আজ সকাল থেকেই পর্ণার মনটা ফুরফুরে। কখন থেকে আলমারি খুলে দাঁড়িয়ে আছে ও। কোনটা পরবে বুঝে উঠতে পারছে না। গুন গুন করে গেয়ে চলেছে কতরকম সুর। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, আধুনিক।
ডাইনিং থেকে ধপ কোনো আওয়াজ হলো একটা। পর্ণা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর মাথা নেড়ে মনে মনে বললো, না আজ কোনোদিকে কান দেবে না ও!
পুরো বছরটা ও-ই সামলায় সব! বাড়ি, বাজার, ছেলের স্কুল, বরের অফিস, পাম্প খারাপের খবর, গিজারে জল না ওঠার কারণ, জল ফিল্টার না হওয়ার কারণ মানে সংসারের সব হিসেব শুধু পর্ণার কাছেই থাকে।
সৌরভ শুধু ঘটা করে বলে, "সত্যি পর্ণা না থাকলে আমি অফিসে এতো মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারতাম না!" পর্ণা যেন ওটুকুতেই খুশি। ভীষণ ভালো লাগতো! কোনো জায়গা তো আছে যেখানে শুধু ওরই আধিপত্য! ভাবনাটা এমনই থাকতো যদি না গত পরশু বাজার করতে গিয়ে ইন্দ্রানীদির সাথে দেখা হতো!
"আমাকে তিন কেজি আলু আর এক কেজি পেঁয়াজ দেবেন!" - ভিড়ের মধ্যে মুখ বাড়িয়ে বলেই একটু পাশে এসে দাঁড়ালো পর্ণা। বাড়িতে বাড়ন্ত আলু পেঁয়াজের ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত পড়েছিল পর্ণার। পরের দিন সৌরভকে কি দিয়ে অফিস যাওয়ার আগে খেতে দেবে বুঝেই উঠতে পারছিলো না। খারাপও লাগছিলো এটা ভেবে যে কি করে খেয়াল করলো না পর্ণা, এতো বেখেয়াল হলে তো মুশকিল! সৌরভ সদ্য তখন অফিস থেকে ফিরেছিল। এক কাপ চা আর একমাত্র ছেলে বোতামকে ওর কাছে দিয়ে চলে গেছিলো সামনের ছোট্ট বাজারটায়।
"সখী ভাবনা কাহারে বলে?/ সখী যাতনা কাহারে বলে?..." - পর্ণা শুনলো একটু দূর থেকে ভেসে আসছে গানটা। সামনেই ছোট্ট স্টেজ করে গানটা কেউ গাইছেন। আর সামনে বসে আছে হাতে গোনা সাত-আট জন। কেউ ঝিমোচ্ছে, কেউ মোবাইলে চোখ রেখে আঙ্গুল দিয়ে স্ক্রিন ওপর-নীচ করছে।
এভাবেই পালন হচ্ছে বিজয়া সম্মেলন। আলুর দোকানে তখন উপচে পড়া ভিড়। তাই পায়ে পায়ে এগোলো পর্ণা! আজকাল গানের সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু পর্ণাকে বড্ড টানে এই গান। গানটা শুনেই পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো ও। কাঠ আর লোহার একটা তক্তা পেতে ছোট করে বিজয়া সম্মেলনী পালন হচ্ছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ইনিই শেষ শিল্পী। বাচ্চারা যতক্ষণ নাচ আবৃত্তি করছিলো ততক্ষণ ভিড় ছিল হয়তো।
পর্ণা এগিয়ে দেখলো মঞ্চে গান গাইছেন ইন্দ্রানীদি। ইন্দ্রানীদি-ই এই এলাকার একমাত্র গানের মানুষ। বড় ছোট যে কোনো প্রোগ্রামে শেষ পাতে একটা স্পঞ্জের রসগোল্লার মতো এই ইন্দ্রানীদি।
ইন্দ্রানীদিকে দেখেই মঞ্চের একদম সামনে এসে গলা মিলিয়েছিল পর্ণা সেদিন -
"ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে,/ জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,/ হাসিতে হাসিতে অলোকসাগরে/ আকাশের তারা তেয়াগে কায়?"
ইন্দ্রানীদির চোখদুটো যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠলো পর্ণাকে দেখে। আরও প্রাণ খুলে গেয়ে চলেছেন দিদি। সাথে পর্ণাও।
"যান না বৌদি মঞ্চে উঠে যান। দিদি বোধহয় চেনে আপনাকে, একসাথে গান!" - কমিটিরই কেউ একজন বললেন। ওদিক থেকে ইশারা করে ডাকছেন ইন্দ্রানীদি। এই ডাকটা এমন যে পর্ণা উপেক্ষা করতে পারেনা কোনোভাবেই। তাই তো দূর থেকে দেখলে পালিয়ে বেড়াতো এতকাল!
ইশশ, আজ যে কেন দূর থেকে দিদিকে চিনতে পারলো না! তাহলে আসতোই না। গাইতে গাইতেই ইন্দ্রানী বললেন, "পর্ণা স্টেজে উঠে আয়!" আর পারলো না পর্ণা।
গাইতে গাইতেই উঠলো -
"আমার মতন সখী কে আছে?/ আয় সখী, আয় আমার কাছে -/ সুখী হৃদয়ের সুখের গান/ শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ..."
ভুলে গেছিলো পর্ণা বাড়িতে সৌরভ অফিস থেকে এসেছে। ওকে রুটি দিতে হবে। তিন বছরের বোতামের রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেল! ভুলে গেল বাজারের মাঝে এই প্রোগ্রাম চলছে। সৌরভের বন্ধুরা যদি বলে দেয়! কিচ্ছু মাথায় নেই পর্ণার। ও গেয়ে চলেছে -
"প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল/ একদিন নয় হাসিবি তোরা -/ একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া/ সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা..."
আবার ডাইনিংয়ে আওয়াজ, সাথে সাথে কাঁচ ভাঙার শব্দ। "গেল গেল! ভাঙলি তো গ্লাসটা! বিচ্ছিরি স্বভাব হয়েছে ছেলেটার। মেরে হাত ভেঙে দিতে হয়!" সৌরভের চিৎকারে আরও দ্বিগুণ চিৎকার বোতামের।
ইচ্ছে হচ্ছে পর্ণার দৌড়ে যায় গিয়ে সামলে নেয় পরিস্থিতিটা। আবার দু'দন্ড ভাবলো পর্ণা।
"এখনও কত সুন্দর গলা!" সেদিন গানের শেষে বলেছিলেন ইন্দ্রানীদি। পর্ণাও যেন গর্বের সঙ্গে বলেছিলো, "না গো দিদি ছেলের পিছনে চিৎকার করে করে গলায় আর কিচ্ছু নেই!"
অহংকারী মনে হচ্ছিলো পর্ণার নিজেকে। স্বামী, সংসার ছেলে, এসব নিয়ে আজ ও পরিপূর্ণ! একটা মেয়ের জীবনে কি আছে আর!
"পর্ণা, মেয়েটার আমার বিয়ে হয়ে গেল। তোর দাদা তো আজ দীঘা কাল পুরী করেই যাচ্ছে। আর দোষ কি! ট্রাভেল এজেন্সির বিজনেস। বন্ধ ঘরে দমবন্ধ লাগে। বেঁচে আছি এই সুর নিয়ে। ভাগ্যিস তোর মতো সুরকে ছেড়ে দিইনি। পর্ণা রে জীবনে সবাই ছেড়ে যাবে, শুধু থেকে যাবে এই ভালোবাসাগুলোই!"
থমকে গেছিলো পর্ণা। কিসের অহংকার! কিসের গর্ব। সত্যি তো ভাত রুটির রোজকার জীবন থেকে কি পেলো ও! শুধু সৌরভের মন ভরানো প্রশংসা!
আবার একটা আওয়াজ বাইরে। সাথে সাথে সৌরভের চিৎকার আর বোতামের কান্না। কিচ্ছু এলো গেল না পর্ণার। ও খুব যত্ন করে শাড়ির কুচিগুলো গোছাচ্ছে।
"শনিবার সাতটায় বড়োদের ক্লাস করাই, পারলে চলে আসিস!" এটুকুই বলে সেদিন চলে গেছিলেন ইন্দ্রানীদি।
খুব অভিমান হয়েছে বেশ বুঝতে পারে পর্ণা। সারেগামা তো দিদিই চিনিয়েছেন পর্ণাকে। ধরে ধরে গলায় সুর বসিয়েছেন। তারপর যখন পর্ণা ফোন করে বললো, "দিদি আমি আর গান শিখবো না!" অভিমান তো হওয়ারই কথা! পর্ণা ভেবেছিলো বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি যখন কাছাকাছি তখন গানটা ও করবেই! কিন্তু নতুন সংসারের চাপে সব গোলমাল হয়ে গেল।
"কি করছো বলোতো তুমি! কোথায় যাবে বললে! এখনও বেরোলে না! তোমার এই দস্যি ছেলের সাথে আমি পারি?" এক বুক নালিশ নিয়ে সৌরভ ঘরে ঢুকলো। পর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো "আমার ছেলে মানে? ওকে কি ওই বাড়ি থেকে তত্ত্বে সাজিয়ে পাঠিয়েছিল?"
এটুকু বলেই যত্ন করে লিপস্টিকটা লাগালো পর্ণা। আজ আবার ও ওর ভালোবাসার কাছে যাচ্ছে। এটুকু যত্নের প্রয়োজন আছে বৈকি!
"এতো সেজেছ? যাচ্ছ কোথায় সেটা তো বলো!" - সৌরভের গলায় বিরক্তি। পর্ণা গায়ে চন্দনের আতরটা ছড়িয়ে বললো "গানের স্কুলে, ইন্দ্রানীদির বাড়িতে!"
সৌরভ হুঙ্কারের সুরে বললো, "আবার ক্ষেপেছ? সেদিন পাড়ার মোড়ে গান গেয়েছো শুনেই জানতাম আবার পাগলামি শুরু হবে! পর্ণা, ছেলেটা ছোটো, সাথে প্রচন্ড দুষ্টু। এখন তোমায় এসব মানায় না!"
"কখন মানায় সৌরভ? ছেলেটার দায়িত্ব সবসময় নিচ্ছি, সংসারের দায়িত্ব নিচ্ছি, পুরো সপ্তাহে ঘন্টা দুয়েক সময় নিজের পাওয়ার অধিকার নেই? আমিও তো চাকরি করতে পারতাম! ইনকাম করতাম, বাইরে যেতাম। অফিস পার্টি করে এসে বাড়ির ভাত ঢুকিয়ে রাখতে পারতাম কিন্তু করিনি। ভুল করেছি কিন্তু আর না! ঘন্টা দুয়েক সময় আমার নিজের জন্য প্রাপ্য!"
কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে আর দাঁড়ালো না পর্ণা। ব্যাগটা কাঁধে নিলো। এল.আই.সি. থেকে পাওয়া নতুন ডায়েরিটা হাতে নিয়েই বাইরে বেরিয়ে এলো! কারণ ওটা ব্যাগে ঢোকাতে গেলে যে দু'মিনিট সময় লাগতো তাতে সৌরভের দুটো কথা কানে আসতো। কিছুই হতো না কিন্তু সুরে ব্যাঘাত ঘটতো পর্ণার।
এমনিতেই অনেক ঘটেছে আর ও চায়না। এবার থেকে ও গান নিয়েই বাঁচবে। ছেলে, সংসার সামলেও গান সামলানো যায়, জীবনে সুর ধরে রাখা যায়! ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।
আজ মনটা বেশ ফুরফুরে পর্ণার। সব কিছু খুব ভালো লাগছে। নিজেকে মনে হচ্ছে একটা প্রজাপতির মত, যার পাখায় পাখায় রঙ। গুনগুন করে উঠলো পর্ণা।
"এ গানে প্রজাপতি পাখায় পাখায় রং ছড়ায়..."
কি ভাবছেন গল্পটা আপনার! আপনি হয়তো সুরে নয়, তালে আছেন বা তুলিতে! থুড়ি ছিলেন। ভাবছেন কেন? আবার শুরু থেকে শুরু হোক। মানে বদলে যাক জীবনের রঙ। দেখবেন আপনারও নিজেকে রঙচঙে এক প্রজাপতি মনে হবে! যার পাখায় পাখায় রঙ। এই রঙ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিন।
চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।