোনোদিন শুনিনি। সামনেই আমাদের মসজিদ। সেখানে বাইরের দরজা তো লাগিয়ে রাখতেই হয়। আমি যেদিনই দরজা লাগিয়ে বাইরে আসি - তোমার ওই লেখার কথা মনে পড়ে যায়। তা বাবা, শরীরকে অবহেলা করো না। তুমি তো মুসলমান সমাজের গর্ব। তুমি কৃষ্ণনগরে এসেছ সে খবর তখনই পেয়েছি। এতো তাড়াতাড়ি তোমার দেখা পাব তা ভাবিনি।
- তা কেন ভাবছেন? আমি তো ঘুরে বেড়াতেই ভালোবাসি। আপনার ছেলে অনেক গুণী মানুষ, দেখা তো হতোই!
বলতে বলতে আকবর উদ্দীন এসে ঢুকলেন ঘরে।
- চলুন, দুটো ডালভাতের ব্যবস্থা হয়েছে, খেয়ে নেবেন।
- সেকি! আমি তো বাড়ির কাছেই চলে এসেছি। একেবারে ঘরেই চলে যেতে পারতাম। এক কাপ চা হলেই আমার চলে যেতো।
- জানি, আপনি চা ভালোবাসেন খুব। কিন্তু এই দুপুরবেলা চা খেয়ে কাজ নেই। একেবারে দুটো ভাত খেয়ে নেওয়াই ভালো। আপনাকে হঠাৎ করে পেয়ে গিয়েছি, অত সহজে ছাড়ছি না।
শান বাঁধানো উঁচু বারান্দায় খেজুরের চাটাই পেতে খাবার ব্যবস্থা হয়েছে। আকবর উদ্দীনের স্ত্রী নিজেই খাবার পরিবেশন করে যাচ্ছেন। মাথায় কাপড় থাকলেও পর্দানশীন মোটেও নন। মাছ আর ডিম ভাজা তুলে দিতে দিতে 'কিছুই তো রান্না করতে পারলাম না, আর একদিন ভাবীকে নিয়ে আসতে হবে কিন্তু' ইত্যাদি বলে চলেছেন।
আকবর উদ্দীন যোগ করেন,
'কাজী সাহেবের মতো এতো ব্যস্ত লোককে ধরে আনতে পেরেছি সেই খুব!'
নজরুল স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় হাসতে হাসতে বলছেন - 'বিনা খবরে যদি এতো ভালো ভালো রান্না পাই, তাহলে আর খবর দিতে হবে না - বিনা খবরেই দেখবেন হাজির হয়ে যাব!'
চোখের সামনে এই সামান্য সময়ের মধ্যে বদরের মায়ের সঙ্গে নজরুল এতো সহজ আর এতো অন্তরঙ্গ কী করে হয়ে উঠতে পারলেন আকবর উদ্দীন ভেবে পেলেন না। পরপুরুষের সামনে যায়না, কথা বলে না তা নয়। একাজে ওকাজে বাড়িতে হামেশাই লোক আসা-যাওয়া করে। কিন্তু তারা বাইরের ঘরটাতেই বসে। টুকটাক কথার উত্তর দিলেও অচেনা কারো সঙ্গে প্রথম আলাপে এতো গল্প করতে পারে - নিজের স্ত্রীকে দেখেও কিছুটা বিস্মিত হলেন। কবি মানুষদের বোধহয় একটা বিশেষ আকর্ষণী ক্ষমতা থাকে। যতই বন্ধুতা থাক, কারো বাড়িতে প্রথম গিয়ে সে বাড়ির মহিলার সঙ্গে কথা বলার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না।
বিকেল পর্যন্ত অনেক গল্প হলো। তাকের উপর থেকে পুরনো শনিবারের চিঠি বার করে সামনে রাখলেন আকবর উদ্দীন।
- আপনি অনেক বড়ো কবি, অনেক বিতর্ক চলে আপনাকে নিয়ে সেটা বুঝি। কিন্তু এইসব নোংরা গালাগালি, কুৎসা - এগুলি আপনি সহ্য করেন কী করে সেটা কিছুতেই ভেবে পাইনা।
নজরুল পত্রিকাটি টেনে নিয়ে পাতা উলটে দেখতে লাগলেন। হেসে বললেন - আপনার সংগ্রহ দেখে আমি তো বেশ অবাক হচ্ছি! শনিবারের চিঠিও গুছিয়ে রেখেছেন!
- আপনি হাসছেন? আমার তো খুবই রাগ হয় এদের লেখা পড়ে। রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়েনি এরা। এটা কোন ধরণের সাহিত্য রীতি? কলকাতার শিক্ষিত সাহিত্যের লোকজন এর প্রতিবাদ করেনা কেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উচিত ছিল এদের নিন্দা করা। এরা তো সবাই আপনার চেনাজানা, সবাই ভালো লিখতে পারে। তো এরকম গুণী লেখক হয়ে মানুষ এতো নিচে নামতে পারে কী করে? মুসলমান একজন কবিকে তাদের একেবারেই সহ্য হচ্ছে না!
আরাম করে বিছানায় কাৎ অবস্থা থেকে নজরুল উঠে বসলেন। সামান্য একটু গম্ভীর।
- না আকবর সাহেব। ঠিক মুসলমান বলে নয়। আমাকে ওরা ঈর্ষা করে। আমার মতো চালচুলোহীন কলেজে না পড়া অশিক্ষিত একজন মানুষ - তার উপর গ্রাম থেকে উঠে আসা সামাজিক কোনো পদমর্যাদা না থাকা ছন্নছাড়া মানুষ - এবং মুসলমান! তাকে নিয়ে লোকে এতো মাতামাতি কেন করবে? আমার কাগজ কেনার জন্য কলকাতার ফুটপাথে লোক দাঁড়িয়ে থাকে, গুরুদেব আমাকে স্নেহ করেন - এগুলো ওরা সহ্যই করতে পারে না। তার উপর খাঁড়ার ঘা পড়ল বিয়ে করা নিয়ে।
- সেটাই তো বলছি। একজন মুসলমানের এতো বড়ো হয়ে ওঠা কলকাতার বাবুরা মানতেই পারছে না।
- এখন সেকথা অস্বীকার করিনা আকবর সাহেব। একসময় করতাম। কিন্তু প্রথম ধাক্কা খেলাম কান্দিরপাড় থেকে, আমার মায়ের কাছ থেকে, দাদার কাছ থেকে। তাঁদের আশ্রয়ে একেবারে সন্তানের মতো, পরিবারের একজনের মতো কাটিয়েছি। দু'দিন পাঁচদিন নয়, মাসের পরে মাস। তাঁদের বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করার ব্যাপারটা অবশ্যই তাঁদের সবার কাছেই খারাপ লাগার মতো, ধাক্কা লাগার মতো খবর। কিন্তু যিনি আমার মাতৃস্নেহের অভাব পুরোমাত্রায় পূরণ করে দিয়েছিলেন - তিলমাত্র খামতি রাখেন নি - তিনি অসন্তুষ্ট এবং ক্ষুব্ধ হবেন সেটা জানি। তাই বলে এতোটা বিরূপ হয়ে যাবেন, সন্তানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবেন - সেটা ভাবতে পারিনি।
- আপনার কষ্ট হয়নি? খারাপ লাগেনি?
- আসলে কী জানেন আকবর সাহেব, ব্রিটিশের দালাল টিকটিকি আর ঘোর ধর্মান্ধ ছাড়া আমাকে কেউ অপছন্দ করতে পারে, বিরূপ হতে পারে - সেটা আমি ভাবতেই পারিনা। সেই অভ্যাসটাই তো নেই। প্রথমটায় খুব খারাপ লেগেছিল বৈকি। অভিমানও হয়েছিল খুব। দুনিয়াটা আরো বিচিত্র মনে হলো যখন দেখলাম প্রবাসীর মতো সংস্কারমুক্ত প্রগতিমনা গোষ্ঠীর মানুষেরাও হঠাৎ করে বিরূপ হয়ে উঠল। তাঁরাও হিন্দু মেয়ে বিবাহ নিয়ে ভিতর ভিতর এতো স্পর্শকাতর! অথচ এরাই জাতপাত, ভেদহীন বিবাহের পক্ষে কথা বলত এতোদিন। আর আমি তো জাতপাতের বিরুদ্ধে, ভেদাভেদের বিরুদ্ধেই কথা বলে এলাম এতোদিন। শুধু স্পর্শকাতর আর বিরূপ হয়েই থামল না। প্রবাসী আমার কবিতা ছাপা বন্ধ করে দিল, আর শনিবারের চিঠি বার করে কী কী কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। তবে যাই বলুন, ক্রমশ দেখলাম - এদের কথায় রাগ করে লাভ নেই। আর রাগ-টাগ নিয়ে বেশিদিন আমি থাকতে পারিনা। একসময় মনে হলো - যে যা খুশি বলুক, নিন্দে করুক, দূরে সরিয়ে দিক - আমি বরং আমার মতোই থাকি। আমার কাউকে দূরে সরাবার নেই। রাগ করারও কিছু নেই। দেখুন, ওরা যত ব্যঙ্গ করবে, নিন্দে করবে - তত আমার খ্যাতিই বেড়ে চলবে! লোকে আরও বেশি বেশি করে আমার লেখা পড়বে! তাতে কার বেশি লাভ হলো?
বলে নজরুল হা হা করে ঘর কাঁপিয়ে একটা হাসি দিয়ে বালিশে একপাক গড়া দিয়ে নিলেন। আকবর উদ্দীন সে হাসিতে যোগ না দিয়ে গম্ভীর হয়েই উত্তর দিলেন।
- কাজী সাহেব, আপনি শুধু উদার মানুষ নন, সে উদারতার বিশালতা অনেক। আমরা ওরকম করে ভাবতে পারিনা। বুঝতেও পারিনা একজন মানীগুণী কবি-সাহিত্যিককে কিভাবে ব্যাঙের সাথে তুলনা করে ব্যঙ্গ করা যায়। সেতো গেলো হিন্দু সমাজের কথা। ব্রাহ্ম হলেও রামানন্দ বাবুরা আসলে তো হিন্দুই। তাদের রাগ আর ঈর্ষার কথা তবু কিছু বোঝা যায়। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারিনা মোহাম্মদীতে আপনার উপর এতো ক্ষোভ কেন? আকরম সাহেব তো গোঁড়া মুসলমান নন, বরং তিনি সাহিত্য শিল্প নিয়ে মুসলমানদের ভিতর প্রগতিশীলতার কথা প্রচার করেন। তিনিও কেন এতো সমালোচনা করেন? আপনার কবিতায় হিন্দু দেবদেবীর অতিরিক্ত বর্ণনা এবং ভক্তির প্রকাশ অনেকের পছন্দ হয় না, না হতেই পারে, সেটা স্বাভাবিক। তাই বলে আল্লার গজব নেমে আসার মতো অভিশাপ দেবার মতো মূর্খ ও জ্ঞানহীন মানসিকতা আসে কী করে?
- আকবর সাহেব, আপনার মতো বুঝদার মানুষ মুসলমান সমাজের ক্ষোভ দেখে বিস্মিত হচ্ছেন? আমার ইন্দ্রপতন কবিতার দুটি লাইন নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেল - যেন কেয়ামত সমাসন্ন! অথচ শিল্পের ভাবটা, কবিতার ভাবটা কেউ একবার বুঝে দেখবার চেষ্টাও করল না!
- আমি মোসলেম জগত আর মোসলেম দর্পণ দুটো কাগজই পড়েছি। এক লেখাপড়া জানা, বেশ শিক্ষিত মৌলানা আছেন চাঁদসড়কের মসজিদে, ইসমাইল গাজী - তিনি আপনার ব্যাপারে খুব খবর রাখেন। অনেকের মতো তাঁরও খুব আগ্রহ - আপনি মুসলমান সমাজে আরও বড়ো জায়গা নিন, নেতৃত্ব দিন, অশিক্ষিত মোল্লানির্ভর সমাজের যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করুন। কিন্তু সেই আর পাঁচজনের মতো তাঁরও খুব দুঃখ - হিন্দু দেবদেবীকে বড্ডই মাথার উপরে তোলেন, রাজনীতির লোককে পীর-পয়গম্বরের সাথে তুলনা করেন - এগুলো তাঁর বড়োই না-পসন্দ! কিন্তু আপনার উপর গজব নেমে আসুক, আপনি ইসলামের কলংক, অহংকারী কাফের ইত্যাদি বদনাম আর গালাগালি দেওয়াটাও তাঁর না-পসন্দ। আপনাকে নিয়ে কিছু ছাপা হলেই আমার কাছে নিয়ে আসেন। গতবছর মোসলেম দর্পণের লেখাটি পড়েই তিনি আমার বাড়িতে ছুটে আসেন। বলেন - কাজী সাহেবের শুধু ত্রুটিগুলো তুলে ধরে অভিশাপ দেওয়া কি ঠিক? তাঁর গুণগুলো দেখতে হবে না? এই সময়ে মুসলিম সমাজে তাঁর মতো একজন শক্তিশালী লেখকের খুব দরকার।
- তাই নাকি? ইন্টারেস্টিং! ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করতে হবে তো!
- তিনি জানলে আজকেই ছুটে আসতেন। একদিন নিয়ে যাব আপনার কাছে।
- তা নাহয় হবে। কিন্তু বেলা তো শেষ হয়ে এলো। এবার তো উঠতে হয়। সকালের ট্রেনে এসেছি শুনলেই মাসিমা একচোট চেঁচামেচি করবেন।
নজরুল কাঁধের ঝোলাটার দিকে হাত বাড়ালেন। আকবর উদ্দীন বললেন, 'ঠিক আছে চলুন। আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।'
- আমিও যাব!
দু'জনে বের হতেই একছুটে বদর এসে হাজির। বিকেল হতেই ঠান্ডা শুরু হয়েছে। বদরকে ওর মা মাথায় টুপি আর শীতের জামাকাপড় পরিয়ে দিলে তিনজনে সুরকি ঢালা পথে এসে উঠলেন। তার আগে বাড়ি থেকে বের হতেই হঠাৎ হাবির মা'র সঙ্গে দেখা, আকবর উদ্দীনের বাড়িতে ঢুকছে।
- ও মা, কাজী ভাই এই পাড়াতে? দূর থেকেই আমি ভাবছি এই মানুষ এই পাড়াতে কেন? চেয়ারম্যানের বাড়ি বলে কথা!
নজরুল দেখলেন জ্ঞান সরকারের বাড়িতে মাসিমা যাকে ডেকে কাজ করিয়ে নেয় - সেই মুখরা মহিলা। মনে পড়ছে, বলেছিল চাঁদসড়কে বাড়ি। ছেলে যাত্রা করে বেড়ায় ইত্যাদি কত গল্প শোনাচ্ছিল সেদিন। এখানে ওর নাম তাহলে হাবির মা।
- এইখানে তোমার বাড়ি?
- হ্যাঁ গো, দাদাভাই। ওই তো সামনের চালাটা। বাড়িঘর বলে আর কী আছে!
আকবর উদ্দীন হাবির মায়ের খপ্পর থেকে উদ্ধার করে কবিকে বললেন - চলুন, পাড়ার ভিতর দিয়ে যাই। এই অদ্ভুত পাড়াটাও আপনার দেখা হবে। চার্চের পাশ দিয়ে গোয়াড়িতে চলে যাব।
(ক্রমশ)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।