ঝাড়খন্ডের পালামৌ জেলার ছোটনাগপুর মালভূমিতে অবস্থিত বেতলা জাতীয় উদ্যান। আর এই জাতীয় উদ্যান থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে পালামৌ ফোর্ট। পালামৌ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলি হ’ল কোয়েল, সোন, ঔরঙ্গ। এখানকার প্রধান উৎপাদিত ফসল হ’ল ভুট্টা, আখ, ধান। মূলত লৌহ আকরিক অঞ্চল, তাই এখানে পাওয়া যায় বক্সাইট, লিথিয়াম, ডলোমাইট ও কয়লার মতো খনিজ। পালামৌ জেলা উত্তরে বিহার রাজ্য, পূর্বে হাজারিবাগ, দক্ষিণে লাতেহার ও পশ্চিমে গাড়োয়া দ্বারা পরিবেষ্টিত। কিছু পাহাড়ি বুনোফুল এই অঞ্চলকে গন্ধে মাতিয়ে রাখে। তাছাড়া, মহুয়া গাছের মাতাল করা সৌরভ তো আছেই। সাহিত্যের ছাত্রী হিসাবে পড়েছিলাম সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘পালামৌ’ উপন্যাসটি। লেখক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগদান ক’রে এই জেলায় গিয়ে দেখেছিলেন জায়গাটি শহর তো নয়ই, গ্রামও নয়। পাহাড় ও বুনোজঙ্গলে ভরা একটি অঞ্চল। এখানে সাহিত্যিক কোল সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রার পরিচয় দিয়েছেন। কোলদের বিবাহ হয় এবং পাহাড়ি নদীর মতো নিঃশব্দ ছন্দে তাদের জীবনও কেমন এগিয়ে যায় - কন্যা, স্ত্রী, মাতা, মাতামহীরূপে। এসব দেখেই সাহিত্যিক মন্তব্য করেছিলেন, “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”। অর্থাৎ এই জঙ্গলের অর্ধনগ্ন পোশাক পরা মানুষগুলিকে কখনও শহরের মানুষের সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। লেখক বিকেল ৪টে বাজলেই কেমন নেশাগ্রস্থের মতো পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখতে একা বসে থাকতেন লাতেহার পাহাড়ে।
এই তথ্য মাথায় নিয়েই ২রা নভেম্বর, ২০২৩ আমরাও গিয়েছিলাম পালামৌ ফোর্ট দর্শনে। আজ এত বছর পরেও এই অঞ্চল একইভাবে পাহাড়-জঙ্গলে ভরা। সাহিত্যের সঙ্গে বাস্তবতাকে মিলিয়ে নিতে প্রবেশ করলাম পালামৌ ফোর্টে। ঐতিহাসিকদের মতে চেল রাজারা এই স্থানে রাজত্ব করতেন এবং রাজা প্রতাপ রায় এই পালামৌ ফোর্ট নির্মাণ করেছিলেন। আর কিছুটা দূরে প্রায় দুই কিলোমিটার চড়াই রাস্তা অতিক্রম ক’রে রাজা প্রতাপ রায়ের পুত্র কেদার রায় আরও একটি ফোর্ট নির্মাণ করেন। কিন্তু, চড়াই-উৎরাই রাস্তা হওয়ায় এই দুর্গম দূর্গে বড়ো একটা কেউ ভ্রমণে যান না। তবে, রাজা প্রতাপ রায়ের দূর্গটি খুবই জনপ্রিয়। সবসময়ই খোলা থাকে। ভগ্নদশা সত্ত্বেও প্রতিটি কক্ষেই রয়েছে রহস্যের গন্ধ। খাড়াই সিঁড়ি যা দিয়ে ওঠা অত্যন্ত কষ্টকর। কিন্তু একবার উঠলেই কেল্লার উপর অংশ থেকে সমগ্র অঞ্চলকে পরিদর্শন করা যাবে। খিলান ও গম্বুজের সমারোহ দূর্গের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে। দূর্গের পিছনে রয়েছে ফাঁসির কুয়ো। এখানে ফাঁসি দেওয়ার পর মৃতদেহ বের ক’রে আনার সুড়ঙ্গ পথটিও স্পষ্ট চোখে পড়ে। ছটপূজা পালনের দিন এখানে ‘কিলা-মেলা’ বসে ও বহু মানুষের সমাগম হয়। তবে, আমার মনে হয় অবিলম্বে ঝাড়খণ্ড সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ নিয়ে এই দর্শনীয় স্থানটিকে রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত। না হলে সমস্তটাই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে অতীতের অন্ধকারে।
আজও পথের ধারে দেখা যায় কালো মিশমিশে শরীরের বালকগুলিকে লাঠি হাতে অথবা গাছের ডাল হাতে অর্ধনগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াতে। আর পুঁতির মালা গলায় দিয়ে, ব্লাউজবিহীন আটপৌড়ে ছোট শাড়ি কোমড়ে বেঁধে মাটির ঘরে ভাত রান্নায় আজও ব্যস্ত রয়েছে এইসব আদিবাসী রমণীরা। ওদিকে, আদিবাসী রমণরা আজও জঙ্গলের কাঠ সংগ্রহ অথবা ভুট্টা-আখ চাষ ও ছাগল-মুরগী পালনে ব্যস্ত রয়েছে। লাতেহার স্টেশন আছে এখান থেকে বহুদূরে। দিনের মধ্যে বোধহয় একটিই ট্রেন যায়। যাতায়াত বা যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে শুধুই বাইক অথবা ইঞ্জিন ভ্যান। কলকাতার আধুনিক সমাজজীবনে বসবাসকারী মানুষরা ধারনাই করতে পারে না কিভাবে বেঁচে আছে এইসব অঞ্চলের মানুষ - সূর্যোদয়ের সাথে যাদের কর্মজীবনের সূচনা হয় আর সূর্যাস্তের সঙ্গে যাদের একটি দিনের কর্মজীবনের ইতি। বিকেল ৫-৩০ বা ৬টা বাজলেই এইসব অঞ্চলে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার, শোনা যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।
আলোকচিত্রঃ লেখিকার কাছ থেকে প্রাপ্ত।