[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]
কাজী নজরুল ইসলাম বেগম সুফিয়া কামাল-এর সাথে। ১৯৭৪ সালে তোলা ছবি।
পর্ব - ৮
হুগলি থেকে প্রাণতোষের চিঠি এসেছে। দু'চার দিনের মধ্যেই কৃষ্ণনগরে আসবে লিখেছে। মনটা ভালো হয়ে উঠলো নজরুলের। প্রাণতোষ এলে ওকে নিয়ে দু'দিন বেশ ঘোরাঘুরি করা যাবে। ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা মেনে দূরে কোথাও যাওয়া হয়নি বটে, কিন্তু শহরের ভেতরেই এ ক'দিন ঘোরাঘুরি খুব একটা কম হয়নি। আড্ডা, আলোচনা, সান্ধ্য মজলিস কিছু না কিছু আছেই। তারকদাস, মঘা, গোবিন্দ, বিজয়লাল - সর্বক্ষণ কেউ না কেউ সঙ্গে আছে।
হুগলিতে শেষের দিকে কেমন একটা দম বন্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। শরীরে ঘন ঘন জ্বরের তান্ডব তো ছিলই, তার মধ্যেই কমিউনিস্ট ভাবনা-চিন্তা নিয়ে নতুন দল গড়ে তোলার উত্তেজনা, পত্রিকা নিয়ে নানান পরিকল্পনা। সাইনবোর্ডের জায়গায় আস্ত একটা লাঙল জোগাড় করে হ্যারিসন রোডের পত্রিকা অফিসে ঝুলিয়ে দিলেন নজরুল। শিক্ষিত সৌখিন নেতাদের কথার ফুলঝুরি নয়, সাধারণ কৃষক দেখুক - সত্যিকারের লাঙল নিয়ে পথে নেমেছে নব্য গঠিত শ্রমিক-কৃষক প্রজা পার্টি। হুগলির সেই সব চাপ থেকে কৃষ্ণনগরে এসে অনেকটাই হালকা বোধ করছেন নজরুল। আসার আগে 'লাঙল' পত্রিকাকে মোটামুটি একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে আসতে পেরেছেন - সেটাও একটা স্বস্তির ব্যাপার। মনিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের হাতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই করাচীতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে পরিচয়, যথেষ্ট যোগ্য মানুষ। ঠিক চালিয়ে নেবেন। তাছাড়া একমাসও হয়নি, প্রকাশের সাথে সাথে বাংলা জুড়ে 'লাঙল'-এর নাম ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে তাঁর 'সাম্যবাদী' কবিতাগুচ্ছ বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। 'বিদ্রোহী'র পরে বোধহয় 'সাম্যবাদী'ই এতো দ্রুত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একশো চার ডিগ্রি ছোঁয়া গা পুড়ে যাওয়া জ্বর, রাবণের দশটা মাথা একত্রিত হবার মতো যন্ত্রণা, তার ভিতরে সাম্যবাদী'র নামে ১১ খানা কবিতা - কী করে একনাগাড়ে টানা লিখে ফেললেন নজরুল নিজেই ভেবে অবাক হয়ে যান। সেই কবে থেকে লালিত স্বপ্ন - বলশেভিক লাল-ফৌজের মতো এদেশের মাটিতে সর্বহারা দরিদ্র মানুষ জেগে উঠছে। মুজফ্ফর আহ্মদ আর হেমন্তদার উৎসাহ - যন্ত্রণাকাতর মাথার মধ্যেও কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কাটছিল দিনগুলো।
কৃষ্ণনগরে আসা ইস্তক অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন যে 'বিদ্রোহী' নয়, সব জায়গায় 'সাম্যবাদী' নিয়ে বেশি চর্চা, কথাবার্তা। কৃষক-শ্রমিক প্রজা সম্মিলনীর নিজস্ব একটা নেটওয়ার্ক তো আছেই। 'লাঙল'-এর প্রথম সংখ্যা হাতে হাতে ছড়িয়েছেও কম নয়। তবু মনে হয় সংগঠনে সরাসরি যুক্ত না হয়েও পার্টির তরুণ ব্রিগেড অপেক্ষা বিজয়লালই যেন 'সাম্যবাদী'কে বেশি প্রচার করে দিয়েছে। ঝোলার ভিতর 'লাঙল'-এর কপি নিয়ে ঘোরে, সুযোগ পেলেই শহরের সুধী সমাজে বলে বেড়ায় - এই শোনো, আমাদের কাজীদার কবিতা! সেদিন হেমবাবুদের বাড়িতে মানী-গুণী মানুষের সান্ধ্য মজলিসে নিজেই উদাত্ত কণ্ঠে শুনিয়ে দিল - "গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!" সবাইকে শুনিয়েই বলল, "কাজীদা, বিদ্রোহী কবিতা আপনার নিজের। কিন্তু সাম্যবাদী আপনার নিজের নয়, ও আমাদের কবিতা। আপামর সাধারণ মানুষের কবিতা। 'বিদ্রোহী' পড়লে তার ভিতরে কবিকে দেখতে পাই - তেজোদ্দীপ্ত, বীর, বিদ্রোহী নজরুল! কিন্তু 'সাম্যবাদী' পড়লে চোখের সামনে ভেসে ওঠে হাজার হাজার সর্বহারা নিপীড়িত মানুষের ছবি। ও কবিতা এখন জনতার।"
বিজয়ের বলার ভঙ্গিটাও ভারি সুন্দর। রাজনীতি নয়, মানবিকতাও নয়, বলার মধ্যে একটা ব্যক্তিগত ভালোবাসার স্পন্দন, একটা উষ্ণতা অনুভব করেছিলেন নজরুল। বিজয়লালের রাজনীতির ধরনটাও কেমন একটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। মনেপ্রাণে বিপ্লবী, জেলখাটা স্বদেশী। অনন্তহরি মিত্রকে নিজে কৃষ্ণনগরে ধরে নিয়ে এলো - কিন্তু তাঁর সশস্ত্র বিপ্লবের পথকে বিজয় সমর্থন করেনি। ওর আশেপাশে গোবিন্দ, মঘার মতো তরুণ তুর্কি ছেলেরা আগুন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো উত্তপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার ভিতরে সে গান্ধীর অহিংস পন্থায় অটল, স্থির, দৃঢ়প্রত্যয়ী।
নজরুল নিজে কোনওদিনই অহিংস চরকা-পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না সেকথা বিজয়লাল ভালোই জানে। ইতিমধ্যে হেমন্ত সরকার, মুজফ্ফর আহ্মদ, কুতুবউদ্দিনদের সঙ্গে জোট বেঁধে কমিউনিস্টপন্থী দল গঠন করেছেন, মানবেন্দ্রনাথ রায় ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন - এসব কথাও তাঁর অজানা নয়। তবু প্রকাশ্য সভা সমিতিতে নজরুলকে নিয়ে তাঁর অকৃত্রিম উচ্ছাস নজরুলকে খুবই মুগ্ধ করে, বুকের মধ্যে একটা নিকটজনের ছোঁয়া লাগে।
হুগলিতে প্রাণতোষের মতো কৃষ্ণনগরে এখনও কেউ তেমন কাছের মানুষ হয়ে ওঠেনি বটে, তবু এই ক'দিনে এই শহরে আশেপাশে থাকা মানুষজনের বৈচিত্র্য, তাদের কর্মকাণ্ড, ভাবনার গভীরতা নজরুলকে একটা মুগ্ধতা এনে দিয়েছে। এই শহর যেন শিল্পীর সামনে রাখা একটা খুলে রাখা ক্যানভাস, সামনে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ - শিল্পী খুশিমতো তাঁর কল্পনাকে ক্যানভাসে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
গোলাপট্টির বাসায় স্থান সংকুলান নিয়ে কোনও সমস্যা নেই, যথেষ্ট পরিসর - শুধু রোদের বড় অভাব। অবহেলা আর অযত্নে পড়ে থাকা উঠোনটি মাসিমার হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঘরের মেঝের মতোই ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। তার শেষ প্রান্তে দুপুরবেলা এক ফালি রোদ ঘন্টা দুয়েকের জন্য দেখা দিতে আসে। ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চিঠিটা হাতে নিয়ে সেই রোদের আমেজ উপভোগ করছিলেন নজরুল। প্রায় দিনই তো দুপুরে খাওয়ার পর কারো না কারো ডাক আসে, বেরিয়ে যেতে হয়। আজ তেমন কোথাও যাবার নেই জেনে রৌদ্রে ইজি চেয়ারটা পেতে দিয়েছেন প্রমীলা দেবী। নিজেও পাশে ফোল্ডিং কাঠের চেয়ারখানা পেতে বসেছেন। শীতের দুপুরে এই রোদটুকু তাঁর একমাত্র প্রিয় মানুষটির জন্য মহামূল্যবান তো বটেই, তার চেয়ে বেশি মূল্যবান এই উষ্ণতাটুকু দুজনে পাশাপাশি ভাগ করে নিতে পারার সুযোগ পাওয়া।
চিঠিখানা পত্নীর হাতে দিলেন নজরুল, "দোলন, প্রাণতোষের চিঠি এসেছে। দু'চার দিনের মধ্যে আসবে লিখেছে"।
- তাই? এই ক'দিনেই মনে হচ্ছে কতদিন ওকে দেখিনি। খুব করেছে আমাদের জন্য ছেলেটা। জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা করে নৈহাটি পর্যন্ত এসে ট্রেনে তুলে দিয়ে গেল।
- এখানে এসে ওর কাছ থেকেই প্রথম চিঠিটা এলো।
প্রমীলা দেবী চিঠি থেকে চোখ ফিরিয়ে হাসলেন - "এবার তো চিঠি আসা শুরু হবে। বিজয়দা তো 'অমৃতবাজার'-এ ছাপিয়ে দিয়েছেন - 'কবি নজরুল অসুস্থ, বর্তমানে কৃষ্ণনগরে অবস্থান করিতেছেন। চাহিলে সেই ঠিকানায় যোগাযোগ করিতে হইবে!' "
দোলনের বলার ভঙ্গিতে নজরুলও হেসে উঠলেন। বললেন, "তুমি দেখেছ?"
"হ্যাঁ, টেবিলেই তো রাখা ছিল কাগজটা। খুলতেই চোখে পড়ল।" দোলন চোখ নাচিয়ে উত্তর দিলেন।
কিন্তু না, এই নিভৃত আরামে পাশাপাশি রোদ পোহানোর সুখটুকুও মহার্ঘ হয়ে উঠল। নৈঃশব্দের যাবতীয় রসভঙ্গ করে একটা আওয়াজ ভেসে এলো - "কাজীদা"!
ভিতরের বারান্দায় একটি দীর্ঘদেহী যুবক দাঁড়িয়ে। গিরিবালা দেবী নিশ্চয় ভিতরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলামের বাড়িতে ভিতর বাহির বলে কিছু থাকে না।
- আয় গোবিন্দ! কী ব্যাপার?
গোবিন্দপদ দত্ত। দোলনও আগে দেখেছে তাকে। কাছে এসে বলল - "কাজীদা, আজ সন্ধ্যাবেলা আপনার সংবর্ধনার একটা আয়োজন হচ্ছে, ছুতোরপাড়ার মাঠে"।
- সংবর্ধনা? আমাকে? কেন রে?
- বারে, বিদ্রোহী কবি কৃষ্ণনগরে এসেছে, আর শহরবাসী তাঁকে সংবর্ধনা জানাবে না?
- কিন্তু আমার সভা মানেই তো শুনছি পুলিশের টিকটিকি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোদের তো আরও ঝামেলা বাড়বে?
- কোতোয়ালি থানার টিকটিকিগুলো আমাদের আগে থেকেই চেনে। ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি রেডি থাকবেন মঘা এসে আপনাকে নিয়ে যাবে। বৌদি যদি সঙ্গে আসেন তো খুবই ভালো হবে।
প্রমীলা দেবী হেসে উঠে বললেন, "না বাপু, তোমরা বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে যাও। ঘর-সংসার নিয়ে থাকি, আমি তোমাদের বিদ্রোহী দলে নেই"!
(ক্রমশ)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।