ইদানীং রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বহুতল বাড়িগুলির গ্রিল ঘেরা এক চিলতে ঝুল বারান্দার দিকে তাকালে দেখা যায় একা একা রাস্তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছেন কোনও নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা। তাদের ছেলে, বৌমা হয়তো সকালে কাজে বেরিয়ে গেছে। একমাত্র নাতি কিংবা নাতনি ইস্কুলে। ফাঁকা ফ্ল্যাটের পাহারাদার হিসেবে রয়েছেন বৃদ্ধ বাবা কিংবা বৃদ্ধা মা; তাঁরা কেউই রিমোট ঘুরিয়ে টিভি চালাতে পারেন না, আঙ্গুল ছুঁইয়ে স্মার্ট ফোনে কথা বলতে পারেন না। সুতরাং ফ্ল্যাটবন্দী অসংখ্য নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের একমাত্র মুক্তির জায়গা হল গ্রিলে ঘেরা ছোট্ট বারান্দা। সেখান থেকে অন্তত এক টুকরো আকাশ দেখা যায়, রাস্তার লোকজন দেখা যায়। ওই একফালি আকাশেই তাদের মনের মেঘ মুক্তির পাখি উড়ে উড়ে বেড়ায়।
বিশ্বের সমস্ত প্রবীণ মানুষদের সুরক্ষা, সামাজিক ন্যায় অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং এব্যাপারে গণসচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৯০ সালের ১ অক্টোবর তারিখটিকে 'আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। রাষ্ট্রসংঘের ঘোষণা করাই দস্তুর, সমগ্র বিশ্বের কোথাও এই দিনটিতে ষাট বছর বয়স উত্তীর্ণ প্রবীণ মানুষদের খোঁজখবর খুব বেশি কেউই রাখেন না।
তবে কেউ খবর রাখুন বা না রাখুন, বর্তমানে বিশ্ব নামক ভুবনগ্রামে বয়স্ক প্রবীণ মানুষদের সংখ্যা (ষাটোর্দ্ধ) কিন্তু ক্রমশ বেড়ে চলেছে। 'ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক' সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় জানিয়েছে যে, এই সময়কালে সমগ্র বিশ্বে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ৭০.৩ কোটি। শতকরা হিসেবে ৯%। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা দাঁড়াবে আনুমানিক ১৫০ কোটি থেকে ২০০ কোটি।
বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশ, ল্যাটিন আমেরিকায় ৯ শতাংশ, এশিয়ায় ৯ শতাংশ, ওসানিয়ায় ১২ শতাংশ, উত্তর আমেরিকায় ১৭ শতাংশ, ইউরোপ মহাদেশে ১৯ শতাংশ প্রবীণ মানুষ।
এই বিষয়ে 'ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক' জানিয়েছে যে - সারা বিশ্বে উচ্চ আয়ের প্রবীণ মানুষ রয়েছেন ১৯ শতাংশ, মধ্য আয়ের ৮ শতাংশ, নিম্ন-মধ্য আয়ের ৩ শতাংশ এবং নিম্ন আয়ের ৬ শতাংশ।
সমগ্র পৃথিবীতে জাপানেই সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষের সংখ্যা রয়েছে। সেখানে মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ মানুষ, ইতালিতে ২৩ শতাংশ, পর্তুগাল ও গ্রিসে ২২ শতাংশ, জার্মানিতে ২১ শতাংশ, ইংল্যান্ডে ১৮ শতাংশ, আমেরিকায় ১৬ শতাংশ, চিনে ১২ শতাংশ এবং ভারতে প্রায় ৯ শতাংশ প্রবীণ মানুষ রয়েছেন।
আমাদের দেশ ভারতে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ছিল ১০.৪০ কোটি। এর মধ্যে ৫.৩ কোটি পুরুষ এবং ৫.১ কোটি মহিলা। 'ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড' এবং 'হেল্পএজ ইন্ডিয়া' (এনজিও সংস্থা) সমীক্ষা করে জানিয়েছে যে ভারতে ২০২৬ সালে ষাট উর্দ্ধ বয়স্ক মানুষের সংখ্যা হবে প্রায় ১৭ কোটি ৩০ লক্ষ।
১৯৬১ সালে ভারতে মোট জনসংখ্যার ৫.৬ শতাংশ প্রবীণ মানুষ ছিলেন। ২০১১ সালে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ছিল শতকরা হিসেবে ৮.৬ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮.২ শতাংশ এবং মহিলা ৯ শতাংশ। ভারতের ৭১ শতাংশ প্রবীণ মানুষই গ্রামাঞ্চলে বাস করেন। আর শহরে বাস করেন ২৯ শতাংশ। ১৯৬১ সালে ভারতে পর-নির্ভরশীল বয়স্ক, প্রবীণ মানুষ ছিলেন ১০.৯ শতাংশ। ২০১১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৪.২ শতাংশ। এই সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই দেশের অসংখ্য প্রবীণ মানুষদের মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় ২০১৩ সালে মৃত্যু হয়েছিল ১৯.৭ শতাংশের। আর শহরাঞ্চলে প্রবীণ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ১৫ শতাংশের।
অসুস্থ প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ছিল ৩৬.৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ছিলেন ২০.৭ শতাংশ আর মহিলা ছিলেন ১৬.১ শতাংশ।
কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে এই দেশে বৃদ্ধ মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মারা গিয়েছেন। যদিও সঠিক সংখ্যাটা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি।
গ্রামীণ ভারতে এখনও ৬৬ শতাংশ বয়স্ক পুরুষ মানুষ কায়িক শ্রম করে কোনওমতে দিন গুজরান করেন। আর ২৮ শতাংশ মহিলাও কায়িক শ্রমের কাজ করে নিজের ভরণপোষণ করে থাকেন। শহর এলাকার ৪৬ শতাংশ পুরুষ এবং ১১ শতাংশ মহিলাও নিজের রোজগারের পয়সায় (অধিকাংশই কায়িক শ্রম) দিন গুজরান করে থাকেন।
ভারতে ১৯৯১ সালে, প্রবীণ মানুষদের মধ্যে সাক্ষরজ্ঞান ছিল ২৭ শতাংশের, ২০১১ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ শতাংশ।
ভারতে ৬০-৬৫ বছরের প্রবীণ মানুষের মধ্যে ৭৬ শতাংশ বিবাহিত এবং মহিলাদের মধ্যে ২২ শতাংশ বিধবা।
ভারতের রাজ্যওয়ারি হিসেবে কেরলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক, প্রবীণ মানুষ রয়েছেন, মোট জনসংখ্যার ১২.৬ শতাংশ, গোয়াতে ১১.২ শতাংশ, তামিলনাড়ুতে ১০.৪ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে ৭.১ শতাংশ। এই দেশে সবচেয়ে কম প্রবীণ মানুষ রয়েছেন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দাদরা নগর হাভেলিতে - ৪ শতাংশ।
আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ৭ লক্ষ ৪২ হাজার ৩৫৮ জন। যা মোট জনসংখ্যার ৮.৪৮ শতাংশ।
পশ্চিমবঙ্গের বয়স্ক প্রবীণ মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছেন কলকাতা মহানগরীতে ১১.৭৭ শতাংশ, উত্তর ২৪ পরগণায় ৯.৯৩ শতাংশ, হুগলিতে ৯.৮২ শতাংশ, নদীয়াতে ৯.৪০ শতাংশ এবং বাঁকুড়া জেলায় ৯.২৮ শতাংশ।
এই রাজ্যে যেসব বয়স্ক প্রবীণ মানুষ রয়েছেন, সাম্প্রতিককালে তাদের অধিকাংশই নিতান্ত সামাজিক অবহেলা, আর্থিক অনটন আর নিঃসঙ্গ অবস্থায় জীবনের শেষদিনগুলি অতিবাহিত করছেন। এর মধ্যে যারা সরকারি চাকরি করতেন এবং প্রতি মাসে ভাল পেনশন পান তাদের কিছুটা মূল্য রয়েছে পরিবার ও সমাজের কাছে। যদিও এইসব পেনশন পাওয়া প্রবীণ মানুষদের জন্যই সর্বত্র তৈরি হচ্ছে বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রম। এই রাজ্যে প্রবীণ মানুষদের নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবসা বেশ রমরমাভাবে চলছে এখন।
এর বাইরে যেসব পেনশন না পাওয়া প্রবীণ মানুষ রয়েছেন তারা অনেকেই পুত্র-কন্যার কাছে গলগ্রহ হয়ে বা বোঝা হয়ে বেঁচে রয়েছেন। এরা অনেকেই দু'বেলা পেটপুরে খাবার পান না তাই অপুষ্টির শিকার হন। সামান্য চিকিৎসাও অনেকের ভাগ্যেই জোটে না।
জীবনের উপান্তে এসে অনেকেরই 'পথের পাঁচালি'র ইন্দির ঠাকুরনের মতো অসহায় অবস্থা হয়।
এই রাজ্যে নিঃসঙ্গ অসহায় বয়স্ক প্রবীণ মানুষদের শেষ বয়সে একটু ভালোভাবে বাঁচার জন্য সরকারিভাবে জেলায় জেলায় বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারি বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হলে কিছুটা অল্প পয়সায় থাকতে পারবেন অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখাও জরুরি। মোট কথা এই রাজ্যের জেলায় জেলায় সরকারি বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হলে বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রমগুলিও একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারবে না। এছাড়াও, প্রবীণ মানুষেরা কথায় কথায় পুত্র, বৌমার দিন-রাত্তির খোঁটা, কিল, চড়, ঘাড়ধাক্কাও খাবেন না বোধ করি।
তাই জীবনের শেষ কটা দিন সুস্থভাবে বাঁচার জন্য, বয়স্ক প্রবীণ মানুষদের ঠিকানা সরকারি বৃদ্ধাশ্রম হলেও কোনও ক্ষতি নেই।
বস্তুতপক্ষে আমাদের রাজ্যের অধিকাংশ বয়স্ক প্রবীণ মানুষই বর্তমানে খুব কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন গুজরান করে থাকেন। তাদের শেষ বয়সে অনেকেরই দেখার কেউ নেই। আবার অনেকের সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার আর্থিক সামর্থ্য আদৌ নেই। তাই এই রাজ্যের, অসংখ্য বয়স্ক প্রবীণ মানুষদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আলো দেখাতে পারে সরকারি বৃদ্ধাশ্রম। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই রাজ্যের জেলায় জেলায় সরকারি উদ্যোগে বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করা ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
তাই সমাজের সর্বস্তরে উচ্চারিত হোক যে, বয়স্ক প্রবীণ মানুষরা তাদের পরিবার এবং সমাজের কোনও বোঝা নয়, তারাও মানুষ। সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা সবাই আশা করে একটু স্নেহ, ভালবাসার স্পর্শ। ইন্দির ঠাকুরণের মতো গলগ্রহ হয়ে কে আর বাঁচতে চায়?
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।