বিকালে ইস্কুল থেকে ফিরেই বইয়ের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে চিৎকার জুড়ে দেয় আমিনা...
- "আম্মিইইইইই... ও আম্মি কিছু নাস্তা দাও, খুব খিদা লাগসে।"
ছোট মেয়ের হাঁকডাক শুনে পিছনের উঠান থেকে তড়িঘড়ি ঘরে ঢুকে রুকসানা বিবি তার মেয়েকে বলে - "কেন রে আজকে ইস্কুলে কি মিডডে মিল দেয়নি নাকি? এত তাড়াতাড়ি খিদা লাগসে যে তোর?"
- "না আম্মি, দুপুরে ইস্কুলে খিচুড়ি দিয়েছিল, কিনতু তাও আজকে আমার খুব খিদা লাগসে, তুমি জলদি আমারে কিছু নাস্তা দাও।" আসলে গরীবের ঘরে পেটের খিদে তাড়াতাড়ি মিটে গেলে পরের খিদাটাও যে খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যায়, আর রুকসানা বিবি সেটা ভালো করে বোঝে বলেই সে আমিনাকে একটু কড়া ভাবেই বলে - “দাঁড়া,আগে তোর হাত পা ভালো করে ধুয়ে নে, তারপর তোর বুবুরা ঘরে ফিরুক তখন না হয় সবাইকে একসাথে নাস্তা দেব।" আম্মির গলায় কড়া সুর শুনে চুপ করে যায় আমিনা। চুপচাপ বইয়ের ব্যাগ তুলে রেখে হাত পা ধুতে চলে যায়। আমিনার দুই বুবু, বড় বুবু সাবিনা ফার্স্ট ইয়ারে পরে আর ছোট বুবু তুহিনা ক্লাস এইটে আর ছোট্ট আমিনা পরে ক্লাস টু'তে। সাবিনা, তুহিনা, আমিনা এই তিন মেয়ে আর ওদের আব্বু আসগড় আলিকে নিয়েই রুকসানা বিবির সংসার। ওদের আব্বু আসগড় কোনও এক কারখানায় ছোটোখাটো একটা কাজ করে, পাঁচ জনের এই সংসার কোনও মতে চালানোর মতো রোজগার করে। তবে সব সময় যে ঠিক মতো চলে তাও নয়। তিন মেয়ের পড়াশোনার খরচা দিনের পর দিন যেন বেড়েই চলেছে, তারপর বাজারে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাই রুকসানা বিবি মাঝে মাঝে ভাবে যে লোকের বাড়িতে কয়েকটা ঠিকে কাজ করবে। তাতে সংসারে কিছুটা সুরাহা হবে। কিনতু ওদের আব্বুর আপত্তিতে তা আর করা হয়না।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর আমিনার দুই বুবু ঘরে ফিরে এলে রুকসানা বিবি তিন মেয়েকে মুড়ি আর গুড় নাস্তায় দেয়। আর খানিক্ষন পরেই ওদের আব্বুও ঘরে ফেরে। আসগড় ঘরে ফিরে হাত পা ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাস্তা আর চা নিয়ে বসে। এই সময়টাই তিন বোনের ওদের আব্বুকে কাছে পাওয়ার সময়। চা আর নাস্তা খেতে খেতে ওদের আব্বু তখন ওদের সব কথা, সব দাবিদাওয়া শোনে। কারোর খাতা লাগবে, কারোর বই, কারোর বা ইস্কুলের ফিস জমা দিতে হবে। প্রতিদিন এসময়টা সত্যিই আমিনাদের তিন বোনের কাছে খুব প্রিয়। কাজ থেকে ফিরে নাস্তা করার সময়ই আব্বুকে ওরা একটু কাছে পায়। আম্মিও এই সময়টাতে হাতের সব কাজ ফেলে ওদের সাথে বসে একটু গল্প করে। নানান সুখ দুঃখের কথা হয় এই সময়। তা নাহলে তো খানিক পরেই যে যার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। আম্মিও রাতের রান্না আর আব্বুও টিভি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পরে। কোনো কোনো দিন এই সময়ে আব্বুও ওদের খুব সুন্দর সুন্দর গল্পও বলে।আব্বুর কোল ঘেঁষে বসে আমিনা আব্বুর গল্প শোনে।এই সময় আব্বুকে খুব সুন্দর লাগে আমিনার। আব্বু কাজ থেকে ফেরার আগে কি একটা সাবান মেখে স্নান সেরে ফেরে, আব্বুর গায়ে তখনো সেই সাবানের মিষ্টি গন্ধটা লেগে থাকে। ছোট্ট আমিনা আব্বুর গা ঘেঁষে বসে সেই গন্ধটা যেন চুরি করে নিতে চায়।
অথচ আসগড় আলির অবস্থা কিনতু চিরকাল এরকম ছিল না।একটা বিস্কুট এর কারখানায় ফোরম্যান পদে স্থায়ী চাকরি ছিল আসগড়ের। দুই মেয়ে সাবিনা আর তুহিনাকে নিয়ে সাজানো গোছানো সংসার ছিল ওদের। নির্দিষ্ট মাইনা ছাড়াও ওভারটাইম এর আয় ছিল, ফলে অভাব কাকে বলে সেভাবে জানতনা ওরা। সুখে, দুঃখে, হাসি আর কান্নায় দিনগুলো ভালোই কাটছিল ওদের। কিনতু ওদের নসীবে আল্লা বোধহয় এত সুখ লেখেনি। দুই মেয়ে, তাই একটা ছেলের আশায় আসগড় আর রুকসানা বিবি আরও এক সন্তানের জন্ম দিয়েছিল। কিনতু সেও মেয়ে হওয়াতে প্রথম প্রথম একটু ভেঙে পড়লেও "আল্লার দান" মনে করে পরে খুশি মনে তা মেনেও নিয়েছিল। কিনতু ওদের নসীবে দুর্যোগ নেমে আসে এর কিছুদিন পরেই।হঠাৎ করেই আসগড়দের কারখানাটা বন্ধ হয়ে যায়।প্রথম প্রথম কয়েক মাস জমানো টাকায় ওদের সংসার চলে। খুব আশায় ছিল আসগড়, যে আল্লার মেহেরবানিতে কারখানাটা আবার হয়তো চালু হবে। কিনতু বছর প্রায় ঘুরতে চলায় সেই আশা নিয়ে আর বসে না থেকে আসগড় ছোটোখাটো একটা কারখানায় অস্থায়ী কর্মীর এই কাজটা নেয়। তাতে কিছুটা হলেও পরিবারটা বাঁচে, কিন্তু মেয়েদের ভালো ইস্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এই সাধারণ ছোট ইস্কুলে ভর্তি করাতে হয়।
কয়েকমাস আগে খুব অসুবিধায় পড়ে গেছিল আসগড়। সাবিনার কলেজে ভর্তির সময় ছিল তখন।উচ্চমাধ্যমিকে ভালোই ফল করেছিল সাবিনা। কলেজে ভর্তির জন্য বেশকিছু টাকা লাগবে, মাসের প্রায় শেষের দিক, হাতে সেরকম কোনো টাকা নেই। অবশ্য আসগড়ের যা রোজগার তাতে মাসের প্রথম দিকটাও যে খুব স্বস্তিদায়ক ছিল, তা কিনতু নয়। আসলে সংসারে কোনও অতিরিক্ত খরচ এলেই তার যোগান দেওয়াটা আসগড়ের পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য। একটা সময় মনে হয়েছিল যে সাবিনাকে হয়তো আর কলেজে ভর্তিই করতে পারবে না। হয়তো পারতও না, যদি না ওই সময় আসগড়ের সহকর্মীরা এগিয়ে আসত।সেবার মনে বড় দুঃখ নিয়ে কাজে গিয়ে সহকর্মীদের সব বলাতে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে রফিক, স্বপন, বাবলুরা সবাই মিলে এগিয়ে এসে চাঁদা তুলে আসগড়কে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছিল। মেয়েদের কাছে ওদের আব্বুর ও মান রক্ষা হয়েছিল।
সকালে উঠে আসগড় আলি সবার আগেই কাজে বেরিয়ে পরে। তার কিছু পরেই তুহিনা আর আমিনা একসাথে ইস্কুল, আর তারপরেই সাবিনা কলেজে বেরিয়ে পরে। এরপর রুকসানা বিবি একটু ফুরসুৎ পায়। ছোটদুটো তো দুফুরে ইস্কুলেই ভাত খায়, তাই ওদের কিছু নাস্তা করিয়েই ইস্কুলে পাঠায় রুকসানা বিবি। সাবিনা দুটো ভাত খেয়ে তবেই কলেজে বের হয়। আজকে অবশ্য সাবিনা ভাত খেয়ে বের হয়না, অল্প নাস্তা করে বের হয়। আজকে নাকি ওদের কলেজে দুফুরের পরে আর ক্লাস নেই, তাই দুফুরে ঘরে ফিরেই ও আজকে ভাত খাবে।
মেয়েরা সবাই ইস্কুলে আর কলেজে বেরিয়ে গেলে রুকসানা বিবিও ওর সেলাইয়ের কাজ নিয়ে বসে পড়ে। সারাটা দুফুর ধরে সবাইকে লুকিয়ে লুকিয়ে ও এই কাজটা করে। কাছেরই কয়েকটা দর্জির দোকান থেকে সেলাইয়ের কিছু কাজ সংগ্রহ করে আনে রুকসানা বিবি। এই সময়টাতে কোনও কাজ না থাকায় আর বাড়িতেও কেউ না থাকায় এই সময়টাতেই ও সেলাইয়ের কাজগুলো সেরে নেয়। তাতে যে দুটো পয়সা ঘরে আসে তা দিয়ে সংসারের কিছুটা তো সুরাহা হয় বৈকি।
কলেজে ঢোকার সময় গেটের কাছেই ভাস্বতীর সাথে দেখা হয়ে যায় সাবিনার। এই কলেজে সাবিনার সবচেয়ে কাছের বনধু ভাস্বতী, খুব বড়োলোক ঘরের মেয়ে ও। ভীষণ ভালো মেয়ে। কলেজে ভর্তির পর প্রথম প্রথম সবার সাথে মিশতে পারত না সাবিনা, নিজেদের অবস্থার কথা ভেবে একটু কুণ্ঠাই বোধ করতো। ভাস্বতী নিজেই এগিয়ে এসে ওর সব লজ্জা, কুণ্ঠাই দূর করে দেয়। খুব সহজ ভাবে মিশে যায় সাবিনার সাথে। একদম আপন করে নেয় সাবিনাকে।ভাস্বতীর বাবা খুব উঁচু পদে সরকারি চাকরী করে।সাবিনার অবস্থার কথা ভাস্বতী সব জানে, কিনতু সেটা কখনই ওদের বন্ধুত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ভাস্বতী প্রতিদিনই নিজের পয়সা দিয়ে সাবিনাকে কিছু না কিছু খাওয়ায় টিফিনে। পয়সা এনে তা দিয়ে টিফিন খাওয়ার মতো সামর্থ্য যে সাবিনার নেই, সেটা ভাস্বতী ভালো করেই বোঝে। তাই সব দিক দিয়েই সবার থেকে সাবিনাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে, যাতে কোনো বনধুই ওকে হেয় করতে না পারে।
কলেজের গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই ভাস্বতী চুপি চুপি সাবিনাকে বলে - "আজকে তিন পিরিয়ড পরেই তো ছুটি, আমরা একসাথে বেরিয়ে একটা জায়গায় যাব, আর তোকে একজনের সাথে আলাপ করিয়ে দেব।"
- "কে রে? কোথায় যাবি?"
- "কে? সেটা তখনই দেখতে পাবি। অনেকদিন পরে ছুটিতে বাড়ি ফিরেছে ও। তাই আমার সাথে দেখা করতে আসছে।আমরা তিন জন মিলে একটা রেস্ট্রুরেন্ট এ বসবো, তারপর অনেক গল্প করবো।"
- "না রে আমি যেতে পারব না।আমি আম্মিকে বলে এসেছি যে দুফুরে ঘরে ফিরে ভাত খাব। দেরী হলে আম্মি ভীষণ চিন্তা করবে রে।"
- "কিচ্ছু হবেনা, বেশিক্ষণ দেরি করাব না তোকে, ওখানে আমরা গল্প করতে করতে কিছু খেয়েই বেরিয়ে পড়ব।আরে বাবা আমাকেও তো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে নাকি, তাই তারপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি বাড়ি ফিরব।
- "ঠিক আছে, তবে বেশিক্ষন বসবো না কিনতু।
ভাস্বতীর সাথে কে দেখা করতে আসছে তা মনে মনে আন্দাজ করে সাবিনা। এরপর তিনটে পিরিয়ড যেন ঝড়ের বেগে কেটে যায় দুজনার কাছে। কলেজ শেষে গেট থেকে বেরিয়েই ডান দিকে ঘুরে ফুটপাথ ধরে হাঁটা শুরু করে ওরা দুজনে। কিছুটা এগোতেই সাবিনা একজন সুদর্শন ছেলেকে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। ওকে দেখে ভাস্বতীর মুখ ও হাসিতে ভরে যায়।
- "আলাপ করিয়ে দিই, এ হলো সাবিনা, আমার সবচেয়ে কাছের বনধু আর ও হলো সুকল্যাণ, এয়ার ফোর্স ইঞ্জিনিয়ার, আমার একজন বিশেষ বনধু। আমার বৌদির খুড়তুতো ভাই।"
- "আপনার কথা অনেক শুনেছি ভাস্বতীর কাছে, আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো।"
শুনে ভালো লাগে সাবিনার, ভাস্বতীর হাতে একটা আলতো চাপ দিয়ে বলে -"কই, তুই আগে তো কখনও আমাকে বলিসনি ওনার কথা? ঠিক আছে তোরা কথা বলতে বলতে পিছনে আয়, আমি একটু আগে আগে হাঁটছি।"
-"ঠিক আছে।" বলে ভাস্বতী সুকল্যানের সাথে গল্প করতে করতে পথ চলতে থাকে, আর সাবিনা ওদের একটু আগে আগেই হাঁটতে থাকে। সাবিনার ভারি ভালো লাগে ওদের দুইজনকে পাশাপাশি দেখে।
-"খুব সুন্দর মানাবে ওদের দুজনকে।"একটু আনমনা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে ও।
কিছুটা এগোতেই হঠাৎ সাবিনা দেখে যে সামনের একটা ম্যানহোল খোলা, আর তার থেকে ময়লা তুলে পাশে ফুটপাথের একধারে ফেলা হচ্ছে। তাই ও ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নেমে পরে আর পিছন ঘুরে ইশারা করে ভাস্বতীদেরও জানিয়ে দেয়। খোলা ম্যানহোলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ম্যানহোল থেকে গায়ে এক রাশ ময়লা মাখা যে লোকটা এক বালতি ময়লা নিয়ে উঠে আসে তাকে দেখে সাবিনা যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। খুব আশ্চর্য হয়ে যায় ও। লোকটাকে দেখে ওর পা দুটো যেন আর নড়তেই চায় না, এটা কাকে দেখছে ও? কিছুই আর ভাবতে পারেনা সাবিনা।লোকটাও সাবিনাকে দেখে হতবাক হয়ে ওর দিকেই চেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠে সাবিনার। পিছন থেকে ভাস্বতীর ডাকে সম্বিৎ ফেরে ওর - "কি রে? কি হয়েছে তোর? এভাবে দাঁড়িয়ে গেলি কেন তুই? এত নোংরা এখানে, পাশে নোংরা মাখা একটা লোক। চল চল এগিয়ে চল।" সাবিনার হাত ধরে টেনে নিয়ে এগিয়ে যায় ভাস্বতী। কিছুটা এগিয়ে বলে -
- " কিরে সাবিনা কি হলো?তোর চোখে জল কেন? ওই নোংরা মাখা লোকটা তোকে কিছু বাজে কথা বলেছে নাকি?"
কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে সাবিনা বলে -
-"না রে কিছু না, কেউ কিছু বলেনি আমাকে। আমি এখনই বাড়ি ফিরে যাবো, আমার শরীরটা হঠাৎ খুব খারাপ লাগছে রে। তোরা দুজনে গিয়ে গল্প কর।"
কোনো রকমে নিজেকে ভাস্বতীর হাত থেকে ছাড়িয়ে এক ছুটে গিয়ে একটা বাস এ হাত দেখিয়ে উঠে পড়ে সাবিনা। ভাস্বতীও অবাক হয়ে যায়, কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা।
সাবিনারা চলে গেলেও নোংরা গাওয়ালা লোকটা তখনও নোংরার বালতিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সময় পাশ থেকে ওদেরই একজন এসে বলে -
- "কিরে, নোংরা ভরা বালতিটা নিয়ে এভাবে সংয়ের মতন দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা গিয়ে ফেলে দিয়ে আয়।কলেজের ডবকা ছুকরিটাকে দেখে তোর মাথাটা ঘুরে গেল নাকিরে?" খ্যাক খ্যাক করে একটা বিশ্রী হাসি হেসে চলে যায় লোকটা।
ওখান থেকে বাড়ি ফিরে দরজায় করা নাড়তেই দরজা খুলে দেয় রুকসানা বিবি।ভিতরে ঢুকে কোনো কথা না বলে শোয়ার ঘরে গিয়ে খাটের উপর শুয়ে পড়ে সাবিনা। একটু পরে রুকসানা বিবি ওকে ডাকতে আসে -
- "কিরে, হাত মুখ ধুয়ে জামা কাপড় পাল্টে নে, তারপর তো আমরা খাবো একসাথে।"
- "আমি খাবোনা আম্মি, আমার খুব মাথা ধরেছে, তুমি খেয়ে নাও।"
এই বলে বাথরুমে ঢুকে জোরে কল চালিয়ে কান্নায় ভেঙে পরে সাবিনা।
বিকেলে স্কুল শেষে এক এক করে আমিনা আর তুহিনা ঘরে ফেরে। দুজনকে নাস্তা দিয়ে ঘরের টুকটাক কাজ সারে রুকসানা।
- "খানিক বাদে ওদের আব্বু ফিরলে তখন না হয় একসাথেই চা আর নাস্তা দেব সাবিনাকে। কিনতু মেয়েটার যে কি হলো, সেই কখন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে শরীর খারাপ বলে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। থাক মাথা ব্যথা নিয়ে ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। ওর আব্বু এলে তখন না হয় ডেকে দেবো”
সন্ধ্যে প্রায় সাতটা বেজে যায়, কিনতু তখনও আসগড় বাড়ি না ফেরায় বেশ চিন্তায় পরে যায় রুকসানা বিবি।অবশ্য তার কিছুক্ষণ পরেই ঘরে ফেরে আসগড় আলি।অন্য দিনের মতো আসগড়ের চেহারায় ঔজ্বল্য ধরা পরে না রুকসানার চোখে। আসগড় ও কোনো কথা না বলে চুপচাপ সোজা বাথরুম এ চলে যায়।তারপর জামা কাপড় পাল্টে, হাত মুখ ধুয়ে বসার ঘরের চৌকিতে গিয়ে বসে।অন্যদিনের মতো মেয়েদের ও ডাকেনা আজ। মনের মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা নিয়ে রুকসানা বিবি চা বসাতে যায়।তারপর সাবিনাকে গিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তোলে -
- "সাবিনা ও সাবিনা ওঠ, দেখ তোর আব্বু ফিরেছে, যা বসার ঘরে যা, আমি তোদের চা আর নাস্তা দিচ্ছি। কিছুইতো খাসনি সেই দুপুর থেকে।"
ধীর পায়ে সাবিনা শোবার ঘর থেকে বসার ঘরের দিকে যায়। বসার ঘরে ঢুকেই আব্বুর সাথে ওর ছোখাচোখি হয়, ছোখ দুটো ছলছল করে ওঠে সাবিনার। তারপর আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা সাবিনা, দৌড়ে গিয়ে "আব্বু" বলে আসগড়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে কাঁদতে থাকে অঝোরে। আসগড়ের ছোখেও জল চলে আসে, নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে সেও। মেয়ের কান্না শুনে চা করে ফেলে রেখে ঘরে ঢোকে রুকসানা বিবি। সাবিনা আর ওর আব্বুকে একসাথে কাঁদতে দেখে কিছুটা অবাকই হয়ে যায়। কিছুই যেন বুঝতে পারেনা।
- "কি হয়েছে, কি হয়েছে তোমাদের? তোমরা কাঁদছো কোনো?" কিছুটা ভয়ে ভয়েই জানতে চায় রুকসানা বিবি।তুহিনা আর ছোট্ট আমিনাও একটু ঘাবড়ে যায়, আজকের এই সম্পূর্ণ অন্যরকম পরিবেশ দেখে। আম্মির প্রশ্নের কোনও জবাব না দিয়ে একটানা কেঁদে চলে সাবিনা। নিজেকে কোনোরকমে একটু সামলে নিয়ে আসগড় আলি ধীর ভাবে বলে ওঠে -
- "আমি বলছি... আমি বলছি সব কথা... সব সচ কথা।সাবিনাকে কিছুই বলতে হবেনা। এতদিন আমি তোমাদের সব ঝুট বলে এসেছি, মনে বড় ভয় ছিল সচ কথা জানলে যদি তোমরা আমাকে গ্রহণ না করো, যদি নফরত করো, তাই আমি তোমাদের এতদিন ঝুট বলেছি। আমি তোমাদের গুনেগার। কিনতু আজ আল্লার ইচ্ছায় আমি সাবিনার কাছে ধরা পরে গেছি।" অজানা এক ভয়ে কেঁপে ওঠে রুকসানা বিবির বুক।
- "বিসকুটের কারখানাটা বন্ধ হয়ে গালে যখন আমার কাজ চলে যায়, তখন চারিদিকে অনেক কাজ খুঁজেছি আমি, কিনতু পাইনি। প্রথমে আশায় আশায় ছিলাম, হয়ত আল্লার দোয়ায় আমাদের কারখানাটা আবার খুলে যাবে। কিনতু বেশ কয়েকমাস কেটে যাওয়ার পরে জমানো সব টাকা যখন ফুরিয়ে আসছিল, তখনও কোনও কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়েই আমি হাইড্রেন সাফাইয়ের কাজটা ধরি। প্রথম প্রথম আমারও খুব ঘেন্না লাগত। কিনতু তোমাদের কথা ভেবে, এই সংসারের কথা ভেবে ওই কাজে থেকে যাই। সারাদিন কাজের শেষে রাস্তার পাশের কোনও গোসলখানায় সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করে ঘরে ফিরি, যাতে তোমরা বুঝতে না পারো। আজকে সাবিনাদের কলেজের সামনেই কাজ ছিল, ভেবেছিলাম বিকালে ওর কলেজ ছুটির আগেই কাজ শেষ করে ওই জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে যাব। কিনতু আল্লার বোধহয় অন্যরকম মর্জি ছিল, তাই আর তা হলোনা, সাবিনার কাছে ধরা পরে গেলাম। হ্যাঁ আমি একজন সাফাইওয়ালা, সাবিনা, তুহিনা আর আমিনার আব্বু একজন সাফাইওয়ালা।
আসগড়ের কথা শেষ হতেই ঘরে যেন অদ্ভুত এক নীরবতা বিরাজ করতে লাগল। ছোট্ট আমিনা কিছু বুঝতে না পেরে সবার মুখের দিকে একবার করে তাকাতে থাকে। রুকসানা বিবি কি বলবে তা বুঝে উঠতে পারেনা।ওড়নার খুঁট দিয়ে ছোখ মুছতে থাকে। আসগড়ের পাশে গিয়ে ওর কাঁধটা শক্ত করে চেপে ধরে। সাবিনা ওর আব্বুর দুই হাত চেপে ধরে বলে -
- "না আব্বু তুমি আমাদের গুনেগার নও। তুমি আমাদের গর্ব। তুমি তখন ওই কাজটা না ধরলে আমরা যে কোথায় ভেসে যেতাম কে জানে। আমাদেরতো খাওয়াও জুটতনা, পড়াশোনাও হতোনা। ওই কাজ করেই তো তুমি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছ, এত বড় করে তুলেছ।"
তুহিনা একটু বড় হয়েছে, বোঝে সব, কিনতু আব্বুকে সে কি বলবে তা বুঝে পায়না।আব্বুর পাশে এসে বসে আব্বুর কোলে মাথা রাখে।আসগড় আলিও ওদের সবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, বোঝে যে এই লড়াইয়ে ওর পরিবার ওর পাশেই আছে।
ছোট্ট আমিনা এতক্ষন দূরে বসেই সব শুনছিল।সব্বাইকে একবার করে দেখছিল, কিনতু কিছুই বুঝতে পারছিলনা ও। সবাই আব্বুর পাশে গিয়ে বসেছে দেখে আমিনাও উঠে আব্বুর কাছে যায়, তারপর ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে আব্বুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে -
- "আব্বু ও আব্বু সাফাইওয়ালা কি গো?সাফাইওয়ালা কাকে বলে?"
- "যারা ময়লা, নোংরা পরিষ্কার করে তাদেরকেই সাফাইওয়ালা বলে।" বলে ওঠে আসগড়।
- "তাহলে তুমি কোন ময়লা পরিষ্কার করো আব্বু?"
চুপ করে থাকে আসগড়, ছোট্ট আমিনাকে আর এর চেয়ে বেশি কিছু বুঝিয়ে বলতে পারেনা। এবার রুকসানা বিবি নীরবতা ভেঙে ছোট্ট আমিনাকে কোলে নিয়ে আদর করে বলে -
- "তোমার আব্বু সঅঅঅব, সব ময়লা পরিষ্কার করে, এই সমাজের, এই পরিবেশের যত নোংরা, ময়লা, আবর্জনা আছে, সব তোমার আব্বু পরিষ্কার করে চারিপাশটাকে সুন্দর করে রাখে।
ছোট্ট আমিনা যেন আম্মির সব কথা বুঝতে পেরে আম্মির কোল থেকে নেমে আব্বুর কাছে গিয়ে আব্বুর গলা জড়িয়ে ধরে দুই গালে চুমু খেয়ে তার আব্বুকে বলে -
- "আব্বু, তুমি কি ভালো গো।"
আসগড় যেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওনা, তার ইদের উপহার, ছোট মেয়ের কাছ থেকেই পেয়ে যায়।