বিবিধ

ভারতবিশারদ ফ্রিডরিখ ম্যাক্স ম্যুলার



অমলেন্দু হাইত


ম্যাক্স ম্যুলার (Friedrich Maximilian Müller) শুধু ভারতবিশারদ নন, দার্শনিক, ধর্মতত্ববিদ, সমাজতত্ববিদ, সংস্কৃত ভাষার জার্মান পন্ডিত ও অনুবাদক।

ম্যুলার জন্মগ্ৰহন করেন ১৮২৩ সালের ৬ই ডিসেম্বর জার্মানির আনহাল্ট রাজ্যের রাজধানী ডেসাই শহরে। বাবা ছিলেন বিশিষ্ট রোমান্টিক কবি। মা ছিলেন বিপরীত মেরুর মানুষ, ঐ শহরের মুখ্যমন্ত্রীর মেয়ে।

ছোটবেলায় বাবাকে হারান, বাবার কবিতা, গান ভীষনভাবে তাঁর মনের মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল। হতে চেয়েছিলেন বাবার মত সঙ্গীতজ্ঞ। কিন্তু কিছু শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে সঙ্গীতের জগৎ ছেড়ে পড়াশুনায় মনোনিবেশ করেন।

১৮৩৬-এ স্কুলশিক্ষা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য লিপজিগ নগরে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিষয় বেছে নেন প্রাচীন ইউরোপীয় ভাষা, গ্ৰীক, ল্যাটিন, ফার্সি। ঘটনাচক্রে সেই বছর সংস্কৃত ভাষার নূতন পাঠ্যক্রম চালু হয়। তিনি ভীষনভাবে উৎসাহিত হয়ে প্রথম ছাত্র হিসেবে নাম নথিভুক্ত করেন। সংস্কৃত ভাষা শিখতে গিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়েও আলাদা করে সন্ধান শুরু করলেন। তারপর জীবনের সমগ্ৰ মোড়টাই ঘুরে গেল ভারতবর্ষের দিকে।

১৮৪৪ সালে ম্যুলার মাত্র ২১ বছর বয়সে প্রথম গ্ৰন্থ প্রকাশ করেন। সংস্কৃত ভাষায় লেখা বিষ্ণু শর্মার ভারতীয় উপকথা এবং হিন্দু ধর্মগ্ৰন্থ বেদ-এর হিতোপদেশের গল্পগুলি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। সংস্কৃত ভাষার টানে তিনি বার্লিন শহরে এলেন অধ্যাপক ফ্রাঞ্জ বোপের কাছে শিক্ষা নিতে। দেখা হল দার্শনিক ফ্রেডরিখ শিলিং-এর সাথে। সংস্কৃত ও দর্শনকে পাশাপাশি রেখে নিজেকে একটি পারমার্থিক জগতে প্রবেশ করালেন। সবচেয়ে বেশী সময় ধরে 'বেদ' নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। প্রফেসর শিলিং-এর অনুরোধে 'উপনিষদ' অনুবাদ করতে শুরু করেন। তিনিই ম্যুলারকে মহামূল্য একটি উপদেশ দিয়েছিলেন, "ভাষার ইতিহাসের সাথে ধর্মের ইতিহাসকে খুঁজতে হবে তবেই সম্পূর্ণতা পাবে।"

পরের বছর জার্মানি ছেড়ে প্যারিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেন সংস্কৃত ভাষাবিদ ইউগেনি বার্ণোফ-এর কাছে শিক্ষালাভের আশায়। তার সাথে দেখা হওয়ার পর ম্যুলার জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে পারলেন। বার্ণোফ ইংল্যান্ডে যে সংস্কৃতের পান্ডুলিপিটি পেয়েছিলেন সেটি ম্যুলারকে দিয়ে 'ঋগ্বেদ' প্রকাশের জন্য উৎসাহিত করেন। তিনি ভাবলেন সমস্ত তথ্য পেতে গেলে তাকে লন্ডনে যেতে হবে। যা ভাবা তাই কাজ। লন্ডনে চলে এলেন।

১৮৪৬ সালে তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস 'জার্মান লাভ' লন্ডনে প্রকাশ করেন। উপন্যাসটি তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয় সাহিত্য সমাজের সাথে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে যোগ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের শিল্প-সংস্কৃতিবিদ হিসেবে নিজের জায়গাটি তৈরী করেন এবং আমৃত্যু লন্ডন শহরেই থাকেন।

১৮৭৯ সালে প্রতাপ চন্দ্র মজুমদারের ইংরাজীতে লেখা 'শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ জীবনী' বইটি তার নজরে আসে। 'থেইস্টিক কোয়ার্টারলি রিভিউ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় 'দি হিন্দু সেইন্ট' নামে। মনে মনে ভাবলেন এই মানুষটিকেই তো তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে কল্পনামাত্র তিনি দেখতে পেতেন। বেশ কয়েক বছর পর ১৮৯৬ সালে তাঁর বিবেকানন্দের সাথে সাক্ষাৎ হয় পিমলিকোতে। আরাধ্যদেবতা যেন ধরা দিলেন বিবেকানন্দের মাধ্যমে। ১৮৯৮-তে ম্যুলার রামকৃষ্ণ পরমহংহদেবের ওপর জীবনীগ্ৰন্থ প্রকাশ করলেন 'Ramakrishna, His Life & Sayings' সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল পরমহংহদেবের কথা। লিও টলস্টয় থেকে গান্ধী, নেহেরু, শ্রীঅরবিন্দ পর্যন্ত।

বিবেকানন্দের আমন্ত্রণে তিনি ভারতবর্ষে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার রাজী হয়নি কারন তিনি ছিলেন ইংরেজদের ঔপনিবেশিকতার বিরোধী। আমৃত্যু তিনি কষ্ট পেয়েছেন ভারতে আসতে পারেননি বলে।

বিবেকানন্দকে দেখার পর বলেছিলেন, "ভারতবর্ষকে জানতে হলে বেদ-বেদান্ত পড়ার দরকার নেই শুধু বিবেকানন্দকে জানলেই হবে।"

আর একটি জায়গায় ম্যুলার বলছেন, "শুধু পান্ডুলিপি তৈরী করতে লেগেছে পঁচিশ বছর আর তা ছাপাতে লেগেছে কুড়ি বছর"। শুধু একটি বই-এর জন্য!

বিবেকানন্দ ম্যুলারকে নিয়ে বলছেন, "সায়ন আচার্যের (চার বেদের ভাষ্যকার) পুনর্জন্ম হয়েছে। তিনি স্বয়ং ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন"।

স্বামীজী ভারতবর্ষে আসার জন্য যখন তাঁকে অনুরোধ করেন, "বৃদ্ধ ঋষির মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তাহার নয়নে একবিন্দু অশ্রু স্ফুরিত হইল। তাহা হইলে আমি আর ফিরিব না, আমাকে সেখানেই সমাহিত কোরো"। ভারতবর্ষের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভালবাসা আর শ্রদ্ধা।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের সারথী হয়ে শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছিলেন তা শ্রীমদ ভাগবদ গীতা। সেই বাণীগুলি সহজ ভাষায় সংসারেবদ্ধ শোক-তাপ জর্জরিত মানুষকে বোঝাতে তিনিই রাম ও কৃষ্ণ রূপে এসেছেন, এটি ছিল পরমহংহদেবকে নিয়ে ম্যুলারের উপলব্ধি। তিনি ২১টি বই বৈদিক ব্রাহ্মন ধর্ম সম্পর্কে, ১০টি বৌদ্ধ ধর্ম, ২টি জৈন ধর্ম ছাড়াও ইসলাম, চৈনিক ও পারসিক ধর্ম সংক্রান্ত বই লিখেছেন।

১৮৯৮ সালে তাঁর রচিত সুবিশাল গ্ৰন্থ প্রকাশিত হয় ভারতীয় দর্শনের ওপর 'Six Systems of Indian Philosophy'.

সারা জীবনে বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। মহারানী ভিক্টোরিয়া ১৮৯৬ সালে ম্যুলারকে 'প্রিভি কাউন্সিলর' হিসাবে নিযুক্ত করেন।

বাঙালি লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরী ১৯৭৪ সালে তাঁর জীবন নিয়ে 'The Scholar Extraordinary: The Life of Professor The Right Honourable Fredrick Max Muller' বইটি রচনা করে 'সাহিত্য আকাদেমি' পুরষ্কার পান।

ম্যুলার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ভারতবর্ষে যেতে না পারাটা ইংরেজদের দেওয়া শাস্তি বলে মেনে নিলেও ইংরেজদের যে অত্যাচারের দিন ফুরিয়ে আসছে তা আগাম ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।

'Erasers' নিয়ে দুই প্রবাদপ্রতিম মানুষের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হল -

"Erasers are made for those who make mistakes" - Max Muller.

বিবেকানন্দ বললেন, "Erasers are made for those who are willing to correct their mistakes".

বিশাল মাপের মানুষটিও সমালোচনার উর্ধ্বে ছিলেন না। কিছু অর্বাচীন উগ্ৰবাদী হিন্দুরা বলে, "A Christian missionary in disguise, with a mission to eradicate Hinduism". এসবে মানুষটির আজ আর কিছু যায় আসে না।

২৮শে অক্টোবর, ১৯০০ খৃষ্টাব্দে তিনি ইহলোক ত্যাগ করে অমর্ত্যধামে যাত্রা করলেন। রেখে গেলেন তাঁর অমর সৃষ্টি। তামাম ভারতবাসী তাঁকে কুর্ণিশ জানিয়ে যাবে চিরকাল।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।