প্রবন্ধ

কবির মানসীঃ জীবনে ও সৃজনে (প্রথম পর্ব)



অমিতাভ বিশ্বাস


"অস্তমিত রবি...। অন্ধকার রাতের আলো খুঁজতে বেরিয়েছি। খুঁজতে খুঁজতে নিরালা সমুদ্রতীরে বিস্তীর্ণ বালুকণা। খুঁজতে খুঁজতে শান্ত নদীপারে একা দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষ ও তার জলে পড়া ছায়া... সেই ছায়াতে জিরিয়ে নেওয়া একটা ছৈ-হীন নৌকা...। নৌকার উপর বসে আছে আব্দুল মাঝি ও কবি। আর সেই নৌকাতে ফুটছে ভাত, আর ভাতের সাথে আলু... কলা... পটল আর বড্ড চেনা কবিটিও ফুটছে... ফুটছে... ফুটছে..."।

প্রতিটা অস্তিত্বকে ছুঁয়ে আছে সময়, যার অস্তিত্ব নেই - সে কালের গর্ভে নিমজ্জিত হয়। জীবনে চলার পথে বিভিন্ন পর্যায় ও পরিস্থিতি প্রসঙ্গকে টেনে আনে। কালের প্রেক্ষিতে যার প্রসঙ্গ আছে - সে টিকে রইল, আর যে অপ্রাসঙ্গিক - সে হারিয়ে গেল। সংযম পালের একটি কবিতাঃ

"মরে যাওয়ার আগে
একটা ভাষা তৈরি করে নিতে হবে, যাতে
মরে যাওয়ার পরেও
তোমাদের সাথে কথা বলতে পারি।
"

'আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো'। - আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মরে যাওয়ার আগে এরকম একটা ভাষা তৈরি করে গেছেন, যাতে আমাদের সাথে মরে যাওয়ার পরও অনায়াসে, অবলীলায় কথা বলতে পারেন।

"আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহল ভরে।
"

কিম্বা

"আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান
তার বদলে আমি চাইনে কোনো দান...।
"

আরও এক জায়গায় দেখি -
"মনে রবে কিনা রবে আমারে সে আমার মনে নাই,
ক্ষণে ক্ষণে আমি তব দুয়ারে, অকারণে গান গাই...।"

তাই তিনি লিখেছেন,
"যে ধ্রুবপদ দিয়েছি বাঁধি বিশ্বতানে
মিলাব তাই জীবনগানে।
গগনে তব বিমল নীল-হৃদয়ে লব তাহারি মিল,
শান্তিময়ী গভীর বাণী নীরব প্রাণে।
বাজায় উষা নিশীথকুলে যে গীতভাষা
সে ধ্বনি নিয়ে জাগিবে মোর নবীন আশা,
ফুলের মতো সহজ সুরে প্রভাত মম উঠিবে পুরে,
সন্ধ্যা মম সে সুরে যেন মরিতে জানে।
"

একাকীত্বে, শয়নে, স্বপনে, বিষণ্ণতায় চিত্ত যখন উদ্বেলিত হয়, তখনই আমরা রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হই। রবীন্দ্রনাথকে নিংড়ে আমরা বেঁচে থাকার পাথেয়, সঞ্জীবনী রস খুঁজে পাই। রবীন্দ্রনাথ যেন সেই অতিকায় পাতিলেবু, চৈত্রের চরম রৌদ্রে ঘোরাঘুরির পর যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি, বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় বসবার জন্য প্রাণটা আমাদের আনচান করে - সেই সময় পাতিলেবু চিপে একটু লবণ জলের শরবৎ খেলে প্রাণটা যেমন আরাম পায়... রবীন্দ্রনাথ যেন সেই অতিকায় পাতিলেবু কিংবা 'অক্ষর গাছ'।

রবীন্দ্রসাহিত্য এক দুর্বার ধারা - আমার আলোচ্য বিষয় - কবির মানসীঃ জীবনে ও সৃজনে। রবীন্দ্রনাথের জীবন বা শিল্প যেখানেই চোখ মেলি না কেন - আমাদের পথিক জীবনে তিনিই একমাত্র পাথেয়। বিস্ময়কর, উজ্জ্বল, অমোঘ এক দৃষ্টান্ত। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে কবি বিষ্ণু দে'র উচ্চারণ স্মরণ করা যাক - "প্রশংসা করার জন্য না হোক - গাল দেওয়ার জন্যও আমরা মাঝে মাঝে ঈশ্বরের নাম মুখে এনে ফেলি, রবীন্দ্রনাথও খানিকটা সেরকম - রবীন্দ্রবিরোধী সমালোচকদের কাছে। রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকে অতিক্রম করবার জন্য রবীন্দ্র সমালোচকদের প্রয়োজন হয়েছিল। রবীন্দ্রসৃষ্টিকে তন্নিষ্ঠ করে জানা, আর জানতে গিয়েই বিশ বাঁও জলে - ধনাত্মক তরঙ্গমালার অভিঘাতে - তীরে এসে রবীন্দ্র বন্দনা, পুনর্বার রবীন্দ্রনাথকেই আঁকড়ে ধরা..."।

মগ্নভাবে রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করলে আমরা তাঁর দ্বৈত সত্ত্বা বুঝতে পারি। অন্তরের রবীন্দ্রনাথ আর বাইরের রবীন্দ্রনাথ দুটি ভিন্ন সত্ত্বা। কবিতায়, উপন্যাসে, ছোটগল্পে ও নাটকে তাঁর বাইরের সত্ত্বাকে চিনতে পারি। প্রবন্ধ, পত্রসাহিত্য ও গানে তাঁর অন্তরের সত্ত্বাটা ভীষণভাবে অনুভূত হয়। অন্তরের যে আর্তি তিনি কাব্য, উপন্যাস, ছোটগল্প বা নাটকে গোপন করতে পারতেন - সেই আর্তি প্রবন্ধ, পত্রসাহিত্য বা গানে অনেকটাই যেন উন্মোচিত।

এখন প্রায়শই শোনা যায়, মানুষ ক্রমশ হৃদয়হীন হয়ে পড়েছে। প্রবল গতির যুগ এসে আমাদের ভিতরের সূক্ষ্ম আবেগগুলো ইচ্ছামতো মুছে দিচ্ছে। আর এটাই তো আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য - বদমেজাজি সময় মানুষকে ক্রমশ নিঃসঙ্গ করতে করতে কিনারে নিয়ে যাচ্ছে। গভীর ফাটলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আধুনিক মানুষ আজকের প্রজন্ম। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আমরা বিভিন্ন কবিদের লেখায় ও সাক্ষাৎকারে দেখতে পাই - ধোঁয়াশা না রেখে স্পষ্ট করে কথা বলার প্রবণতা। বিনয় মজুমদার এদের মধ্যে অন্যতম। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "বিশেষ কোনো এক নারীর মনে প্রেম জাগানোর জন্য তিনি কবিতা লেখেন।" আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন ও শিল্পীজীবন মহাকাশের প্রোজ্জ্বলিত রবির মতো অনেকটাই যেন উর্দ্ধে। রবি ঠাকুরের কবিতা, গান বা ছোটগল্প সম্পর্কে হয়তো একথা বলা যায় না - কেন না এগুলো সহজলভ্য ও সহজপাঠ্য, কিন্তু নাটক, প্রবন্ধ, ছবি, পত্রসাহিত্য বা উপন্যাসের রবীন্দ্রনাথকে বাস্তবের প্রখর দৃষ্টিতে সত্যিই আমরা এখন কতটা চিনি বা কতটা পড়ি - এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক উপন্যাসের সূচনায় লিখেছেন, "আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে, সন্ধ্যাবেলায় দীপ জ্বালার আগে সকালবেলায় সলতে পাকানো।" রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় (১৮৬১) দেবেন্দ্রনাথের বয়স ছিল পঁয়তাল্লিশ বছর, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের বয়স একুশ, মধ্যমপুত্র সত্যেন্দ্রনাথ উনিশ বৎসরের যুবক, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে বিলাতে যাচ্ছেন, পরবর্তী সন্তান হেমেন্দ্রনাথের বয়স সতেরো; জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বয়স তেরো। এই চার জ্যেষ্ঠ সহোদরের প্রভাব রবীন্দ্রনাথের উপর বিশেষভাবে পড়েছিল। "ধনীগৃহের রেওয়াজ মতো শিশুদের দিন কাটে ঝি-চাকরদের হেফাজতে। মাতা সারদাদেবী এই বৃহৎ পরিবারের কর্ত্রী - সবসময় মন দিতে হয় সংসারের কাজে - কর্তা থাকেন বিদেশে। পুত্রবধূরা ও কন্যারা নিজ নিজ শিশুদের সামলাতেই ব্যস্ত। রবীন্দ্রনাথ মায়ের, দিদিদের বা বউদিদের যত্ন খুব যে পেতেন তা নয়। ভৃত্যমহলেই দিন কাটে অযত্নে অনাদরে।" 'ডাকঘর'-এর অমলের মতো তাঁর দশা - ঘর থেকে বের হওয়া বারণ। ঘুরঘুর করলে চাকরদের কাজ বাড়ে, তারা শাসন করে।

ছাপার হরফে স্বনামে প্রকাশিত প্রথম কবিতা 'হিন্দু মেলার উপহার'। এটি ছাপা হয়েছিল দ্বিভাষিক 'অমৃতবাজার পত্রিকা'য় (১৮৭৫, ফেব্রুয়ারী)। তখন রবির বয়স তেরো বৎসর আট মাস। কবি 'জীবনস্মৃতি'তে লিখেছেন, "আমাদের শিশুকালে ভোগবিলাসের আয়োজন ছিল না বললেই হয়। মোটের উপর তখনকার জীবনযাত্রা এখনকার চেয়ে অনেক বেশি সাদাসিধা ছিল। ...ছিলুম স্রোতের শেওলার মতো - সংসার প্রবাহের উপরতলে হাল্কাভাবে ভেসে বেড়াতুম - কোথাও শিকড় পৌঁছায়নি - যেন কারো ছিলাম না, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত চাকরদের কাছেই থাকতে হতো, কারো কাছে কিছুমাত্র আদর পাবার আশা ছিল না।...শূন্যতার মাঝখানে বসে কেবলই চেয়ে থাকতুম আকাশের দিকে। ছেলেবেলায় বাস্তব জগৎ থেকে দূরে ছিলুম বলেই তখন থেকে চিরদিন আমি 'সুদূরের পিয়াসী'।"

উপনয়নের সময় (১৮৭৩, ফেব্রুয়ারী) রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল এগারো বৎসর নয় মাস। গায়ত্রী মন্ত্রের অর্থ বোঝার বয়স ঠিক নয়। তবু নতুন ব্রাহ্মণ হওয়ার পরে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করবার দিকে খুব একটা ঝোঁক হল। গায়ত্রীর প্রভাব তাঁর সমস্ত জীবনের ধর্ম সাধনায় ওতপ্রোত হয়েছিল। 'মানুষের ধর্ম' গ্রন্থের 'মানবসত্য' ভাষণে দেখি যে, জীবনের শেষ দিকেও তিনি স্মরণ করেছেন এই দিনের কথা - "তখন আমার বয়স বারো বৎসর হবে। এই মন্ত্র চিন্তা করতে করতে মনে হতো, বিশ্বভুবনের অস্তিত্ব আর আমার অস্তিত্ব একাত্মক।"

১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে বিলাত যাত্রার জন্য বোম্বাই গমন। আত্মারাম দাদানী পাংন্ডুরং-এর কন্যা আন্না তড়খড়ের সঙ্গে পরিচয়। এই পান্ডুরং পরিবারের ইংরেজিয়ানার জন্য খুব খ্যাতি। কবি লিখেছেন - সেই বাড়ির এক 'পড়াশুনাওয়ালা মেয়ে' আন্না তড়খড় 'ঝকঝকে করে মেজে এনেছেন তাঁর শিক্ষা বিলেত থেকে।' কবির সাথে মেয়েটির ভাব হয়ে যায়। কবি কাহিনী তর্জমা করে পড়ে পড়ে শোনান। শুনতে শুনতে তার অনেক অংশ মেয়েটির মুখস্থ হয়ে যায়। ১৮ বৎসরের সুদর্শন কবির প্রতি আন্না খুবই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কবিকে বলেন, "তুমি আমার একটি নাম দাও", কবি তাঁর নাম দিলেন 'নলিনী'। একটা কবিতায় ঐ নামটি গেঁথে দিলেনঃ "শুন নলিনী, খোলোগো আঁখি/ ঘুম এখনো ভাঙ্গিল না কি!/ দেখো তোমারি দুয়ার 'পরে/ সখী, এসেছে তোমারি রবি।..." আন্না কবির গান প্রায়ই শোনেন; তরুণ কবির কণ্ঠস্বর তাঁকে মুগ্ধ করে, তিনি রবির গান শুনে বললেন, "তোমার গান শুনলে আমি বোধহয় মরণদিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।" বৃদ্ধ বয়সে কবি বলেছেন, "সে মেয়েটিকে আমি ভুলিনি বা তার সে আকর্ষণকে কোনো লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি কোনোদিন। আমার জীবনে তারপরে নানান অভিজ্ঞতার আলোছায়া খেলে গেছে, বিধাতা ঘটিয়েছেন কত যে অঘটন, কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি গৌরব করে যে, কোনো মেয়ের ভালবাসাকে আমি কখনও ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি - তা, সে ভালোবাসা যে রকমই হোক না কেন।"

কৈশোরে রবীন্দ্রনাথের কাব্য পাঠের একমাত্র সঙ্গিনী ছিলেন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমবয়সী ছিলেন। এই নতুন বৌঠানকে কবি "জীবনের ধ্রুবতারা" বলে মেনেছিলেন।

মাতার মৃত্যুর পর কাদম্বরী কি করলেন রবীন্দ্রনাথ সে কথা জানালেন, "বাড়িতে যিনি কনিষ্ঠ বধূ ছিলেন তিনিই মাতৃহীন বালকের ভার লইলেন। তিনি আমাদিগকে খাওয়াইয়া পরাইয়া সর্বদা কাছে টানিয়া, আমাদের যে কোনো অভাব ঘটিয়াছে তাহা ভুলাইয়া রাখিবার জন্য দিনরাত্রি চেষ্টা করিলেন।"

দ্বিতীয়বার বিলাত যাইবার পূর্বেই রবীন্দ্রনাথের দু'খানি কাব্য প্রকাশিত হয়েছিল - 'ভগ্নহৃদয়' ও 'রুদ্রচন্ড'। ভগ্নহৃদয় কাদম্বরীদেবীকে উৎসর্গ করেছিলেন বেনামে, আর দ্বিতীয় বই রুদ্রচন্ড উৎসর্গ করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে। 'উৎসর্গ' কবিতায় বিলাতযাত্রার ভাবী বিচ্ছেদ বেদনা অত্যন্ত প্রকটভাবে ব্যক্ত।

কৈশোরে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচর্চার সঙ্গিনী ছিলেন কাদম্বরী দেবী। 'জীবনস্মৃতি'তে তার বিবরণ এরূপ - "সাহিত্যে বউ ঠাকুরাণীর প্রবল অনুরাগ ছিল। বাংলা বই তিনি যে পড়িতেন কেবল সময় কাটাইবার জন্য, তাহা নহে - তাহা যথার্থই তিনি সমস্ত মন দিয়া উপভোগ করিতেন। তাঁহার সাহিত্যচর্চায় আমি অংশী ছিলাম।"

প্রত্যেক কবিরই এমন একজন পাঠককে দরকার যার কাছে অনায়াসে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত বিনিময় করা যায় - যার কাছে কিছুটা প্রশ্রয় পাওয়া যায় - কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের ঠিক তেমনই একজন সাহিত্যচর্চা ও কাব্য পাঠের সঙ্গিনী ছিলেন। যদিও একটা ভিন্ন জনশ্রুতি আছে - যা নিয়ে 'আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ' বইতে নীরদচন্দ্র চৌধুরী আলোকপাত করতে চেয়েছেনঃ "কেহ কি দেবেন্দ্রনাথের কানে রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবীর মধ্যে অবৈধ প্রণয়ের কথা তুলিয়াছিল?"

(ক্রমশ)

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।