লেখার টেবিল জুড়ে ছড়ানো মোমের আলো। নিভে আসা অন্ধকার মাঝেমধ্যে নিজেকে জ্বালিয়ে তোলে সে আলোয়। সাদা পাতার উপর চোখ রেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলা মন, দূরে চলে যায়। কখনও চাঁদের পাহাড়ের দেশে, কখনও গভীর জঙ্গলের ভিতরে নিজেকে হারিয়ে ফেলে ফিরে আসে অচেনা মনন নিয়ে। হারিয়ে ফেলা মনের মনন হবার গল্পে লেখার টেবিলের মোমবাতির শিখা কেঁপে কেঁপে ওঠে। সে গল্পের ভাষা কখনও গদ্যের শরীর নেয়, কখনও কবিতার। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে কেউ থমকে যায়। সমুদ্রতট যেমন থমকায়, তেমনই পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথ। বস্তির অন্ধকার গলি যেমন থমকে দাঁড়ায়, তেমনই চমকে ওঠে বহুতল। যেন কোথাকার চিৎকার অন্য কোনও জায়গার শীৎকারে মিশে যায়। মিশে যায় অথবা মিশে যেতে বাধ্য হয়। বাধ্য হয় অথবা বাধ্য করা হয়। কে বাধ্য করে? সেই অপূর্ব সুন্দর আলো নাকি সেই নিভে আসা অন্ধকার!
লেখার টেবিল জুড়ে থাকে শুধু কিছু আলো আর কিছু অন্ধকার। অবচেতনের কথা শুনে তারা ঘুরে দাঁড়ানোর অভিনয় করে। সমস্ত চেতনা থেকে যত দ্রুত অন্ধকার ছুটে যায় অবচেতনের অন্ধকারের উঠোনে তত লেখা হারিয়ে যায় তার নিজস্ব অভিসারে। লেখা তখন আর লেখকের বশে নেই। অবচেতনের হাত ধরে সে ছুটে যায় কখনও ভোরের আলোর কাছে, কখনও গোধূলির মায়াবী কিরণের কাছে। শব্দের উপর শব্দ উড়ে এসে বসে। মুদ্রাদোষে টেবিলের উপর চাপড় মেরে কবি জানলা খুলে তাকায় বাইরে ছড়িয়ে পড়া অন্ধকারের দিকে। সে জানে না সে কী লিখে চলেছে। অবচেতনের অন্ধকার তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় তার বলতে না চাওয়া কথাও। হয়তো কোনও পাপ, কোনও অপরাধ অথবা কোনও স্বীকারোক্তি!
লেখার টেবিল উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কখনও আবার বিষণ্ণ হয়ে চুপ করে শোনে লেখকের স্বগতোক্তি। প্রতিটি শব্দের মধ্যেকার ভার ও ভরের হিসাব সে রাখে। বাক্যের ভিতরে সব অবচেতনের আঁচড় ক্রমশ ছবি হয়ে ফুটে ওঠে তার কাছে। শরীরের কথা মনের রাস্তার ভুল ঠিকানায় হারিয়ে যায় যেমন, তেমনই হৃদয়ের কথা শরীরে আঁচড় কাটার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলে। এইভাবে লেখার টেবিল মাঝেমধ্যে স্থবির হয়ে পড়ে। সেখানে লেখার কাজ আর হয় না, হতে পারে না। মোমবাতি জ্বলে অথচ সে আলোয় নিভে আসা অন্ধকার জ্বলে ওঠে না। কেন এমন হয় সে কথা জানার জন্য সে চুপ করে বসে থাকে। নিজের অবচেতনে আলো ফেলে সে কখনও লেখকেও অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করে। হালকা হাওয়ায় উলটে যাওয়া ডাইরির পাতায় লেখকের চেতন ফিরলে টেবিল চনমনে হয়ে ওঠে।
অবচেতনের অন্ধকার লিখিত হয় তারই কোলের উপর। সে সব জানে,অথচ সে কথা বলার মতো ক্ষমতা তার নেই। তাই সহ্য করে লেখকের দম্ভ আর অবসাদের বিরক্তি।
যে লেখক এত কিছু লেখে, লিখতে চায় সে কখনও লেখার টেবিলকে নিয়ে ভাবে কি? এই প্রশ্ন করতে না পেরে প্রবল অবসাদের ভিতর স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমোতে যায় সে। অথচ, লেখা চলে। চলতে থাকে অবচেতনের ধারাবিবরণী আর মনের ভিতরে ক্রমশ ঘটে যাওয়া এক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। যতক্ষণ যুদ্ধ চলবে ততক্ষণ লেখার বিরতি নেই আর স্লিপিং পিল খেয়েও ঘুম আসবে না টেবিলের।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।