আজকের এই প্রযুক্তিবিদ্যার যুগে মানুষের শান্তিময় জীবনযাপন ক্রমশঃ কঠিন হয়ে উঠছে। সুখভোগের উপসামগ্রী সবকিছু থাকা সত্ত্বেও মানুষ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে মানসিক রোগের শিকার হয়ে পড়ছে। কিন্তু কেন? আসলে মানুষের মধ্যে থেকে সৎ গুনাবলীগুলি বিনষ্ট হয়ে গিয়ে সে জায়গায় কু-ভাব ও কু-অভ্যাসের বীজ রোপন হচ্ছে। মানুষের মধ্যে থেকে ভক্তি-বিশ্বাস, ন্যায়-অন্যায় এই বিচারবোধগুলো ক্রমশ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে 'দৈবপ্রীতি পাপভীতি' এই অমূল্য বোধ শূন্য হয়ে পড়ছে মানুষ। এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে পাপ বা পুণ্য কি? আসলে 'পাপ' হলো মনুষ্যকৃত মন্দকর্ম। আব্রাহামিক ধর্মসমূহ যেমন খ্রিস্টধর্ম, ইহুদি ধর্মে পাপকে বলা হয়েছে, এমন কোনও কাজ যা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায়। অপরদিকে 'পুণ্য' বলতে সেই সৎকর্মকে বোঝায় যার সাথে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা জড়িয়ে আছে। গীতাতেও বলা হয়েছে কাম ক্রোধ বর্জিত হয়ে যখন আমরা ভগবানের ইচ্ছায় তাঁরই সেবায় নিয়োজিত হই তখন সেই কর্ম পবিত্র হয়ে ওঠে। অর্থাৎ যে কোনো পবিত্র কাজ ভগবৎ লব্ধ। পাপ-পুণ্য এই ধ্যান ধারণা আমাদের আত্মোপলব্ধির ফসল যা আমাদের শাস্ত্রজ্ঞান থেকেই গঠিত হয়।
আর 'শাস্ত্রজ্ঞান' বলতে গেলে সর্বপ্রথম আমাদের আদি ধর্মগ্রন্থ 'বেদ'-এর কথাই উঠে আসে। বেদ হল সকল শাস্ত্রের মাতা। বেদ হলো ভারতের আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিপালক; দিব্যশক্তির অধিকারী। স্বয়ং ঈশ্বরের শ্বাস ও প্রশ্বাস রূপে বেদ নির্গত হয়েছিল।
'বেদ' শব্দটি 'বিদ্' ধাতু, যার অর্থ হলো 'জানা' হতে জাত। "বিদং তু অনেন ইতি বেদ" অর্থাৎ যা সকল জ্ঞানকে প্রকাশ করে তাই হল বেদ।
সকল দুঃখ ও কষ্টকে অতিক্রম করবার উপায় ও প্রক্রিয়া এতে উল্লিখিত রয়েছে। এই অনাদি ও সনাতন বেদে শান্তি প্রদানকারী আধ্যাত্মিক নিয়মানুবর্তিতা সম্পর্কে সকল নির্দেশ রয়েছে।
আমাদের গীতা যাকে 'গীতপোনিষদ' বলা হয়ে থাকে, সেখানেও তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধপূর্বে অর্জুনকে দেওয়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত মনুষ্য ধর্মের গূঢ়তত্ত্বই উঠে এসেছে; বিভিন্ন যোগ সাধনা ও বৈদান্তিক নির্দেশাবলী অনুসৃত হয়েছে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা তো আসলে বেদেরই সারাংশ। সেখানে স্বয়ং ভগবান (ভগ মানে ষড় ঐশ্বর্য্য - ধর্ম, যশ, শ্রী, জ্ঞান, বৈরাগ্য এবং ঐশ্বর্য্য, যিনি এই ষড়গুণের পূর্ণ অধিকারী তিনিই ভগবান) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন - আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ।
আসলে বেদ হলো মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো যা আমাদের তথা জগতের কল্যাণকর সত্যকে প্রকাশ করে। পৃথিবীর উৎপত্তির সাথে সাথেই যেমন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উৎপত্তি তেমনই বেদের বাণী অনুসৃত হয়েছিল সেই আদিকাল হতে, মানুষের কল্যাণেরই জন্যে। আর মানুষ যদি আজ সেই জ্ঞানতত্ত্ব বিস্মৃত হয় তবে মানব জীবনে শান্তি বিরাজ করে কি করে?
বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ, স্মৃতি, পুরাণগুলির অনন্ত জ্ঞানরাশি সহস্র ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। ঠিক এক একটি সমুদ্রের মতো যেন, তার থেকে যতই জল আহরণ করো না কেন তার এক ইঞ্চি জলও যেমন নেমে আসে না তেমনি এই শাস্ত্রগুলির জ্ঞান ভান্ডার অফুরন্ত, অপরিমেয়।
তবে একটা প্রশ্ন এসেই যায়, এই অনন্ত তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন কেন? বস্তুত এই তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমেই জীবাত্মা ও পরমাত্মা মিলনে চিৎ জগতে ফিরে যাওয়া। আমরা এই দেহকে তার সাকার রূপ, কেবল শরীর ধরে নিই কিন্তু এর সারসত্য এটাই - দেহ হল জীবাত্মা।
এই দেহকে যদি একটা সাধারণ প্রদীপের মতো কল্পনা করি তবে যা দেখি -
প্রদীপটা হল দেহ, প্রদীপের ভিতরের তেলটা হলো সাধনালব্ধ ফল, সলতেটা হলো আত্মা। এইবার প্রদীপটা যখন জ্বালানো হয় তখন সেই আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন ঘটে।
দীপং জ্যোতি পরব্রহ্ম -
আলোই সেই জ্যোতিস্বরূপ 'পরমব্রহ্ম' - জন্মাদ্যস্য যতোহন্বয়াদিতরতশ্চ, অর্থাৎ "সবকিছুর উৎস হচ্ছেন পরমব্রহ্ম" ( শ্রীমদ্ভাগবত গীতা)।
এই দেহকেই আমরা 'আমি' বলে আখ্যায়িত করি। এই আমি তো আর কেউ নই সেই আত্মা যা পরমাত্মার পিয়াসী।
আত্মাকে দেহের - অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় এই পাঁচটি কোষ আবদ্ধ করে রাখে। তাহলে তো তার মুক্তির জন্য আমাদের সাধনা দরকার। স্বাধ্যায় হতে সাধনা আসে। সাধনা হল কতগুলো নিয়ম মেনে চলা, পবিত্র ও ধার্মিক জীবনযাপন করা। ভক্তিভাবে ভক্ত হয়ে ওঠা। আর ভক্ত সেই - যে স্বাধ্যায় ও সাধনার মাধ্যমে আত্মা হতে পরমাত্মার মিলনে আকাঙ্ক্ষিত হয়; অনুসন্ধানী হয়ে ওঠে। ব্রহ্মসূত্রে একেই 'ব্রহ্মজিজ্ঞাসা' বলা হয়েছে।
গীতাতেও শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
"অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ।
অহমাদিশ্চ মধ্যঞ্চ ভূতানামান্ত এব চ।"
অর্থাৎ, তিনিই হলেন সেই আত্মা যা সকল জীবের মধ্যে বর্তমান, এই আত্মা ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই।
তাহলে এই সত্যে আমরা উপনীত হতে পারি, এ দেহ শুধুমাত্র দৃশ্যমান শরীররূপ সাকার বস্তু নয়। আমরা আসলে সেই পরমাত্মার এক এক অংশ যা অভিন্নরূপে ভিন্ন দেহ ধারণ করে থাকে।
ব্রহ্মজ্ঞান হতেই আত্মা-পরমাত্মা সম্পর্কিত জ্ঞান লাভ হয় যা চুরাশি হাজার যোনির চক্রব্যূহে জন্ম-মৃত্যুর যন্ত্রণার থেকে মুক্তির পথ দেখায়।
বিষয় সাপেক্ষে এক অনন্য সাধারণ উদাহরণের আলোকপাত এখানে -
হনুমান একবার শ্রীরামচন্দ্রের কাছে প্রশ্ন রাখেন যে - তিনি আসলে কে? আবার শ্রীরামচন্দ্র হনুমানকে জিজ্ঞাসা করেন - তিনিই বা কে?
এই প্রশ্নের উত্তর হনুমান নিজেই দিয়েছিলেন - তাঁর প্রভু শ্রীরামচন্দ্র হলেন সেই পরমাত্মা আর তিনি হলেন সেই পরমাত্মার এক অংশ; প্রভু শ্রীরামচন্দ্র হলেন সমগ্র বিশ্বব্যাপী দাবানল আর সেই প্রজ্জ্বলিত দাবানলের একটি শিখা হলেন হনুমান স্বয়ং।
এক অপূর্ব ব্যাখ্যা এক অপূর্ব উপলব্ধি। এই উপলব্ধিতেই হয়তো হনুমান তাঁর বক্ষ চিরে রাম-সীতাকে দেখাতে পেরেছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন ব্রহ্মজ্ঞানী, সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত। তিনি শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক চেতনার অধিকারী ছিলেন। নিজেকে উপলব্ধি করা হল শ্রেষ্ঠতম প্রাপ্তি যা হনুমানের হয়েছিল। তিনি নিজেকে তাঁর প্রভুর দাস রূপেই চিহ্নিত করেছিলেন। ব্রহ্মজ্ঞান থেকেই এই চেতনা সম্ভব। বেদ-বেদান্ত হতেই আমাদের এই ধরনের ধ্যানধারণা হয়। বেদান্ত যার অর্থ 'জ্ঞান' সেই তো আমাদের পথপ্রদর্শক রূপে ব্রহ্মজ্ঞানের পথে চালিত করে। "অহং ব্রহ্মাস্মি" আমিই সেই ব্রহ্ম - তত্ত্বজ্ঞান ছাড়া একথা জানা বোঝা কি সম্ভব?
বস্তুত এই জগতের সব কিছুই তো ব্রহ্মেরই অভিক্ষেপ।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।