দুলে দুলে অপু বর্ষাকাল রচনা পড়ছিল।
‘আষাঢ়- শ্রাবণ বর্ষাকাল । এই সময় ঘন কালো মেঘে আকাশ ঢেকে থাকে। মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে একটু পরিষ্কার হয়ে আবার মেঘ করে বৃষ্টি হয়। মাঝে মাঝে ঘরের বাইরে বেরোনো যায় না। নদী-নালা-খাল-বিল ভরে যায়।’
অপু , হঠাৎ পড়া থামিয়ে ঠাকুরদাদাকে প্রশ্ন করে, 'আচ্ছা দাদু এটাতো শ্রাবণমাস । কই এমন বৃষ্টি তো হল না? আমাদের বিলে তো জলই নেই। বই- তে কী ভুল লেখা?’
দাদু বলে, 'ভুল লেখা হবে কেন? আগে বইতে লেখার মতো বর্ষাকাল ছিল। প্রকৃতি ক্ষেপে গেছে। সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে। অবশ্য মানুষই প্রকৃতিকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। তুমি পড়।’
সালটা ছিল ২০২২। গ্রীষ্মের খরায় প্রাণ হাঁসফাঁসিয়ে ওঠে। ৪৫ ডিগ্রী তাপমাত্রা। গরমের এমন দীর্ঘ দিন শেষ হতেই চায় না। চাষের কাজে বিরাম নেই। চাষীর বিশ্রাম নেই। পয়লা চৈত্রে বৃষ্টি হওয়ায় পাট বুনেছিল। দুই একটা সেচ দিয়েছে কেউ। উপর ঝরা না হলে পাট বাড়ে না। খাল- বিল শুকিয়ে ঠাঠা করছে। মণিকুমার উপর মাঠে একবিঘে ভাগে চাষ করেছিল। সেচ দিতে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। এত তাপে পাটগাছ মরে যাচ্ছে। চাষীদের মাথায় হাত। পাট জাগ দেবে কোথায় ? উপায় একটা বের করেছে, জমিতেই হাঁটু পর্যন্ত গর্ত কেটে পলিথিন বিছিয়ে স্যালোমেসিনের সাহায্যে সরকারি নিয়ম অগ্রাহ্য করে জল তুলে, পাট জাগ দিল অধিকাংশ চাষী। খরচের টাকা উঠে আসবে না পাট বিক্রি করে। ফুলটুসির দাদা ফোন করে বলেছে , তাদের গ্রামে বেশ কয়েকটি বাড়িতে টিউবয়েলে জল উঠছে না। কী যে হবে ? গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কেনা জল পান করে। ব্যবহারের জল ও কী কিনতে হবে?
শরতের শেষে বৃষ্টি হয়ে চৈতালি ফসলের দফারফা হয়ে গেল। শীতকালও লুকোচুরি খেলেই কেটে গেল। শীতে চাষীদের নগদ অর্থের যোগান দিয়ে আসছে খেজুরের রস, গুড়, পাটালি। যত্নের অভাবে খেজুর গাছ অনেক কমে গেছে, গাছি অর্থাৎ শিউলীদের বড্ডো অভাব। কঠোর পরিশ্রমের কাজ। দুই/একজন কাজটি ধরে রাখার চেষ্টা করছে।
মণিকুমার এমনই একজন গাছি। সরকার আর মণ্ডল বাড়ির খেজুর গাছ ভাগে কাটে। নিজের দশটি খেজুর গাছ আছে। অকালে বৃষ্টি হওয়ায় গাছের ডাটা কেটে নলি পুততে অগ্রানের শেষ হয়ে গেল । রস নামতে পৌষের শেষ। শীত না পড়ায় , রস তেমন নামল না। বিশটা গাছে পাঁচ ভাঁড় রসও হয় না। আর্ধেক গৃহস্থকে দিয়ে আসতে হয়। ফুলটুসি রস জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি বানায়। খাঁটি জিনিস। দর বেশি হলেও পাটালি একবেলাও পড়ে থাকে না। আবহাওয়ার পরিবর্তন হওয়ায় রস-গুড়ের স্বাদ - সুগন্ধ আগের মত নেই। কয়েকটি গ্রামের মধ্যে ওই একটি বাড়িতে খাঁটি জিনিসটি পাওয়া যায়, তাই গাছি মণিকুমারের এলাকায় পরিচিতি বেশি। অন্য গাছিদের বক্তব্য - চিনি ছাড়া পাটালি হয় না। হাসে মণিকুমার । আখের গুড়, আলু সিদ্ধ ভেজাল দেয় তারা।
কুন্তী শীতকালে খাঁটি খেজুরের রস-গুড়ের টানে অপুদের গ্রামে যাবে বলেছিল। সে অপুর পিসির ননদ। বিয়ে-থা করেনি। মাস্টারি করে । ছুটি পেলেই গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে , ব্যাগপত্তর নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পাহাড় -সমুদ্র- মরু অঞ্চলে প্রতিবছরই ঘুরতে যায়। করোনার সময় আপনজন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে ত্রান নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে গেছে। তারপর থেকে দূর ভ্রমণের থেকে গ্রাম ঘোরার নেশায় পেয়ে বসেছে। অপুদের গ্রামে ২০০০ সাল থেকে আসছে। এখন বছরে দুবার আসেই। রবি ঠাকুরের গ্রামে বাঁধা বাংলাদেশের মূলসুরের সন্ধানে ফেরে। লেখালেখিও করে । সানন্দায় পূজা বার্ষিকে উপন্যাস বেরিয়েছে। কলকাতা বইমেলায় আনন্দ থেকে বই বেরোবে। কুন্তী অপুর ঠাকুরমাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় পৌষপার্বণের আগের দিন আসছে। কুন্তীর আগমণ বার্তায় বাড়ির সবাই খুব খুশি। মেয়েটি খুব সহজে সকলকে আপন করে নিতে পারে। বাচ্চাদের জন্য কতকিছু নিয়ে আসে।
কুন্তী মাজদিয়ায় দশটার ট্রেনে নেমে কাঁদি পুরের অটোয় উঠে বসল। রাস্তার দুই ধারে সর্ষে ফুলে মাঠ হলুদ হয়ে আছে। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। কুয়াশা চাদর সরিয়ে ঝট করে রোদ উঠে গেল। সর্ষেফুলে বিন্দু বিন্দু শিশির ঝলমলিয়ে উঠল। একজোড়া হলদেপাখি কাঠালগাছের ডালে বসে দোল খাচ্ছে। বাবুইপাখির ঝাঁক জলার উপর দিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। ছাতারের কিচিরমিচির, আমবাগানের মধ্যে ঝিঁঝিঁর রব - কুন্তীকে আনমনা করে দেয়। বুনো গন্ধ নাকে এসে লাগে। এত সবুজ ! প্রকৃতির কোমল স্পর্শ পেতেই ছুটে আসে বারেবারে। পিচের রাস্তা ছেড়ে ইটের রাস্তায় অটো নামতেই প্রবল ঝাঁকুনিতে কুন্তীর সম্বিৎ ফিরে আসে।
অটোওয়ালা বলে, দিদি এসে গেছি নামুন।
বাড়ির সামনে কুন্তী অটো থেকে নামতেই অপু দৌঁড়ে এল।
‘আমার রেলগাড়ি এনেছো?’
‘এনেছি, বাবা এনেছি।’
অপু কুন্তীকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো?’
কুন্তী উত্তর দেয়- 'খুব ভালোবাসি।’
অপু বলে, ‘আজ আমাদের গাছ কাটার পালা। তোমাকে খেজুরগাছ কাটা দেখতে নিয়ে যাব।’
‘অপু ওকে একটু বসে জিরিয়ে নিতে দে। ছ্যান -খাওয়াটা করে নিক। মা কুন্তী, বাথরুমে জল তোলা আছে। ছ্যান করে ভাত খায়ে নেও। কাল সংক্রান্তি। রাজ্যির কাজ পড়ে রয়েছে। জামাকাপুড় কাঁচা ধোয়া, ঘরদোরের ঝুল ঝাড়া, ল্যাপাপোছা । পিঠেপুলি বানানোর আয়োজন। কাজের কী শেষ আছে মা?’
অপু রেলগাড়ি পেয়ে খেলায় মেতে উঠল। কুন্তী স্নান-খাওয়া করে অপুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ফুলটুসিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সুন্দর সুন্দর বাড়ি তৈরি হয়েছে এদিকে। শহুরে অনুকরণে। ফুলটুসিদের টিনের চালের বেড়ার ঘর। মণিকুমার বাঁকে ভাঁড় ঝুলিয়ে খেজুর গাছ কাটতে যাচ্ছে। কুন্তী ও অপু সঙ্গে চলল মণিকুমারের।
কাঁধ থেকে বাঁক নামিয়ে মণিকুমার তরতর করে গাছে উঠে হেঁসো দিয়ে খেজুর গাছের চোখ কেটে , নলিরমুখ পরিষ্কার করে ভাঁড় ঝুলিয়ে দিল। ওমনি ফোঁটা ফোঁটা রস নলি বেয়ে ভাঁড়ে পড়তে লাগল।
কী অদ্ভুত! কুন্তী অবাক হয়ে যায়। এমন শুষ্ক গাছের মাথায় মিষ্ট রসে ভরা! আসার সময় ফাঁকা মাঠে রসের ভাঁড় গাছের মাঝামাঝি জায়গায় ঝুলতে দেখল। নলি থেকে একটা সুতো ভাঁড়ের মুখে ঝোলানো। পরে জানতে পারে রস নামানোর কষ্ট কমাতে এমন ব্যবস্থা।
গাছ থেকে নেমে মণিকুমার , কুন্তিকে বলে, ‘ দিদিমণি, রস খাওয়ার নেমন্তন্ন থাকল। সকালে চলে আসবেন।’
কুন্তী বলে ‘টাটকা রস খাওয়ার নেমন্তন্ন ছাড়ছি না। সক্কালবেলায় হাজির হব। তোমার টুসি আমাকে পাগলাতলায় নিয়ে যাবে বলেছিল। বলে দিও আগামীকালই যাব।
গাছ থেকে রস পাড়ার ছবি তোলার জন্য মোবাইলে পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়ে রাখল। বাড়িতে রাত বারোটা - একটায় ঘুমালেও এখানে আসলে দশটায় ঘুমিয়ে পড়ে। গ্রামের মানুষের রাত আটটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে যায়। টিভি সিরিয়াল পল্লিকে জাগিয়ে রাখে দশটা পর্যন্ত। ভোর চারটেয় মোরগ ডেকে উঠল ক-ক-কক করে। ঘুম ভেঙে গেল কুন্তীর। 'রাই জাগো, রাই জাগো’- প্রভাতী সঙ্গীত গেয়ে গেল শ্যামা বোষ্টমী। প্রাণ জুড়িয়ে গেল। কী মধুর সুর! টিনের চালে টুপটুপ করে শিশির পতনের শব্দ। পাখির কলতান- শিমূলতুলোর লেপের উষ্ণতা - না, কলকাতার ফ্লাটে যা শুধুই কল্পনা বিলাস! পৃথিবী জেগে ওঠার সাড়া পড়ে গেছে চতুর্দিকে। বাড়ির বড়োরা উঠে পড়েছে। কুন্তি উঠে পড়ল। হাতমুখ ধুয়ে ক্যামেরা নিয়ে চলল মাঠের দিকে। সঙ্গে ফুলটুসি। ঘন কুয়াশা। একটু দূরের জিনিসও অস্পষ্ট। মণিকুমার গাছে উঠে রসের ভাঁড় খুলে খালি ভাঁড়ের কানাচ গোঁজে আটকে দিয়ে নেমে আসছে। কুন্তী রস পাড়ার ভিডিও বানিয়ে নিল। ঠাণ্ডার মধ্যে গাছ থেকে রস পাড়া খুব কষ্টের। খালি পা, সামান্য একটা শীতের পোশাক। রস পাড়া শেষ হলে ভাগের ভাগ আড়াই ভাঁড় রস হল। রস জালের উনুন পাড়ে কুন্তিকে একটা টুল এগিয়ে বসতে দিয়ে, কাঁচের গ্লাসে রস ঢেলে দিল। কুন্তী এত ঠাণ্ডা রস কী করে খাবে ভাবছে, এর মধ্যে অপু এসে হাজির। উনুনের গরম হয়ে ওঠা রস স্টীলের গ্লাসে হাতা দিয়ে তুলে দিল অপুকে। অপু দৌঁড়ে পাটকাঠি ভেঙে নল বানিয়ে নিল। কুন্তীকেও একটা দিল। কুন্তীর দৃষ্টি জালার দিকে। শোশো আওয়াজ হচ্ছে । উপরটা সাদা ফেনায় ঢেকে গেল। হাতা দিয়ে কেটে ফেনা ভাড়ে তোলার পর রস গাঢ় লালচে হয়ে উঠল।
ফুলটুসি বলে, ‘তাতরসে ভেজানো পিঠে খুব সুস্বাদু- বলে খানিকটা তুলে রাখল একটা পাত্রে।’
আরও গাঢ় হয়ে সোনালী বর্ণ ধারণ করল। বীচকাঠি দিয়ে ঘেঁটে ঘেঁটে উনুন থেকে নামিয়ে, আরও ঘেঁটে ঘেঁটে গাঢ় হাল্কা হলুদ বর্ণ করে থালায় ঢালার পর পাটালী হয়ে গেল। নলেন গুড়ের গন্ধে বাতাস ম ম করছে।
কলাপাতায় খানিকটা গুড় তুলে মণিকুমার কুন্তীকে দিয়ে বলল, ‘খেয়ে দেখেন দিদিমণি নলেনগুড়ের স্বাদ কেমন?’
কুন্তী আঙুলের ডগায় গুড় তুলে মুখে দিয়ে বলল, 'অপূর্ব’। পাটালী বানানোর পুরো প্রসেসটা ভিড়িও করে নিয়েছি। দারুণ অভিজ্ঞতা হল।’
‘পাগলাবাবার থানে কীভাবে যাবে? বলে কুন্তী।
‘টোটোয় করে যাব। বারোটার সময় আসতে বলেছি।’
পাগলা বাবার থান মানে পাগলাখালি। পলদা নদীর তীরে অবস্থিত। হুদো নারায়ণপুরের ও-পারে পলদা নদীর তীরে বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই তাবৎ অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস খুব জাগ্রত স্থান এটি। পাগলা বাবা সকলের মনোবাঞ্ছা পূরণ করে। টোটো এসে গেল বারোটায়। কুন্তী অপু ফুলটুসি চলল পাঁচ লিটার দুধ নিয়ে পাগলাবাবার পূজো দিতে।
(ক্রমশ)