গল্প ও অণুগল্প

আত্মজ



মৌসুমি মৌ (বাংলাদেশ)


সব মায়েরাই না-কি তাদের সন্তানকে তার নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসেন। আমি কখনো এরকমটা দেখিনি কিংবা দেখলেও যে জিনিস নিজের উপলব্ধিতে নেই সে জিনিসের প্রতি বিশ্বাস আনতে পারিনি।

মা আমাকে ভালোবাসেন না এমন নয়। অবশ্যই বাসেন। মাঝেমধ্যে যখন মারের চোটে দু এক জায়গা থেকে রক্ত বের হওয়া শুরু করে, তখন আমি দেখেছি, মা আমাকে খুব যত্ন-আত্তি করছেন। আদর করে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন, কাটা জায়গায় মলম লাগিয়ে দিচ্ছেন। কাটা জায়গায় মলম দিতে দিতে তার চোখ থেকে পানি পড়ছে। আমাকে কিংবা নিজেকে ভোলানোর জন্য এটা সেটা বলছেন।

আসলে ওরকম বেধড়ক মারের পর আমাকে আর কোনোকিছু স্পর্শ করে না। মায়ের কথা কিংবা চোখের জল কিছুই না। স্থবির হয়ে যেতে ইচ্ছে করে একদম।

আমি কখনো মায়ের  প্রহারের কারণ জানতে পারিনি। আমি যা করি আমার বন্ধুরাও তাই করে। কই, ওরা তো এত মার খায় না। ওদের তো বড়োজোর দু একটা কানমলা, চড় থাপ্পড় এই শেষ। এরচেয়ে বেশি কিছু কখনো দেখিনি।

কখনো আমার এমন মনে হয়নি যে, মা দারিদ্র্যের কষাঘাতে এমন করছেন। দারিদ্র্য তো আমাদের একার না, আরো অনেকের ছিল। না-কি জানি হয়তো মায়ের দারিদ্র্য অন্য অনেকের থেকে বেশি ছিল!

আসলেই মায়ের দারিদ্র্য অনেক বেশি ছিল। তা বুঝেছিলাম আরো অনেক বছর পর।

তখন আমার বয়স সতেরো। বন্ধুদের সথে আড্ডায় বসে বিড়ি ফুঁকতে শিখেছি। দু একটা মেয়ের চোখের ঘোরে নিজেকে হারাতে শিখেছি। মেয়েরা তখন আমার কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে বলতো, ‘তোর অরিজিন কোথায় রে?‘ আমাদের এ তল্লাটে তোর মতো কাউকে তো দেখা যায় না। তোর চোখ আর চুলের দিকে তাকালে হাজারো মেয়ের সর্বনাশ হয়ে যাবে!' আমি তখন বাঁকা হাসিতে চোখ সরাই। তখন আমি শিখে গেছি কোন কথার কীভাবে উত্তর দিতে হয়। শুধু শিখতে পারিনি মায়ের কথার উত্তর কীভাবে দিতে হয়।

তপুর ঘরে বসে সেদিন সবাই মিলে সিগারেট ফুঁকছিলাম আর নিষিদ্ধ আাড্ডায় মত্ত ছিলাম। ঠিক সে সময়ে মা  দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। যে কাজ কখনো তপুর বাবা-মা করেনি, সে কাজ করলেন আমার মা। তপুর বাবা-মা ছেলের প্রাইভেসিতে কখনো নাক গলাননি, নাক গলানো উচিৎ বলেও মনে করেন না। তাইতো আমরা বরাবর দরজা ভেজিয়েই বসি। কিন্তু সেদিন অঘটনটা ঘটালেন আমার মা। সবার সামনেই আমাকে এলোপাতাড়ি থাপড়াতে শুরু করলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে গেল সবাই। যে যেভাবে বসে ছিল সে সেভাবেই বসে রইলো। মা আমাকে থাপড়াতে থাপড়াতে বাড়িতে নিয়ে এলেন।

বন্ধুদের সামনে এত লজ্জা আমি মানতে পারলাম না। মায়ের কথার প্রতিবাদ করে উঠলাম। মা যে লাঠি ধরেছিল আমাকে মারার জন্য, তা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। মা আমার স্পর্ধায় অবাক হয়ে গেলেন। যতটা না অবাক হলেন তার থেকে বেশি হলেন ক্রুদ্ধ। সেই ক্রুদ্ধতার বশর্বতী হয়ে আমাকে মারতে মারতে বলে ফেললেন আমার জীবনের চরম সত্যটি।

‘বস্তির ছেলে আজীবন বস্তির ছেলেই থাকবি। যতই তোকে মানুষ করার চেষ্টা করি কোনোদিন মানুষ হবি না।‘

কী বললেন তা ভেবেই হয়তো দ্রুতপায়ে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলেন আর মা'র দরজার এপাশে ভেঙে পড়তে থাকলো আমার সবকিছু। সব!

এতদিন ভাসাভাসাভাবে যা শুনে এসেছি তা আজ স্পষ্টভাবে শুনলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। বিগত সতেরোটা বছর আমার জীবন মিথ্যা দিয়ে কেটে গেল। এক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু মিথ্যা হয়ে গেল আমার জীবনের। একে একে সবকিছু ভেঙে পড়তে শুরু করলো আমার সামনে। সকাল থেকে দুপুর গড়ালো আমি ওভাবেই বসে রইলাম। আর মাও ওপাশে ওভাবে।

দাদি কয়েকবার উদ্বিগ্নমুখে ডাক দিলেন মাকে। স্তব্ধ এই আমার শরীর ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলতে শুরু করলেন, 'ও রাতুল, কতা ক। এমনে বইয়া থাহিস না। তোর মায়েরে ডাক। দ্যাখ কিছু কইরা বইলো না হি?‘

আমি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না। ওভাবেই বসে রইলাম।

রাত একটু বাড়লেই নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছাতে শুরু করলাম। দাদি ঘরে এসে তাই দেখে বললেন, ‘কই যাছ?‘

কন্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলে উঠলাম, ‘বস্তির পোলা, বস্তির তন আইছি, বস্তিতই ফেরত যাই।‘

দাদি ঠিক তার দ্বিগুণ ঝাঁঝে বলে উঠলেন, ‘বস্তিত কার কাছে যাবি? তোর কুন মায়ে তোর লাইগ্যা বইয়া রইছে? তোরে যে জন্ম দিছে, হ্যায় তো তোর জন্মের পর তোর মুখডাও দেহেনাই। টেহার লাইগা বেইচা দিছে তোরে। বারো হাজার টেহা দিয়া তোরে আমরা কিইনা আনছি। হ, যাইবো বস্তিতে, যা কুনো যাবি যা। তোর কুন মায়ে তোর লাইগা বইয়া আছে আমিও দেখমু।‘ বলতে বলতে ঘর ছাড়লেন দাদি।

বাকি যেটুকু যা বাকি ছিল আমার সেটুকুও শেষ করে দিয়ে গেলেন দাদি। নিজেকে শুধু একটা বারো হাজার টাকার বস্তু মনে হলো। দাদির কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো সারারাত। এই জীবনটাকে শুধু একটা টাকার বান্ডিল মনে হতে লাগলো। নিজের শরীর স্পর্শ করে দেখলাম এগুলো চামড়া, মাংস না-কি টাকা!

নিজেকে বাধ মানানোর মতো কিছুই ছিল না আমার কাছে, কিছুই না। এক টুকরো আশার আলো দেখলাম না কোথাও। কোনো খড়কুটো পেলাম না যা ধরে আমি ভেসে থাকতে পারি। সারারাত ওভাবেই বসে থাকলাম। ভোরের আলো না ফুটতেই ব্যাগ হাতে বাবা হাজির হলো। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমিও আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম বাবাকে। যে কান্নাটা কাল থেকে গলা চিড়ে বের হয়নি, সে কান্নাটাই বাবার স্পর্শ পেয়ে বের হয়ে এলো। একবারের জন্যও আমার মনে হলো না এই মানুষটি আমার নিজের বাবা নন। নিজের বাবা কথাটা আসলে কী? বাবা তো বাবাই। নিজের বাবা আর অন্য বাবার গন্ধ কি আলাদা হয়? এই মানুষটির রূপ, রস ,গন্ধ সবই তো বাবার মতো। বোধজ্ঞান হওয়া পর্যন্ত যাকে বাবা রূপে দেখে আসছি তাকে ছাড়া তো আামি আর কাউকে বাবা হিসেবে কল্পনাও করতে পারি না।

ভোরের আলো ফুটতেই বাবা আমাকে নিয়ে কল পাড়ে এলেন। নিজে টিউবয়েল চেপে হাত মুখ ধুতে বললেন আমাকে। গলায়, কাঁধে সবজায়গাতে পানির স্পর্শ করাতে বললেন। কলের পানি আর আমার চোখের পানি এক হয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই বাধ মানাতে পারছি না।

বাবা ঘরে এসে নিজ হাতে চা করলেন দু কাপ। চা হাতে নিয়ে আামাকে নিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে এলেন। আমাকে ইশারায় চায়ে চুমুক দিতে বললেন । জিহ্বায় চায়ের চুমুকে কিংবা পায়ের তলে শিশির ভেজা ঘাসের কারণেই না-কি ভোরের এই স্নিগ্ধ বাতাসের কারণে সারারাতের মন খারাপটা অনেকটাই কেটে গেল।

‘এই মানুষটা আমার বাবা নন,' এ কথা ভাবতেই দুচোখ জলে ভর্তি হয়ে এলো। দ্রুত তা মুছে বাবার সাথে পা মেলাতে শুরু করলাম। ঘাটের কাছে এসে বাবা বসতে বললেন আমায়। ঝড়ে পড়া কিছু শিউলি সরিয়ে বসে পড়লাম শান বাঁধানো পুকুরঘাটে। ছোটো বেলাতে খুব পছন্দের জায়গা ছিল এটা আমার। মন খারাপ হলে, ভালো লাগলে, কান্না পেলে, মায়ের হাতে মার খেলে যে কোনো অনুভূতি প্রকাশের জন্য চলে আসতাম এই শিউলিতলায়। কথা বলতাম শিউলি গাছটার সাথে। সেখান থেকেই হয়তো বাবা কখনো আমার কথা শুনেছিলেন। এরপর থেকে যখুনি আমি এসে বসে থাকতাম বাবা এসে পাশে বসতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। কতদিন বাবা আর আামি এখানে বসে থেকেছি। বেশিরভাগ সময় ভোরের দিকেই আসতাম। সূর্য যতক্ষণ না পুকুরের পানিতে পড়ে চিকচিক করে আমাদের চোখ অন্ধকার করে দিচ্ছে ততক্ষণ আমরা বসে থাকতাম এখানে।

হঠাৎ করেই পুকুরটা ভাগ হয়ে যায় বাবা কাকাদের মধ্যে। এতটুকু একটা পুকুরে বাঁধ পড়লো। যার যার অংশ সে সে বাঁধ দিলো। পানি আটকা পড়লো, সাথে মাছ। মাছও বাঁচলো না, পানিও বাঁচলো না,  তার সাথে পুকুরটাও। শেষমেশ শুধু রয়ে গেল এই শান বাধানো ঘাট আর ঘাটের পাশে শিউলি গাছ। মৃতপ্রায় পুকুরের দিকে চেয়ে একটা হাহাকার কাজ করতো নিজের মধ্যে, সেই থেকে এই ঘাটে আসা বন্ধ করেছিলাম। আজ আবার এতদিন পরে। বাবা পুকুরের দিকে নির্দেশ করে বললেন, 'দেখেছিস?'

তাকিয়ে দেখি প্রতিটি অংশের বাঁধই ভেঙে পড়েছে।আবার এক হওয়ার পথে পুকুরটা। গত বর্ষার  জল রয়ে গেছে অনেকটা। নিজের অজান্তেই ঠোঁটে একটা স্মিত হাসি ফুটে উঠলো। যা বাবার দৃষ্টি এড়ালো না।বাবা বলে উঠলেন, ‘কোনো বাঁধই চিরদিনের জন্য নয় রে রাতুল। একদিন না একদিন তা ভেঙে পড়বেই। সে কথার বাঁধ হোক আর বাঁশের বেড়ার বাঁধ। আমি আজ তোকে কিছু কথা বলবো। হয়তো এরমধ্যে তুই অনেকটা জেনেও গেছিস। ভেবেছিলাম তুই আরো একটু বড়ো হলে, তোকে ঠান্ডা মাথায় এই কথাগুলো বলবো। যখন তুই কথাগুলো ঠিকঠাক বুঝতে পারেবি। কিন্তু এভাবে যে তা প্রকাশ পাবে আমি ধারণা করিনি।‘

বাবা বলতে শুরু করলেন, মাকে ঠিক কতটা ছোটো থাকতে ঘরে তুলেছিলেন তিনি। তারপর প্রায় বিশ ত্রিশ বছর পার হয়ে যায় কিন্তু তাদের ঘরে কোনো সন্তান আসে না। শাশুড়ির গঞ্জনা আর পাড়া প্রতিবেশীর কথায় কীভবে বিষিয়ে উঠেছিল মায়ের জীবন। ডাক্তার, কবিরাজ কোনো কিছু বাদ দেননি তারা। বাবা হসপিটালে কাজ করার সুবাদে কথা বলেছেন অনেক ডাক্তারের সাথে। শুধু দেশে নয় দেশের বাইরেও অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। শুধু মাঝখান থেকে টাকা গেছে আর টিটকারি শুনেছেন মানুষের। তারপরই তারা সিদ্ধান্ত নেন বাচ্চা এডপ্টের।

একদিন দেখা মেলে আমার গর্ভধারিনী মায়ের সাথে। আমাকে এবরশন করাতে এসেছিলেন মা।

* * * *

তখন সেখানকার কর্মরত ডাক্তার মায়ের কাছে কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ঘরে যেগুলো আছে সেগুলোর মুখেই ভাত জোটাতে পারেন না। নতুন আরেকজন আসলে তার কপালে ভাত জুটবে কোথা থেকে? তাই আমাকে পৃথিবীতে এনে কষ্ট দেওয়ার থেকে না এনে কষ্ট দেওয়ায় শ্রেয় মনে করেছিলেন আমার গর্ভধারিনী মা। মায়ের  কথা শুনে ডাক্তার আমার বাবাকে নিজের চেম্বারে ডেকে নেন।

বাবা সবকিছু শোনার পর বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে নিষেধ করেন। নিজেদের বাচ্চার জন্য হাহাকার তুলে ধরেন তার কাছে। বাচ্চাটা যেন তার গর্ভেই বড়ো হয়। বাচ্চার সব খরচ বাবা দিবেন। বাচ্চা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই তারা বাচ্চাটিকে নিয়ে নিবেন, এ কথাও জানান। আমার জন্মানোর জন্য শুধু আমার আপন বাবা মা-ই অপেক্ষা করেন না। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন আরো দুজন। অবশেষে সে শুভক্ষণ আসে, জন্ম হয় আমার। আমাকে কোলে তুলে নেন আমার এই মা। গর্ভধারিনী মাকে দেখতে বললে তিনি নাকচ করেন। যদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে আর না দিতে ইচ্ছে করে তার এই ভয়ে। আসার সময় বাবা আমার জন্মদাতা বাবাকে বারো হাজার টাকা দেন। অভাবের সংসারে যদি কোনো কাজে লাগে এইভেবে। আমার রিকসাচালক বাবা সে টাকা নিতে চাননি। টাকার বিনিময়ে তিনি তার সন্তানকে বিক্রি করতে চান না জানিয়েছিলেন বাবাকে। বাবা তার হাতে জোর করে টাকা তুলে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন টাকাটা ধার হিসেবে দিলেন। সামর্থ হলে টাকা যেন ফিরিয়ে দেন। 'এখন যেমন আমাদের এই বাচ্চাটা খুব দরকার, আপনার তেমন এই টাকাটা খুব দরকার। শুধু পার্থক্য থাকলো, আপনি একসময় এই টাকা আমাকে ফেরত দিবেন। কিন্ত আমি আপনার বাচ্চাকে ফেরত দিতে পারবো না।' কথাগুলো বলেই চলে এসেছিলেন আমার বাবা।

তবে আমাকে নিয়ে আসার পরেও মায়ের দুঃখ সবটা ঘোচেনি। আশেপাশের লোকজন আগে যেমন বলতো ,পরেও ঠিক তেমনি বলতে লাগলো। সেখানে নতুন করে যুক্ত হলো আমার কথা। সন্তানের মা হয়েও প্রতিবেশীরা তাকে সন্তানের মা না হওয়ার যন্ত্রণা ভুলতে দিলো না। মা আমাকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলেন কিন্তু দিন যত বাড়তে লাগলো আমি তত ডানপিটে হতে থাকলাম। আড়ালে আবডালে তত আমাকে নিয়ে কথা বাড়লো। আমার কান অবধি সবটা না পৌঁছালেও সেসব কথা মা’র কান অবধি ঠিকই পৌঁছাতো। তাই আমাকে মানুষ করার তার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল। সে শুধু চাইতো মা না হওয়ার যন্ত্রণা ভুলতে। মা আমার পরিচয়ে পরিচিত হতে চেয়েছিল। কিন্তু দিনদিন আমি নিজে নিজের পরিচয় তৈরি করছিলাম।

এসব শুনতে শুনতে আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো। বাবাকে কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। বাবাই আবার শুরু করলেন, মা, বাবার অনুপস্থিতিতে একা হাতে কীভাবে আমাকে সামলেছেন। দিনরাত খেয়াল রেখেছেন। অন্যের কথা থেকে বাচিঁয়েছেন। এই চরম সত্যটা যেন আমার কান অবধি না আসে সে চেষ্টা করেছেন।

সবকিছু বলার পর বাবা আমার দিকে যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, এখন আমি কী করবো, এটা আমার সিদ্ধান্ত। আমি যদি আমার বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাই, বাবা আমাকে ঠিকানা যোগাড় করে দিবেন। কেননা পরবর্তীতে বাবা খোঁজ নিয়ে দেখেছিলেন আমার বাবা-মা ওখানে থাকে না আর। আমি আর কিছু শুনতে পারলাম না, বলতেও পারলাম না। বাবার হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগলাম।

* * * *

সেদিনের পর মা আর কখনো আমার গায়ে হাত তোলেননি। আমিও আর গায়ে হাত তোলার মতো কিছু করেছি বলে মনে পড়ে না। সারাদিন ঘরের মধ্যেই থাকি। বন্ধু বান্ধব কারো সাথে যোগাযোগ নেই। খুব বেশি খারাপ লাগলে শিউলিতলায় গিয়ে বসে থাকি। মায়ের সাথে দেখা, কথা সবই হতো কদাচিৎ।

বাবা সেদিন আামার সাথে কথা বলার পর এসে মায়ের সাথে কথা বলেছিলেন। জানিনা বাবা সেদিন মাকে কী কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে মা যেন আমাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলেন। কথা বলতে চান না, তবে আমার প্রয়োজনীয় সবকিছু হাজির করেন আমার সামনে। এ যেন নিজের ঘরে থেকে আত্নীয়ের মতো থাকা। এইচএসসিতে যখন ভালো রেজাল্ট করলাম, ভেবেছিলাম মা খুব খুশি হবেন, হয়তো পুরোনো সবকিছু ভুলে আমাকে কাছে টেনে নিবেন। কিন্তু তেমন কিছুই দেখলাম  না। পাড়ায় পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ করা হলো। মৌলবী ডেকে বাড়িতে মিলাদ দেওয়া হলো, আরবি পড়া হলো। আমার জন্য গিফ্টও এলো। তবে মায়ের শীতলতা কমলো না। মা যেমন ছিলেন তেমনি রইলেন।

আজ ভার্সিটি এডমিশনের রেজাল্ট হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। রাস্তায় আসতে আসতে শুনতে পেলাম, অনেকে বলছে, ‘অমুকের ছেলের চান্স হয়েছে না? হ্যাঁ, হ্যাঁ কত কষ্ট করে মানুষ করলো ওর মা।‘ মনে মনে বলে উঠলাম এটাই কি তবে আমার পরিচয়ে বাবা মায়ের পরিচয়!

সেদিনই মা আমার চোখের সামনে ঘরে ঢুকলেন, আমার পছন্দের পায়েস নিয়ে। বছরখানেক ধরে এ বাড়িতে পায়েস বানানো হয়নি। কিছু না বলে মা আমার মুখের সামনে পায়েসের চামচ তুলে ধরলেন। আমার চোখের জল এসে পড়তে লাগলো পায়েসের বাটিতে। বাটি রেখে মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমিও মাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম, ‘আমাকে ক্ষমা করো মা।‘

'আমি এই সময়টারই অপেক্ষায় ছিলাম বাবা, যেদিন সবাই ভাববে আমি তোর মা, তোর পরিচয়ে আমাকে চিনবে। এভাবেই তোর পরিচয়ে পরিচিত হয়ে উঠবো আমরা।'