জেলা শহরের বেশ গলির মধ্যের এক অতি সাধারণ দোতালা বাড়িতে বাস করত একটি পরিবার। রোকন সাহেবের পরিবার। তার পরিবারে ছিল তার সহধর্মিণী কেয়া ও ছোট দুটি ছেলে মেয়ে ফুয়াদ আর রীমা। ছোট এ পরিবারটি অত্যন্ত সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে দিনযাপন করে। তারা দোতালার উত্তর দিকের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বাস করে আর দক্ষিণের অংশে বাড়িওয়ালার পরিবার থাকে।
পঁচিশে মার্চ, দুপুরবেলা। ফুয়াদ গোসল সেরে এসে তাড়াতাড়ি রীমাকে ডেকে বলল, "আপু জলদি খেতে এসো, লেট কোরো না।"
রীমা ঝটপট এসে খেতে বসে গেল ছোট ভাইয়ের সাথে। বাথরুম থেকে তাদের মা উঁচু গলায় বললেন, "একটু বস তোরা। আমি এসে খাবার দিচ্ছি। চুলায় গোস্ত আছে, হয়নি এখনো। একটু দেরি কর।"
কিন্তু বাচ্চা দুটো নিজেরাই খাবার বেড়ে নিয়ে চুপিচুপি খেতে শুরু করে দিল যথাসম্ভব শব্দ না করে। খেতে খেতে ফুয়াদ বোনকে বলল, "আপু খাওয়া শেষ হলেই কিন্তু ঘুমাবো আমরা। বেশ করে ঘুমাবো।"
এই, আস্তে কথা বল। মা শুনে ফেললে অপেক্ষা করতে বলবে।
আচ্ছা। আপু, আমরা একেবারে সন্ধ্যায় উঠব। রাত একটা-দুইটা পর্যন্ত জাগতে হবে তো। এই জন্যে বেশি করে ঘুমিয়ে নিতে হবে। না হলে রাতজাগা যাবে না।
হ্যাঁ। আজ খুব মজা হবে। আম্মুকেও আমাদের সাথে নেব দেখতে। ঘুমাতে দেব না।
হুম। আব্বুকে তো জোর করে এমনকি কান্নাকাটি করেও সাথে নিতে পারবো না। আব্বু ঘুমাবেই।
বাদ দে। আম্মুকেই জোর করে নিয়ে যাবো। খুব মজা হবে। সাথে ক্যামেরাটাও নিতে হবে কিন্তু। চার্জ দিয়েছিস তো ভালোমতো?
অবশ্যই। আমি লুকিয়ে আব্বুর মোবাইলটাও নিয়ে যাবো। দুজন দুটোতে ভিডিও করব। আমি ক্যামেরা, মোবাইল দুটোতেই সকাল থেকে চার্জ দিয়ে একদম রেডি করে রেখেছি।
চল তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করি আগে।
দুজন খিলখিল করে হেসে উঠল, তৎক্ষণাৎ বাম হাত দিয়ে নিজেদের মুখ চেপে ধরে শব্দ আড়াল করে নিল। তারপর আবার খেতে শুরু করল। খাবারও শেষ করে নিল অল্প সময়েই। তারপর প্লেট দুটো রান্নাঘরে রেখে তারা ঘুমাতে চলে গেল।
ঘুম ভেঙ্গে ফুয়াদ দেখল সন্ধ্যা গাঢ় অন্ধকারে রূপ নিয়েছে। সে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে পাশের রুমে গিয়ে রীমাকে ডেকে উঠাল। তারপর তারা একসাথে বেসিনে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিয়ে বারান্দার দিকে দৌড়ে গেল। বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইল দুজন বাইরে আকাশের দিকে চেয়ে।
আধা ঘণ্টা পর তারা সফল হল। আতসবাজির দূরাগত শব্দ শোনা গেল। বাচ্চাদুটো আনন্দে চিৎকার করে দুজন দুজনের হাত ধরে কিছুক্ষণ লাফাল। তারা আতসবাজি দেখবে! আকাশের পটে ক্ষণে ক্ষণে ফুটে ওঠা আলোর কদমফুল দেখতে পাবে তারা। কোন ফুল কতটা বড় হয়ে ফুটবে তার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আহা! কী সুন্দর! দৃষ্টি আটকে যায় আকাশের পটে।
রীমা ও ফুয়াদ বারান্দা থেকে দৌঁড়ে দরজার কাছে গেল, যে দরজা দুটো ফ্ল্যাটকে বিভক্ত করেছে। দরজাটির অপর পারে বন্দী আছে ছাদের সিঁড়ি আর ছাদ - যেটা বাড়িওয়ালাদের অধীনে থাকে সবসময়। দুজন একটা চেয়ার টেনে এনে তার উপরে উঠল দরজার ছিটকিনি খুলতে। রীমা চেয়ারে উঠল আর ফুয়াদ শক্ত করে চেয়ার ধরে রাখল। ছিটকিনি খোলায় সফল হলে দুজন দেখল অপরদিক থেকে বাড়িওয়ালা গেট আটকে রেখেছে প্রতিদিনের মতো। আতসবাজির শব্দ হয়েই চলেছে বাইরের আকাশে। ক্রমাগত শব্দে তাদের মধ্যে উত্তেজনা, অস্থিরতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিল। তারা জোরে জোরে দরজা নাড়তে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিল বাড়িওয়ালার মেয়ে।
বাঁধামুক্ত হয়ে ভাই-বোন এক দৌড়ে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে লাগল হাত ধরে। উপরে উঠে তারা আরও একবার হতাশ হল। ছাদের দরজায় তালা ঝুলছে। ফুয়াদ রীমাকে বলল, "আপু তুই দাঁড়া। আমি এক্ষুনি আন্টির কাছ থেকে চাবি নিয়ে আসছি।"
কথাটা ঠিকভাবে শেষ করার আগেই ছেলেটা দৌড়ে নেমে গেল। বাড়িওয়ালির কাছে গিয়ে সে চাবি চাইলে মহিলা তাকে জানিয়ে দিল, সেটা রয়েছে তার মেয়ের কাছে এবং মেয়েটি নাকি নিচের তলার আন্টির বাসায় গল্প করতে গেছে। ফুয়াদ আবার দৌড় দিয়ে নিচে গেল মেয়েটির থেকে চাবি নিতে। গেট নাড়তেই সে' বাড়ির কাজের মেয়ে এসে সেটা খুলে দিল। ফুয়াদ ভেতরে গিয়ে বাড়িওয়ালির মেয়ের কাছে চাবি চাইলে সে বলল, "ওটাতো আপুর হাতে দিয়ে এলাম।"
হাফাতে হাফাতে ফুয়াদ আবার উপরে উঠে এল। বাড়িওয়ালির বড় মেয়েকে খুঁজে বের করে তার কাছ থেকে চাবিটা উদ্ধার করল। সাফল্য-উদ্ভাসিত মুখে সে চাবিটা নিয়ে উপরে ছুটল। দরজার সামনে পৌঁছেই চাবিটা বড় বোনের হাতে দিল হাফাতে হাফাতে। রীমা একগাল হাসি দিয়ে চাবিটা হাতে নিয়ে তালাটা খুলল। পরিশ্রান্ত ফুয়াদ অত্যন্ত প্রফুল্ল চিত্তে সেদিকে চেয়ে আছে। কিন্তু হঠাৎ-ই পেছন থেকে বাড়িওয়ালির রুক্ষ কণ্ঠ ভেসে এল, "তালা খুলো না। রাতে ছাদে যাওয়া যাবে না। নিচে যাও।"
ভাই-বোনের মুখ দুটো শুকিয়ে নিমিষেই পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। ক্ষণিকের মধ্যেই সব হাসি, সব আশা, সব আনন্দ মুছে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল তাদের মুখজোড়া। ছোট ভাই-বোন মিলে অনেক কাকুতি মিনতি করল একটিবার ছাদে যাবার অনুমতির জন্য। কিন্তু বাড়িওয়ালিও নাছোড়বান্দা। সে রীমার হাতের মুঠোর মধ্যে থেকে লুকোনো চাবিটা টেনে বের করে নিয়ে বাচ্চাদুটোর মুখের ওপরই গেটে তালা-বন্ধ করে চাবিটা নিয়ে নিচে চলে গেল। বাচ্চাদুটো ফ্যালফ্যাল করে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ছাদের দিকে চেয়ে রইল। অসহায় ভাই-বোন দুজন দুজনের মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়েই ধীর পায়ে নীচে নেমে এল। নামতে নামতে দুজনেই নিচের দিকে তাকিয়ে তাদের নিঃশব্দ অশ্রু গোপনে হাত দিয়ে মুছে নিল যেন অন্যজন তা না বুঝতে পারে। তারা নিজের বাসায় ফিরে এল। বাইরে আতসবাজির হর্ষধ্বনি একের পর এক বেজেই চলল। ছোট ছেলে-মেয়েদুটো ক্যামেরা মোবাইল পূর্ব স্থানে রেখে বিছানায় মুখ ঢেকে চুপ-চাপ শুয়ে পড়ল। বিষয়টি বুঝতে পেরে তাদের অসহায় বাবা-মা অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। কিন্তু তাদের কি-ই বা করবার আছে!
বেশ কয়েক বছর পর রোকন সাহেব নির্মাণ কাজ শেষ করে নিজেদের বাসায় চলে এলেন। আজ রীমা-ফুয়াদের নিজেদের বাসা হয়েছে, তারা পেয়েছে নিজেদের মুক্ত একটি ছাদ। কিন্তু তাদের আর ছাদে উঠতে দেখা যায় না। শিশুকালের সেই অবুঝ, সরল, সুন্দর, রঙিন আবেগগুলো তারা সময়ের সাথে হারিয়ে ফেলেছে।
চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।