গল্প ও অণুগল্প

ফার্স্ট প্রাইজ



অভিজিৎ রায়


গোরাবাজারের ঝুপসি দোকানগুলোর মাথায় সন্ধ্যে নেমে আসছে খুব তাড়াতাড়ি। হিরণ তার দোকানের ভেতর অন্ধকারেই বসে ছিল। রিংকা নামে একটি মেয়ে তার দোকানে জেরক্স মেশিন চালায়। সে কাছাকাছি কোথায় যেন গিয়েছে। সে এসে আলো জ্বালাবেখন। দিনের আলো ধরে রাখার কোনো মন্ত্র হিরণের জানা নেই। তবু সে প্রাণপণে অলৌকিকের প্রার্থনা করছিল। কার কাছে, তা অবশ্য হিরণ জানে না। ভগবান-টগবান মোটেই মানে না হিরণ। তবু যদি সময়টা সত্যিই পেছিয়ে দেওয়া যায়। সন্ধ্যের পরেই আবার একটা রাত। দোকান গুটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে আজও যদি রঞ্জিতের দোকানের টাকাটা মিটিয়ে জিনিসগুলো বাড়ি নিয়ে যেতে না পারে, তাহলে সীমা সত্যিই দুঃখ পাবে। বেচারির শখের জিনিস। আশা করে আছে দু'দিন ধরে।

সীমার মুখটা খুব আলো-আলো। এমন সুন্দর বিকেলে সীমা একলা কী করছে? ভাবতেই মনটা কেমন আনচান করে উঠল হিরণের। সীমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে মাসছয়েক। বিয়ের সময় হিরণের মা ক্যান্সারে শয্যাশায়ী। মরার আগে ছেলের বৌয়ের মুখ দেখতে চেয়েছিল। মুমূর্ষু রুগির চিকিৎসা আর বিয়ের খরচ একসঙ্গে জোটাতে মাথাখারাপ হয়ে গিয়েছিল হিরণের। তার এই ছোট্ট দোকানের আয়ে আর কত হবে? যৎসামান্য যা ছিল, সবই বেরিয়ে গেছে। বিয়ের পরে মা বেঁচে ছিল মাত্র দু'মাস। বন্যার জল সরে গেলে যেমন ঘোলা পাঁক পড়ে থাকে, তেমনই এখন একগলা ধারে ডুবে দাঁড়িয়ে রয়েছে হিরণ। কিন্তু এতদিন পর এখন রাতগুলিতে সবে পাতালপুরীর রাজকন্যার মতো জেগে উঠতে শুরু করেছে সীমা। হিরণকে সে সারারাত ধরে বেড়াতে নিয়ে যায় অতল জলের গহন সমুদ্রপুরীতে, লুকোচুরি খেলে রঙিন প্রবাল দ্বীপে। শেষ পর্যন্ত সে হয়ে যায় নীল জলের এক আদি অন্তহীন সুড়ঙ্গ। তার ভেতরে সাঁতরে চলে হিরণ। সোনালি আলোর ছায়া মায়াবি কাঁপন তোলে গুহার দেওয়ালে। হিরণ শুনতে পায় সে বলছে, আমাকে কেমন দেখতে বল না? তার শরীরের লোনা জলে আপাদমস্তক ডুবতে ডুবতে শ্বাসরুদ্ধ স্বরে হিরণ বলে, সুন্দর... সুন্দর ওঃ, কী নরম তুমি... তুমি একটা জলকন্যা... সীমা আশ্লেষ জড়ানো গলায় প্রথমে বলে ওঠে - কী? কী বললে? তারপর বুঝতে পেরে বলে, আমার সবুজ আইলাইনারটা আসুক, দেখবে, ওটা লাগালে সত্যিকারের জলকন্যার মতো লাগবে আমাকে... আমি তোমার মারমেড? সত্যিই?

একটা ঝটকা দিয়ে টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল হিরণ। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ের তত্ত্বে আসা সব সাজগোজের জিনিস ফুরিয়ে এসেছে সীমার। তাই যেগুলো আনতে দিয়েছিল, সেগুলোর দাম হয়েছে সব মিলিয়ে প্রায় বারোশো টাকা। রঞ্জিতের দোকানে কাল থেকে পড়ে আছে জিনিসগুলো। দোকানের আলো জ্বেলে হিরণ কাউন্টার টেবিল থেকে বেরিয়ে এল বাইরে। এখুনি তার চা খেতে ইচ্ছে করছে খুব। মাথা ভার ভার লাগছে। রিংকা নিশ্চয়ই এসে যাবে একটু পরেই। সন্ধ্যের পর তার দোকানের ভিড় পাতলা হতে শুরু করে। কয়েকটা জেরক্স হতে পারে বড়জোর। পেন পেনসিল, দু-একটা বইপত্র, নোটের খাতা বা চ্যানেল ফাইলও বিক্রি হতে পারে। স্ক্যানার-প্রিণ্টারের কাজ হিরণই করে। কিন্তু হিরণ ভালোই জানে, তার সারাদিনের বিক্রির টাকা থেকে পাইকারি বাজারের রোজকার টাকা মিটিয়ে যা থাকবে, তাতে আর যাই হোক, বারোশোটা টাকা সে আজ খরচা করতে পারবে না। মাসকাবারি মুদি দোকানের ধার শুধে ক'টা ডিম আলু আর সরষের তেলের প্যাকেট নিয়ে যেতে হলে হাতে হয়তো আর শ-তিনেক টাকা থাকবে। সীমা রান্নাবান্না এখনো পারে না তেমন। একটু ডিমের ঝোল-ভাত অন্তত না খাইয়ে নতুন বৌকে সে রাখেই বা কী করে? হিরণ আস্তে আস্তে এসে দাঁড়াল বাইরের রাস্তায়। একটু দূরেই বাচ্চুর চায়ের দোকান। হিরণ পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে।

- "তোমার দোকানে আর আড্ডা মারতে বসা যাবে না হিরণ। জায়গাটার পরিবেশটাই তুমি নষ্ট করে দিলে - চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন পরিতোষবাবু।"

হিরণও হাতে চায়ের খুরি নিয়ে চুমুক দিচ্ছিল। পরিতোষবাবু দেশবন্ধু বয়েজের অঙ্কের টিচার। মাঝবয়েসি মানুষ। টিউশনে প্রচুর ছাত্র পড়ান। ওঁনার অঙ্কের নোটবুকের খুব কাটতি বাজারে। বইটা হিরণকেই করতে দিচ্ছেন এখনো। বিকেলের দিকে প্রায়ই আসেন তার দোকানে। চা খান। বই বিক্রির খবর নেন। আরও দু-একজনকে জুটিয়ে আনেন মাঝেমধ্যে। তাদের নোটবুকও করে দেয় হিরণ। দেশবন্ধু বয়েজের প্রশ্নপত্রও তৈরি হয় হিরণের এখান থেকেই। এসব করেই চলে যাচ্ছে তার কোনোমতে। পরিতোষবাবুর কথায় সে মুখ তুলে তাকিয়ে আহত স্বরে বলল, "আমি?"

- "এত কী অভাব পড়ল যে ঐ অকালকুষ্মাণ্ড রতনকে পাশের দোকানটা বিক্রি করে দিতে হল?" খানিকটা ঠাট্টার সুরে বললেন পরিতোষবাবু, জায়গাটার কী অবস্থা হবে ভেবেছ? সকাল-সন্ধ্যে গাঁকগাঁক করে লাউডস্পিকার বাজাবে - উটকো লোকের ভিড়... এসব ব্যবসা খুব রিস্কি বুঝলে? একটা বড় ঢোক গিলে নিয়ে ভারিক্কি চালে বললেন পরিতোষবাবু - জুয়া খেলাই বলতে পার একরকম। কবে দেখবে মারামারি বেধেছে - পুলিশ-টুলিশ... ঐ দেখ - শেষ কথাটা একটু রাগের সুরেই বললেন পরিতোষ। কারণ রতনের দোকানের সামনে রাখা সাউন্ড বক্সটা হঠাৎ কড়কড় করে উঠল। হিরণও সেদিকেই তাকিয়েছিল। বাবা বেঁচে থাকতে পাশাপাশি দুটো দোকানঘর কিনেছিল তারা। তারপর বাবার আচমকা স্ট্রোক। চার মাসের প্যারালিসিস। বাবা চলে গেল, মা পড়ল বিছানায়। তবুও দোকানটা রেখে দিয়েছিল হিরণ। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। বাজারে তার দেনা আকাশছোঁয়া। হিরণ আস্তে আস্তে বলল, "স্যার আপনি বুঝবেন কী না জানি না। আমাদের ব্যবসা একেবারে মরে গেছে। সরকার আজকাল টেক্সট বই বিলি করছে। স্কুলের অনুষ্ঠানে এখন তো আর বই দেওয়ার চল নেই স্যার। আপনারাও তো স্টিলের বাটি, ব্যাগ, ওয়াটার বট্‌ল লাঞ্চ বক্স - এইসবই দিচ্ছেন। কী করে পেট চালাব বলুন তো। শুধু নোটবুক বিক্রির টাকা ক'টাই যা পাই।"

পরিতোষবাবু ঠোঁটটা একটু কুঁচকে বললেন, "কেন? নোটবুক বিক্রিতেই তো লাভ হিরণ। পঞ্চাশ পারসেন্ট কমিশন!"

চা'টুকু শেষ করে হিরণ ছোট্ট করে বলল, "আসি।" আসলে তার খোলসা করে বলার উপায় নেই যে, পরিতোষবাবুদের মতো মাস্টারমশাইয়ের পিছনে কত টাকা ঢাললে কত টাকার বিক্রি হয়। তার ঠিক পাশে রতনের দোকানটা আজ খুব সুন্দরভাবে ফুল দিয়ে সাজানো। সেখানে হৈচৈ হচ্ছে খুব। সাদা বড় আর্ট পেপারে মস্ত লেখা ঝুলছে - এ সপ্তাহের রাজ্য লটারির দ্বিতীয় পুরস্কার আমাদের টিকিটেই। হিরণকে দেখে একটা টুল এগিয়ে দিল রতন। হেসে বলল, "আসুন দাদা। চা খাবেন তো?"

দোকানের মেয়েটি এসে গেছে। ঘাড় নেড়ে বসে পড়ল হিরণ। লটারির এই ঝলমলে দোকানের লাভের পরিমাণ যদি রতনের জীবনকেও আলোকিত করতে পারে, তবে এই ঝুঁকির জীবনটাই কি হিরণের ধারবাকির জীবনের থেকে শতগুণে ভালো নয়? আজ রাতে সীমার সামনে সে কোন মুখে দাঁড়াবে তা হিরণ বুঝতে পারছে না। রতনের কাছেই একটা প্রাইজ চেয়ে নেওয়া যায় না? হাজার খানেক টাকা তো রতন অনায়াসেই দিতে পারে তাকে?

ভিড় হালকা হলে রতন চা আনালো। গল্প জুড়ল হিরণের সঙ্গে। হিরণ একটু অস্বস্তির সুরে বলল, "এই যে প্রাইজ পেলে, তা... তোমার এক্সট্রা কিছু আছে নাকি?"

রতন হাসিমুখে স্থিরভাবে চেয়ে রইল হিরণের দিকে। হিরণের ভেতরে অস্বস্তিটা বেড়ে গেল হঠাৎ। রতন যেন খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছে হিরণের মনের ভেতরটা। এই দোকানঘরটা এতবছর হিরণেরই ছিল। বিক্রি করার পর আজ সেই হিরণই যে রতনের কাছে হাজার টাকা ধার করতে চায়, তা জানতে পারলে রতন তাকে কী ভাববে? সে আর রতন - দুজনেই দেশবন্ধু স্কুলের ছাত্র। হিরণ বেশ ভালো ছিল পড়াশুনোয়। আর নিচু ক্লাসের রতন ফেল করতে করতে আরো নিচে চলে গিয়েছিল। পরিতোষ স্যার ওকে বলতেন অকালকুষ্মাণ্ড। আজ সেই রতনের কাছেই ফেল করে গেছে হিরণ।

রতন মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বলল, "সে তো দাদা আছেই। তারপর - সুবিধে হল - কাস্টমারের ভিড় বেড়ে যায়। দোকানের গুডউইল বাড়ে।"

হিরণ চায়ের গ্লাসটা নামিয়ে রাখল। রতনের কাছে টাকা চাইতে সে এখনই পারবে না। একখানা সোনার হার মরণ অব্দি মায়ের গলায় ছিল বলে সেটা বেঁচে গেছে। স্বর্ণশ্রী জুয়েলারিতে সেটা বাঁধা রেখে কাল যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়।

পরদিন দুপুরে খেয়ে এসে দোকান খুলছিল হিরণ। নামেই দুপুরের খাওয়া। এখন বিকেল চারটে বেজে গেছে। ওবেলাটা দোকানে কাজ বেশি থাকে বলে প্রায়ই তার খেতে দেরি হয়ে যায়। রতনের দোকানে এখনো বেশ ভিড় আছে। হিরণের অবশ্য নিশ্চিন্ত লাগছে একটু। গতকাল রাতে সোনার হারটা হিরণ খুঁজে বার করেছিল ঠিকই। এখন সেটা দেখতে হয়ে গেছে পিতলের মতো। কটা টাকাই বা পাওয়া যেত সেটা দিয়ে তা হিরণ বুঝতে পারেনি। তার মুখের ভাব দেখে সীমা অবাকভাবে জিজ্ঞেস করেছিল, "ওটা নিয়ে আবার কী করবে? মায়ের একটাই তো মোটে স্মৃতি।"

কিছুক্ষণ চুপ করে সীমাকে দেখছিল হিরণ। এই মেয়েটির কাছে তার কোনো আড়াল নেই। আপাদমস্তক নগ্ন শরীরে তারা দুজনে চূড়ান্ত বিশ্বাসের খেলা খেলে। হিরণ যে আসলে একটা ফেল করা মানুষ, রতনের কাছেও ফেল - এই সত্যিটা মনের অন্তরালে রেখে সে সীমার বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারবে না। নিজের ওপরেই কেমন যেন ক্রোধ হয়েছিল তার। রতনের কাছে টাকা ধার চাইতে পারেনি। স্ত্রীর কাছ থেকেই বা ভালোবাসা ধার চাইবে কেন? কেউ ধার দেয় না। সীমাই বা দেবে কেন? হিরণের ভেতর থেকে বমির মতো দমকে দমকে বেরিয়ে এসেছিল সব সত্যি।

সীমা আরও অবাকভাবে বলেছিল, "তাই তুমি মায়ের হারটা বাঁধা দিতে যাচ্ছ আমার কাজল-নেলপালিশ কিনতে? হে ভগবান! তুমি কী করে এরকম ভাবলে গো?"

তারপর আবার নীল জলের সুড়ঙ্গে সাঁতার কাটতে ডেকেছিল সীমা। লটারির ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়া মানুষের মতোই হিরণ তার সব বিত্ত নিয়ে দু'হাতে ছড়িয়ে, তার মধ্যে ডুব দিয়ে তোলপাড় করেও ঐশ্বর্যের শেষ দেখতে পায়নি। সীমা বলেছে, সবুজ কাজল ছাড়াই সীমা মারমেড। হিরণের জলকন্যা।

রতনের দোকানের শাটার নামানোর শব্দে চমকে তাকাল হিরণ। রতন কেমন যেন মনখারাপের হাসি হাসল তার দিকে তাকিয়ে। খুব অবাক হয়ে হিরণ বলল, "কী ব্যাপার? দোকান বন্ধ করে দিলে?"

রতন সামান্য দোনামনা করল যেন। তারপর কাছে এসে কাউন্টারের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে চাপা সুরে বলল, "হাজার পাঁচেক টাকা হবে দাদা? পরশুই দিয়ে দেব।"

হতভম্ব হিরণ শুধু পুনরাবৃত্তি করল, "পাঁচ হাজার টাকা?"

রতন হতাশভাবে বলল, "মহাজনের টাকা মেটাতে পারিনি বলে টিকিট দেয়নি বেশি। মাল পড়ে আছে মহাজনের ঘরে। টাকাটা পেলে..."

হিরণ অবিশ্বাসের সুরে বলল, "তুমি যে আজও পুরস্কার পেয়েছ দেখলাম। এতগুলো টাকা কী করলে?"

রতন হেসে ফেলল। আরও গলা নামিয়ে করুণভাবে বলল, "ওরকম ফার্স্ট প্রাইজের বোর্ড সব লটারির দোকানেই ঝোলে দাদা। ওগুলো না ঝোলালে টিকিট বিক্রি হবে কেন?"

দারুণ অবাকভাবে হিরণ বলল, "আমি টাকা কোথায় পাব ভাই? দোকানটাই বিক্রি করে দিলাম লোন শোধ করতে। আমার নিজেরই..." বলেই চুপ করে গেল সে। একটা নিঃস্ব মানুষের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে বেচারি রতন। কাল রাতে এই লোকটাকেই গুপ্তধনের মালিক মনে হয়েছিল তার। আপন মনেই হাসল হিরণ। ফার্স্ট প্রাইজের বোর্ডের আড়ালে সকলেরই আসলে ধারের জীবন। আজ হিরণ যদি ধার করতেই চায় তবে নাহয় রঞ্জিতের কাছেই করবে। রঞ্জিত আবার কোথায় কার কাছে ধার নিয়েছে কে জানে। শুধু এই সব নকল ফার্স্ট প্রাইজের আড়ালে হিরণ কাল রাতে সত্যিকারের একটা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে ভেবে নতুন করে আনন্দে ভরে গেল হিরণের বুক।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।