গল্প ও অণুগল্প

আননোন নাম্বার



মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি


কণিকা তার মোবাইলের রিংটোনে খুব সুন্দর একটা বাংলা আধুনিক গান সেট করেছে। ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’ - গেট ঠেলে সবে বাইরের রাস্তায় পা রেখেছে ঠিক তখনই গানটা বেজে উঠল। কণিকা হাঁটতে হাঁটতে কাঁধের ব্যাগের চেন টেনে মোবাইলটা বের করতে গেল। রিংটোনটা পুরো বাজল না, একটুখানি বেজেই বন্ধ। অর্থাত্‍ মিসড্ কল। স্বাভাবিকভাবেই নাম্বারটাকে বিশেষ পাত্তা দিল না কণিকা। ফোনটাকে যথারীতি ব্যাগের ভিতর রেখে দিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। মেঠোপথ ধরে কিছুটা গেলে তবে পাকা রাস্তা। সেখানে গিয়ে সে বাস ধরবে। এ বাসটা ফেল করলে অনেক ভোগান্তি আছে। স্কুলে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। নতুন চাকরি, তাই সে দেরি করতে চায় না।

স্কুলে পৌঁছেই হাজিরা খাতায় সই করে দিনের প্রথম ক্লাসটা নিতে গেল কণিকা। দরজা ঠেলে ক্লাসে ঢুকতে যাবে আবার মোবাইলটা বেজে উঠল। একইভাবে বন্ধও হয়ে গেল। আবার মিসড্ কল। কণিকা লক্ষ্য করল ঘর থেকে বেরনোর সময় যে নাম্বার থেকে ফোনটা এসেছিল সেই একই নাম্বারের মিসড্ কল এবারেরটাও। কিছুটা বিরক্ত হয়ে ফোনের সুইচটা বন্ধ করে ক্লাসটা নিল কণিকা। বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় বাস থেকে নামছে আবারও মোবাইলে গান। আগের মতোই কিছুটা বেজেই বন্ধ। সেই একই নাম্বার থেকে মিসড্ কল। ফোনটা তো বেশ জ্বালাচ্ছে কণিকাকে। বিরক্তিভরা মন নিয়ে ঘরে ঢুকল সে। স্কুলের পোশাক ছাড়ছে আবারও মোবাইলের গানটা বেজে উঠল - ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’। না, এবার আর মিসড্ কল নয়। মিসড্ কল দেখে দেখে নাম্বারটা প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে কণিকার। আজ সকাল থেকে যে নাম্বারটা তাকে জ্ব্বালিয়ে মারছে সেই নাম্বার থেকেই ফোনটা এসেছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে মোবাইলটা রিসিভ করল কণিকা।

ও প্রান্ত থেকে ‘হ্যালো’ শব্দটা কানে আসতেই উত্তেজনায় ফেটে পড়ল কণিকা। রীতিমতো ধমক দিয়ে বলে উঠল - "কী ব্যাপার? কে আপনি? সকাল থেকে ঘন ঘন মিসড্ কল করছেন কেন? আপনার কী কাজকর্ম কিছু নেই?" কণিকা বেশ বিরক্ত।

কিন্তু যে ফোন করেছে সে যথেষ্টই শান্ত, নির্বিকার। রাগ-তাপের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া তার মধ্যে নেই। শান্ত গলাতেই জানতে চাইল - "ম্যাডাম, এটা কোন জায়গা?"

- "সেটা জেনে আপনার লাভ কী?"

- "না মানে, জানতে খুব ইচ্ছে করছে তো।"

- "জানতে খুব ইচ্ছে করছে - না? গালে দুটো কষে চড় মারলে তবে বুঝতে পারবেন। ফোনে মেয়েদের পিছনে লাগাটা বের করে দেব।"

- "আহা ম্যাডাম, এত চটে যাচ্ছেন কেন?"

- "সকাল থেকে জ্বালাবেন, আর চটব না? তবে কী গদগদ হয়ে হেসেটেসে আপনার সঙ্গে গল্প করব?"

- "তা একটু-আধটু যদি গল্প করেই থাকেন কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে?"

কথাটা শুনে আরও চটে গেল কণিকা। বলল - "এই শুনুন, আর একবারও যদি এই নাম্বারে ফোন করেন না পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেব। এটা মনে থাকে যেন।"

- "ম্যাডামের দেখছি ভীষণ রাগ। তা যাক, এটা কোন জায়গা সেটা এখনো বললেন না তো।"

- "ক্ষীরপাই।" উত্তরটা দিয়েই ফোনটা কেটে দিল কণিকা। কে একটা কোথাকার অপরিচিত লোক তার সঙ্গে অত কথা বলবার দরকার কী তার?

।। ২ ।।

ভালোমতো পড়াশোনা করেই স্কুলের চাকরিটা পেয়েছে কণিকা। খুব করে খেটেছিল সে। তার ফলও পেয়েছে। ঘাটালের একটি স্কুলে বাংলার দিদিমনি সে। চাকরি পেলেও পড়াশোনার অভ্যাসটা এখনো যায়নি। রোজ সন্ধ্যায় বইপত্র নাড়াচাড়া করে, এটা সেটা পড়ে। পরের দিন ক্লাসে গিয়ে কি পড়াবে তারও একটা প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। যার ফলে অল্পদিনের মধ্যেই অনেকখানি সুনামও অর্জন করে ফেলেছে সে শিক্ষিকা হিসেবে। বিছানায় আয়েশ করে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে আজও সন্ধ্যায় একটা বই পড়ছিল কণিকা। কিন্তু বইয়ে তেমন মন বসাতে পারছিল না। বিকেলে ফোনে যে অপরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলেছিল তার কথা বারেবারেই মনের মধ্যে আসছিল। কণিকা ফোনে ভদ্রলোককে যাচ্ছেতাই করে কত কি বলে যাচ্ছিল অথচ ভদ্রলোকের তাতে কিছু এসে যায়নি। ভদ্রলোক বিন্দুমাত্র বিচলিত নন, একটুখানিও বিরক্তি প্রকাশ করেননি। মনে হ’ল তিনি যথেষ্টই সংযত ও শান্ত। আর ভদ্রলোকের গলাটাও কি মিষ্টি, সুন্দর ছিল। ফোনটা রাগে কেটে দিয়েছিল ঠিকই, তখনই এটাও মনে হয়েছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে আরও দু’টো কথা বললেই ভালো হ’ত। হতেও তো পারে ভদ্রলোক খাঁটি সজ্জন ব্যক্তি। কেন জানে না কণিকার মনে হ’ল ওই নম্বরে ভদ্রলোককে একবার রিং করলে কেমন হয়। পরক্ষনেই ভাবল, না এটা করা তার মোটেই ঠিক হবে না। এতে করে ভদ্রলোকই তো উল্টে তাকে অপমান করতে পারে।

ফোনের কথা ভুলে জোর করে বইয়ের পাতায় মন দেবার চেষ্টা করল কণিকা। একি! মন বসছে কই? হঠাত্‍-ই ঘরের আলোটা চলে গেল। যা... লোডশেডিং। আর ঠিক তখনই পুবের জানালা বেয়ে বেশ খানিকটা জ্যোত্‍স্নার আলো এসে কণিকার বিছানায় লুটোপুটি খেতে লাগল। জানালার বাইরে চোখ রেখে কণিকা দেখল আকাশে উঠেছে গোল পূর্ণিমার চাঁদ। তারই স্নিগ্ধ কিরণ ছটায় ভেসে যাচ্ছে সারা ভুবন। মাটির পৃথিবীটা এক আশ্চর্যরকম রমণীয় রূপ ধারণ করেছে। ভারি মিষ্টি লাগছে সন্ধ্যার এই মুহূর্তটাকে। কণিকা ভাবল - ইস, সে কবি হল না কেন! তাহলে তো এই মিষ্টি-মধুর ক্ষনটাকে সোনার শিকল দিয়ে না হোক শব্দের অক্ষর দিয়ে অন্তত বেঁধে রাখতে পারত। আবেগাপ্লুত হয়ে ভালোলাগার এক অলৌকিক স্রোতে ভেসে গেল কণিকা। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাসতে হ’ল না। আচমকা মোবাইলটা বেজে উঠেছে, গান বাজছে - ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’।

কণিকা দেখল সেই একই নাম্বারের ফোন। বিকেলেই যে ভদ্রলোককে যা তা বলে খুব ধমকে ছিল। লোকটার কী লজ্জা-শরম বলতে কিছু নেই? মনের মধ্যে ভদ্রলোকের প্রতি কিঞ্চিত্‍ ভালোলাগা সৃষ্টি হলেও সেটা প্রকাশ না করেই আগের মতো কড়া মেজাজে কণিকা প্রশ্ন করলো - "কী ব্যাপার বলুন তো আপনার? বলি, আপনি ভেবেছেনটা কী? বললাম না আমাকে আপনি আর ফোনে বিরক্ত করবেন ন। কথাটা কী কানে যায়নি আপনার? আপনি এমন নির্লজ্জ কেন? মান-অপমান বোধ বলতে কী আপনার কিছু নেই?"

ওপ্রান্তের কথা - "আপনিই যদি একনাগড়ে প্রশ্ন করে যান আমি কী উত্তর দিই বলুন তো? আমাকে তো একটুখানি সময় দিতে হবে নাকি? দেখুন ম্যাডাম, আমি কিন্তু আপনার উপর মোটেই বিরক্ত হইনি। যা বিরক্তি প্রকাশ করছেন আপনিই।"

কণিকা রাগে ফুঁসে উঠল - "কী বলতে চান আপনি? দেখুন আপনি আর আমায় বকাবেন না।"

ফোনে ভদ্রলোকের গলা এখন আরও মোলায়েম, ধীর-স্থির। বলল - "আপনি রাগ করছেন, আর আমার কিন্তু ভীষণ ভালো লাগছে আপনাকে।"

- "সে তো ভালো লাগবেই, ফোনে মেয়েদের পেলে কথা বলতে তো ভালো লাগবেই। ধড়িবাজ ছেলে কোথাকার।"

- "আবার বলুন কথাটা, ধড়িবাজ। আমার নামের আগে সুন্দর একটা উপমা বসিয়ে দিলেন তো!"

- "কী নাম আপনার?" আগের থেকে অনেকখানি রাগ কমিয়ে জিজ্ঞেস করল কণিকা।

- "আমি সন্দীপ। সন্দীপ মণ্ডল। তবু ভালো, শেষমেশ আমার নামটা জানতে চাইলেন।" বলে হেসে উঠলেন ফোনের ভদ্রলোক।

কণিকার মনে হ’ল সন্দীপের হাসিটাও কি চমত্‍কার!

।। ৩ ।।

এভাবেই ফোনালাপ থেকেই সন্দীপের সঙ্গে কণিকার পরিচয়। পরিচয় থেকে সম্পর্ক স্থাপন। তারপর সে সম্পর্ক একদিন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হ’ল। এখন রোজ সন্ধ্যায় নিয়ম করে সন্দীপের ফোন আসে। কণিকাও উত্‍কন্ঠায় থাকে ফোনটা পাবার জন্য। মিসড্ কল করার জন্য যে সন্দীপকে একদিন কণিকা রীতিমতো অপমান করেছিল সেই কণিকাই আজ সন্দীপের ফোন পাবার জন্য পাগল। সন্ধের পড়াশোনা তার ডকে উঠেছে। ফোনের কথামতো সন্দীপের সঙ্গে কণিকার দেখা হ’ল একদিন ক্ষীরপাই বাসস্ট্যান্ডে।

প্রথম দর্শনেই সন্দীপকে ভালো লেগে গেল কণিকার। সন্দীপের যে স্মার্ট হ্যাণ্ডসাম চেহারা সেটা মেয়েদের নজর কাড়ার পক্ষে যথেষ্ট। কণিকারও তাই হ’ল। একটা অজানা অচেনা ছেলেকে ভালোবেসে ফেলল। সন্দীপকে সে মন দিয়ে বসল। সন্দীপের মার্জিত কথাবার্তা, সুললিত ব্যবহার কণিকাকে যেন আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলল। কণিকা সেই বাঁধন কেটে বেরিয়ে আসা তো দূরের কথা আরও নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে পড়ল।

কথাপ্রসঙ্গে কণিকা জানতে পেরেছে - সন্দীপ বিরাট বড়লোক বাড়ির ছেলে। মেদিনীপুরে তাদের মস্তবড়ো এক মোবাইলের দোকান আছে। মোবাইলের হোলসেলার সে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বড়ো শহরে তাদের শাখা রয়েছে। আদি বাড়ি শিলিগুড়িতে, মাসে এক দু’বার যায়। মা-বাবাকে দেখে আসে। কোনোরকম সত্যতা যাচাই-এর ধারেপাশে গেল না কণিকা। সন্দীপের মুখের কথাকেই সম্পূর্ন বিশ্বাস করে বসল। সেই বিশ্বাসে ভর করেই কণিকা একদিন মেদিনীপুরে গেল সন্দীপের দোকান দেখতে। সন্দীপ মিথ্যে বলেনি। সত্যিই খুব বড়ো দোকান। দু’চারজন কর্মচারি কাজ করছে। হরেকরকম মোবাইলের সেট রয়েছে। কণিকা সন্দীপের দোকানে এসেছে প্রথমবারের মতো তাই সন্দীপ কণিকাকে একটা দামি মোবাইল সেট প্রেজেন্ট করল। উপহার পেয়ে কণিকা আরও খুশি।

এখন কণিকা সন্দীপের সঙ্গে প্রায়ই বেরিয়ে পড়ে। হেথায়-সেথায় ঘুরে। সন্দীপের জন্য দু’একদিন স্কুলে ফাঁকি দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। কণিকা একদিন বাবা-মাকে সন্দীপের কথাটা বলল। সন্দীপকে সে ভালোবাসে এটা জানাতেও ভুলল না।

কণিকার বাবা-মা ততখানি শিক্ষিত নন। তবে আধুনিক মনের মানুষ তারা। মেয়ের স্বাধীনতায় কখনো তারা বাধা দেননি। তাদের ধারনা তাদের মেয়ে নিশ্চয়ই যেমন তেমন ছেলেকে ভালোবাসবে না। অবশ্যই পছন্দের কারণ আছে সন্দীপকে। কণিকার বাবা-মাও একদিন গেল সন্দীপের দোকানটা দেখতে। সন্দীপ কণিকার বাবা-মাকে খুব যত্নআত্তি করল। এমন ব্যবহার আর আপ্যায়ন করল যে সন্দীপকে তারাও ভালো না বেসে পারল না। মেয়ের তাদের রুচি, পছন্দ আছে বলতে হবে। সন্দীপের সাথে মেয়ের বেশি মেলামেশাটাকে খারাপভাবে নিলেন না তারা। মনে মনে ভাবলেন - এই সন্দীপ তাদের জামাই হলে মন্দ হ’ত না।

সন্দীপও তার মনের কথা জানাল - কণিকাকে তার বিয়ে করতে আপত্তি নেই। আর আপত্তিই বা করবে কেন? কণিকাকে তো সে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে। তবে দু’চার মাস পরে সে বিয়ে করবে। তার শিলিগুড়ির বাড়িটা রঙ হচ্ছে, কিছুটা ভেঙে নতুন করে তৈরি হচ্ছে। সেটা শেষ হলেই করবে।

কণিকা বলল - "সে কিন্তু চাকরিটা ছাড়বে না।"

সন্দীপ বলল - "না-না, চাকরিটা ছাড়বে কেন? এ যুগে চাকরি পেয়ে কেউ আবার ছাড়ে?"

বিয়েটা হলেও কণিকা আপাতত বাপের বাড়ি থেকেই চাকরিটা করবে। সন্দীপের ছলচাতুরি, তার মনের সুপ্ত ইচ্ছে, গোপন রহস্য কিছুই বুঝতে পারল না কণিকা। না সে নিজে; না তার বাবা-মা।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েরা যে ভুলটা করে সেই একই ভুল করে বসল কণিকা। শিক্ষিতা, একটা স্কুলের দিদিমনি, সেও ভুল করল, জীবনের মস্তবড়ো ভুল।

কণিকা বুঝতে পারল তার শরীরে একটা পরিবর্তণ এসেছে। না, আর মোটেই দেরি নয়, সন্দীপের সঙ্গে তার বিয়ে হওয়াটা জরুরি। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা হওয়া দরকার।

সন্দীপকে গিয়ে সব কথা খুলে বলল কণিকা।

।। ৪ ।।

কণিকার কথা শুনে প্রথমে একচোট হাসল সন্দীপ। হাসতে হাসতেই বলল - "এ আবার একটা সমস্যা হ’ল? এ যুগে এটা কোনো ব্যাপারই নয়, ডাক্তারের কাছে একবার গেলেই তো ব্যাস। ক’মিনিটের মধ্যেই ফিনিশ। যেমন ছিলে তেমনই আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।"

- "তুমি আমাকে অ্যাবরসন করতে বলছো? না না, অ্যাবরসন করবো না। তুমি আমাকে অবিলম্বে বিয়ে করো, নইলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো গতি থাকবে না।" ভীত, সন্ত্রস্ত কণিকা আঁচলে চোখ মুছল।

সন্দীপ বলল - "একটুতেই চোখে জল এসে গেল। আমি বললাম বলেই কী হয়ে যাচ্ছে, আরে আমিও এটা চাই না। আমার বাবা-মা কথাটা শুনলে আমাকে আস্ত রাখবে ভেবেছ? আমি তোমাকে পরীক্ষা করে দেখছিলাম তুমি আমার সন্তানকে ভালোবাসো কিনা।"

তারপর আরও কিছুটা ভেবে নিয়ে সন্দীপ বলল - "শোনো কণিকা, বিয়ের আগে বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নেওয়া দরকার। তাই বলি কি, চলো আগামী পরশুদিন শিলিগুড়ি রওনা হয়ে যাই। তেমন হলে বিয়ের পাটটা না হয় ওখানেই চুকে যাবে। তোমার বাবা-মাও সঙ্গে যেতে চাইলে চলুক।"

অসহায় কণিকা সন্দীপের কথাতে সায় দিল। এছাড়া তার উপায়ই বা কী?

সন্দীপ কণিকাদে শিলিগুড়ি নিয়ে যাবার জন্য একটা মারুতির ব্যবস্থা করেছে। সেই মারুতিতে চড়ে বসল কণিকা আর কণিকার মা-বাবা, সাথে সন্দীপ তো আছেই।

পানাগড়ের কাছে গাড়ি যখন পৌঁছলো তখন দুপুরবেলা। গ্রীষ্মের প্রখর তাপে পথ-ঘাট সব ঝাঁঝাঁ, খাঁখাঁ করছে। যেন আগুন বাতাস বইছে প্রকৃতিতে। একটা বাজারের কাছে মারুতিটা দাঁড়িয়ে পড়ল। সন্দীপ বলল - "কণিকা, এই গাড়িটা আমাদের এখানেই ছেড়ে দিতে হচ্ছে, এটা শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাবে না। এখানে আমাদর অন্য একটা গাড়ি নিতে হবে, তাই নেমে এসো।"

কণিকা আর কণিকার মা-বাবা মারুতি থেকে নেমে পড়ল। মারুতিটা চলে গেল। যাবার আগে মারুতির ড্রাইভার সন্দীপকে কী যেন একটা ইশারা করে গেল, ইশারার উদ্দেশ্যটা কী সেটা কণিকারা বুঝতে পারল না।

সন্দীপ বলল - "আমরা তো সেই কখন সকালে রওনা হয়েছি। এখন একটুখানি টিফিন করে নিলেই বোধহয় ভালো হয়।"

কণিকার বাবা বললেন - "সেই ভালো।"

একটা বড়ো মিষ্টির দোকান দেখে সকলে উঠল টিফিন করবে বলে। সন্দীপ বেশ ভালোমতো একটা টিফিনের অর্ডার দিয়ে বলল - "কণিকা, তোমরা খাও আমি ততক্ষণে একটা গাড়ি ঠিক করে নিয়ে আসি। এইতো সামনেই ট্যাক্সিস্ট্যান্ড।"

কণিকা জিজ্ঞেস করল - "তুমি খাবে না?"

- "ট্যাক্সিটা তো আগে ঠিক করে আনি। তোমরা খাও, আমি আসছি। সন্দীপ বেরিয়ে গেল ট্যাক্সির খোঁজে।"

টিফিন করা কখন শেষ হয়ে গেছে কণিকাদের, কিন্তু সন্দীপ ফিরল না। আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা করল কিন্তু কোথায় সন্দীপ? কোথায় তার ট্যাক্সি?

কণিকার মনে উত্‍কন্ঠা। উত্‍কন্ঠায় কণিকার মা-বাবাও। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে সন্দীপ আর আসে না।

কণিকার মা’র অস্থিরতা আরও বেশি। সে কণিকাকে জিজ্ঞেস করল - "ছেলেটা এখনো আসছে না কেন বলতো?"

কণিকা বলল - "সেই তো মা, কিছুই বুঝতে পারছি না। দাঁড়াও ফোন করি।" কণিকা তার মোবাইল থেকে সন্দীপকে ফোন করলো। একি! সন্দীপের মোবাইলে তো কোনোরকম রিং হচ্ছে না। যতবার ফোন করে ততবারই বলে সুইচড্ অফ।

উদ্বিগ্ন গলায় কণিকার বাবা জানতে চাইলেন - "কিরে, সন্দীপকে ফোনে পেলি? কী বলছে?”

- "সুইচ অফ বলছে বাবা।"

- "সে কী! ছেলেটা তাহলে কোথায় গেল? কোনো বিপদে পড়ল না তো?"

কণিকার মনে কেমন একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে ভয়। সন্দীপ তাদের ঠকায়নি তো?

।। ৫ ।।

মিষ্টি-দোকানি ওদের উদ্বেগ আর উত্‍কন্ঠা দেখে একসময় জিজ্ঞেস করল - "কিছু একটা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে আপনাদের? কেমন যেন একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছি, কী হয়েছে?"

কণিকার বাবা বললেন - "দেখো না বাবা, যে ছেলেটি তোমাকে মিষ্টির অর্ডার দিয়ে গেল, কতক্ষন হয়ে গেল তবু সে আসছে না।"

- "ছেলেটি কে হয় আপনাদের?"

- "না, এখনো তেমন কেউ হয়নি। তবে ছেলেটি আমাদের হবু জামাই।" তারপর কণিকাকে দেখিয়ে বলল - "এই আমার মেয়ে। একে ভালোবাসে, বিয়ে হওয়ার কথা। শিলিগুড়িতে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের এনেছে।"

কথাটা শুনে মিষ্টি-দোকানির চোখ কপালে উঠল। বলল - "সে কী! মনে হচ্ছে তো আপনারা ঠকেছেন। ছেলেটি আপনাদের ভাওতা দিয়েছে। শিলিগুড়িতে ওসব বাড়িটাড়ি কিছু নেই। আপনাদের এখানে বসিয়ে রেখে ট্যাক্সি আনতে যাবার নাম করে দিব্যি কেটে পড়েছে। আপনারা যতক্ষণে টিফিন সেরেছেন তার মধ্যেই ছেলেটি পগার পার হয়ে গেছে।"

- "বলো কী বাবা তুমি!" কণিকার বাবার গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। কণিকার মা আঁৎকে ওঠেন।

- "আপনারা কোত্থেকে আসছেন?"

- "পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে। মেদিনীপুরে ছেলেটির মোবাইলের দোকান আছে। আসল বাড়ি নাকি শিলিগুড়িতে। আমার মেয়ের...."

- "আপনার মেয়ের সর্বনাশ করেছে তো? আর দেখতে হবে না। ছেলেটি আপনাদের জব্বর ঠকিয়েছে। ঘন্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন যদি আপনারা ছেলেটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন তবু ও আর আপনাদের কাছে আসছে না। আপনারা তো ওর সন্ধান পাবেনই না, পুলিশও ওর টিকি ছুঁতে পারবে না। ওরা খুব ধুরন্ধর আর সেয়ানা হয়। তাই বলি কি ছেলেটির জন্য আর অপেক্ষা না করে মেয়েকে নিয়ে আপনারা বাড়ি ফিরে যান।"

মিষ্টি-দোকানির কথায় কণিকা আর কণিকার মা কান্নায় ভেঙে পড়ল। কণিকার বাবা কোনোরকমে ওদের শান্ত করল। মিষ্টি-দোকানিও ওদের অনেক করে বোঝালো।

- "এ কি দিনকাল পড়ল বাবা!"

মিষ্টি-দোকানি বলল - "হ্যাঁ, এরকম ধাপ্পাবাজ কিছু ছেলেদের আবির্ভাব ঘটেছে ইদানিং। ফোনে মেয়েদের সঙ্গে ভাব করে, পরিচয় করে, ক’দিনের জন্য একটা সম্পর্ক পাতিয়ে মেয়েটির সর্বনাশ করে পালিয়ে যায়। আপনার মেয়েকেও ওই ফাঁদে ফেলেছে, আপনার মেয়ে বুঝতে পারেনি। সুযোগ পেলে সাথে সাথে টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে যেতেও ভোলে না।"

কণিকার বাবা বলল - "না, সন্দীপ মানে ওই ছেলেটি তেমন করেনি।"

কণিকা ডুকরে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল - "করেছে বাবা, সন্দীপ সেটাও করেছে। উনি ঠিক কথাই বলেছেন। সন্দীপ দিন কুড়ি আগে আমার কাছ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা নিয়েছে। বলল কি একটা জরুরি কাজে নিচ্ছে, তবে ধার হিসেবে। শোধ করে দেবে পরে। তোমাদের সে কথাটা জানানো হয়নি।"

- "হা, ভগবান..." বলে কপাল চাপড়ে উঠলেন কণিকার বাবা। কণিকার মায়ের মাথায়ও হাত। বললেন - সর্বনাশের আর কীই বা বাকি রেখেছিস মুখপুড়ি! এত সব করার আগে কেন তোর মরণ হ’ল না।"

ফোনে শেষবারের মতো সন্দীপকে ধরবার চেষ্টা করল কণিকা। না, সন্দীপকে পেল না।

মিষ্টি-দোকানি বলল - "বৃথা চেষ্টা করছেন দিদিমনি, ফোনে আর ওকে পাবেন না। ফোনের সিমটা এতক্ষণে সে হয়তো ফেলে দিয়েছে, নয়তো পালটে দিয়েছে। ওরা নানাধরনের সিম ব্যবহার করে থাকে।"

দোকানের বিল মিটিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে কণিকারা ফিরে আসে ক্ষীরপাইয়ে। কণিকা ফিরে আসতে চায়নি। সে মায়ের কথাই রাখতে চেয়েছিল, সে মরতে চেয়েছিল। কোন লজ্জায় সে ফিরবে? তার এই কলঙ্কিত মুখ সে আর কাউকে দেখাতে চায় না। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তবে কোনোরকমে ওকে আনা গেছে।

।। ৬ ।।

একদিনেই কণিকা শুকিয়ে কাঠ। চোখদু’টো বিশ্রীভাবে কেমন কোটরে ঢুকে গেছে। একটা জ্যান্ত প্রাণবন্ত গাছকে শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেললে যে দশা হয় সেই দশা এখন কণিকার। ঝড়ে লেপ্টে যাওয়া পাতার মতো। বিধ্বস্ত শরীরটা নিয়ে বাবাকে সাথে করে পরের দিন কণিকা মেদিনীপুরে এল। সন্দীপ না থাক, সন্দীপের দোকানটা তো আছে। সেখানে যারা কাজ করে তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে সন্দীপ আসলে কে? তার বাড়িই বা কোথায়? থানায় সন্দীপের নামে কেস করবে তারা।

মেদিনীপুরে যেখানে সন্দীপের দোকানটা ছিল সেখানে পৌঁছেই কণিকা আর কণিকার বাবা তো থ’। কোথায় সেই মোবাইল দোকান? দোকানটার অস্তিত্বই তো নেই। পাশের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল - "ও দোকানটা তো নেই। গতকালই সব গুটিয়ে টুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে। ভাড়া করা দোকান ছিল ওটা। মালদহ না মুর্শিদাবাদ কোথায় যেন উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলল।"

কণিকার দু’চোখে অন্ধকারের প্লাবন। সে বাবার বুকে মুখ ঢেকে ককিয়ে উঠল। এখন তার সত্যিই মনে হচ্ছে যে আননোন নাম্বার থেকে তার ফোনটা এসেছিল সেই আননোন নাম্বারেই এতদিন সে ফোন করে গেছে।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।