গল্প ও অণুগল্প

আমার মা (দ্বিতীয় পর্ব) [ধারাবাহিক উপন্যাস]



অচিন্ত্য সাহা


।। ২ ।।

প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় আমাকে বেরিয়ে পড়তে হলো এক অনিশ্চিত জীবনের পথে। সামনে অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা। কী করবো ভেবে উঠতে পারছিলাম না। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বেলগাছের নীচে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম, এই গাছটিই আমার সমস্ত ব্যথা-বেদনা, সুখ দুঃখের, হাসি কান্নার সবচেয়ে বড়ো সাথী, এখানে এলে আমি সান্ত্বনা পাই, আমার মনোকষ্টের অনেকটাই লাঘব হয়। আমার মনের যন্ত্রণার কথা ও বোঝে তাই ওকেও অনেকটা বিমর্ষ দেখায়। আমি ওর সাথে কথা বলি-তুই ছাড়া আমার ব্যখা-যন্ত্রণার কথা কেউ বোঝে না রে, কেউ বোঝে না।

এভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল, এর মাঝে বেশ কয়েক বার মনে হলো জীবনে বোধহয় মস্ত বড়ো একটা ভুল করে ফেললাম। এতটুকু বয়সে বাড়ি-ঘর, পরিবার পরিজনদের ছেড়ে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া কী ঠিক হলো। কয়েক ঘন্টা মনের সাথে লড়াই চলতে লাগলো। অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্তাচলগামী। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো আমার মনোলোক। মনটাকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালাম। আজকের রাতটা কেটে গেলে আগামীকাল খেকে শুরু হবে আমার জীবনের নতুন অধ্যায়, সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার একাকীত্বের জীবন, এক নতুন সংগ্রাম। প্রথমে কিছুটা সংশয় নিয়ে দিদির ভাড়া বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম কেবলমাত্র রাতের আশ্রয়টুকুর আশায়। ইতিমধ্যে তার কাছে খবর পৌঁছে গেছে যে, আমি বৌদিদির সঙ্গে অশান্তি করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছি। কিছুদিন আগে মা আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে কৃষ্ণনগরে এসেছেন। তিনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর সামনেই দিদির কাছে অনুরোধ করলাম। "সামনে আমার বার্ষিক পরীক্ষা। দিন পনের এখানে থেকে পরীক্ষা দেবো, তারপর পরীক্ষা শেষ হলেই আমি চলে যাবো। সকাল সন্ধ্যা টিউশনি। দুপুরে স্কুল। কেবল রাতটা এখানে বারান্দায় থাকবো। আমার জন্য খাবারও করতে হবে না।"

দিদি তো রাজি হলোই না বরং তার অক্ষমতার কথা জানিয়ে দিল। উপরি পাওনা হিসেবে মায়ের কাছে পেলাম চরম লাঞ্ছনা ও কটূক্তি। আমি নাকি তাঁর অপদার্থ সন্তান। তাঁকে 'মা' বলে ডাকিনা, তাঁর কাছে যাই না, এমনকি অন্যান্য ছেলেমেয়েদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব নিয়ে আমি সবার কাছে ভুল বার্তা প্রচার করি। আর সবচেয়ে বেশি যেটা আমাকে অবাক করলো সেটা হলো মা দৃঢ়ভাবে জানালেন "তুই তো আমার ছেলেই নোস। এতদিন আমি ভোকে মানুষ করেছি সেটা তোর বাপের ভাগ্যি। তবুও তোকে ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম, আজ আমি বুঝতে পারছি এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগে না, অনেক পড়াশোনা করেছিস এবার নিজের পথ নিজে দেখে নে। আমি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ভোকে ত্যাজ্যপুত্র করলাম, দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে।"

সা যে কেন একথা বললেন তা আমার মাথায় ঢুকলো না। এর পিছনে কোন ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা আমার সম্পূর্ণ অজানা।

মনে পড়ে গেল শৈশবের একটা দিনের কথা... তখন বয়স ছয় অখবা সাত হবে। বড়ো বৌদির সাখে মায়ের চরম অশান্তি চলছে। বড়ো বৌদি খুব বড়ো ঘরের মেয়ে, বাবা একজন ডাকসাইটে ডাক্তার, খুব নামডাক। ধন্বন্তরী চিকিৎসক রূপে অন্তত বিশ পঁচিশটা গ্রামে তাঁর খ্যাতি ছিলো। আর্থিক স্বচ্ছলতা, সামাজিক সম্মান, প্রতিপত্তিতে তাঁর ধারেকাছে কেউ ছিলো না। সেই পরিবারের অত্যন্ত আদরের মেয়ে বড়ো বৌদি। গৃহকর্মে তার দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা কোনোটাই ছিলো না। আমাদের বাড়িতে ছিলো কাঠের উলুন। সেই উনুনে রান্না করার কোনো রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় মাঝে মাঝেই মায়ের সাথে বড়ো বৌদির বচসা হতো। এই ব্যাপারটা আমি কখনোই মেনে নিতে পারতাম না। কিন্তু বয়সে ছোটো হওয়ার কারণে আমি কথা বলতে সাহস পেতাম না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যাপারটা সহ্য করাটাও আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। বাবার বড়ো আদরের মেয়ে, তাছাড়া লেখাপড়া করা মেয়ে, বাড়িতে দু-তিনটে ঝি-চাকর আছে। ফলে বৌদিকে কোনদিনই হেঁসেলে যেতে হয়নি, হয়তো সথ করে কোনো কোনো দিন বাবা-মাকে চা করে দিয়েছে-এর বেশি কিছু নয়। এমনকি নিজের জামা-কাপড়টাও নিজেকে কাচতে হয়নি। সেই মেয়ে আমাদের মতো একটা হতদরিদ্র পরিবারে এসে বাড়ির সব কাজকর্ম নিখুঁতভাবে করবে, এমন আশা করাই উচিত নয়। অন্তত কিছুদিন সময় তো তাকে দিতে হবে। আমার খুব খারাপ লাগতো। তাই একদিন বাবাকে বিষয়টা জানালাম। বাবা বললেন - এ ব্যাপারটা নিয়ে তোমাকে না ভাবলেও চলবে। ওসব বড়োদের বিষয়, বড়োরা নিশ্চয় এ ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা করবে।

- কিন্তু বাবা...

- না, কোনো কিন্তু নয়। যাও তুমি তোমার কাজ করো। আমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলবো। আমি কোনো কথা না বলে চলে এলাম। এর বেশ কয়েক দিন পর আবার তুমুল অশান্তি, ঝগড়াঝাটি। মায়ের সাথে বৌদির নানাবিধ বাকবিতন্ডা, বাপ ঠাকুরদা তুলে গালাগাল। ওদের চিৎকার চেঁচামেচিতে পাড়ার লোক জড়ো হয়ে যায়। আমার খুব খারাপ লাগে। কিছু বলতে পারি না, ভয় হয়। বাবার নিষেধ অমান্য করার সাধ্য আমার নেই তবুও...

সেদিন ছিলো হাটবার, আমাদের বাড়ি ছিলো প্রধান সড়কের ধারে, তাই আগত-অনাগত হাটুরের দল এ ব্যাপারটা উপভোগ করছে। আমার কাছে বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগছিল। একবার মাকে একবার বৌদিকে থামাতে চেষ্টা করছি, কিন্তু কেউ খামতে চায় না। আমি মাকে বললাম-তোমরা কেউ থামবে না তাই তো? আমি বাবাকে ডেকে আনছি। প্রতিদিন তোমাদের এই ধরনের অশান্তি আমার ভালো লাগছে না।

মা বললেন - যা বেরিয়ে যা, এই ভর সন্ধেবেলা বেরোচ্ছিস, তোকে যেন কালমাপে কাটে।

আমার না খেকে মাখা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। আমি জানি মা রাগের মাথায় একথা বলেছেন। এটা অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ, আর মায়ের অভিশাপ কথনো কার্যকরী হয় না। কিন্তু কিছুদূর যেতেই দেখলাম আমার ধারণা কতটা ভুল। আমাদের গ্রামে সাদের উৎপাত ছিলোই, এবং সেই সন্ধ্যাতেই আমাকে সাপে কাটলো। সে যাত্রায় বাবার অক্লান্ত পরিশ্রমে আমার প্রাণ বাঁচলো। কিন্তু মায়ের সম্পর্কে আমার মনে একটা বিরূপ ধারণা তৈরী হলো। এরপর আরও কয়েকটি নৃশংস ঘটনা ঘটে যার ফলে ধীরে ধীরে আমার মন থেকে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা একেবারেই চলে যায়। আর আমার তখনই মনে ঢুকে যায় যে, ইনি আমার সত্যিকারের মা নন। দীর্ঘদিন মনে মনে এই ধারণা পোষণ করেছি, কিছুতেই মন থেকে এ ধারণা তাড়াতে পারিনি।

(ক্রমশ)