বিবিধ

সকলেই কবিতালেখক, কিন্তু সকলেই কবি নন (মুক্তগদ্য)



অভিজিৎ রায়


সকলেই কবি? নাকি কেউ কেউ? এই বিতর্কের যদি শেষ দেখতে হয় তাহলে আলোচনার শুরুটা এভাবে করা উচিত যে, কবিতা কি শিল্প?  নাকি যেকোনো শিল্পই কবিতা? কবিতা যদি শিল্প হয় তাহলে তার অবশ্যই একটি নির্মাণকৌশল থাকবে। যেমন, আর বাকি শিল্পগুলোর থাকে। এই নির্মাণকৌশলকে আমরা সেই শিল্পের ব্যাকরণও বলতে পারি।  কবিতার ব্যাকরণ এই শব্দবন্ধটিতে আমার অনেক অগ্রজ এবং বন্ধুরা সহমত নন।  কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, কবিতা একটি স্বতন্ত্র শিল্প, আর শিল্প হলেই তার নিজস্ব ব্যাকরণ বা নির্মাণকৌশল থাকতেই হবে। তবে কবিতার সংজ্ঞা নিরূপনের চেষ্টা বহুধাবিভক্ত কবি সমাজের মধ্যে অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি একথাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে শুধুমাত্র ভাষা, ছন্দ, অলংকার, অন্ত্যমিল - এগুলোই কবিতা নয়। এগুলোর সমষ্টিগত প্রয়োগে কবিতার নির্মাণকৌশল নির্দিষ্ট হয় এবং সেই নির্মাণকৌশলের সুচারু ব্যবহারে কবিতা পাঠ যোগ্য এবং স্মরণযোগ্য হয়ে ওঠে।

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে কবিতা লেখার জন্য নির্মাণকৌশল জানা যেমন  জরুরি ঠিক তেমনই জরুরি মানুষের ব্যক্তিগত ভাবনা, দূরদৃষ্টি এবং চিত্রকল্প সৃষ্টির অনায়াস ক্ষমতা। আমাদের মধ্যে অনেকেরই তা তিনি কবি হোন বা না হোন এই গুণটি আছে। যখন একজন মাছ বিক্রেতা 'রুপোর মত ইলিশ নিয়ে যান' বলে হাঁক পারেন, তখন তিনি কি কবিতার ভাষায় কথা বলছেন না? নিশ্চয় বলছেন। কিন্তু এইরকম বেশ কিছু শব্দবন্ধ পরপর সাজিয়ে দিলেই তিনি কবি হয়ে যাবেন না। প্রত্যেক কবিতারই একটি সামগ্রিক রূপ থাকে। কোনও একটি চমকপ্রদ পঙক্তি লেখার সুবাদে কাউকে কবি বললে, আমরা প্রকৃত কবিকে একাসনে এনে ফেলব - যা অনুচিত হবে। এরপর প্রাসঙ্গিকভাবেই এই প্রশ্ন চলে আসবে যে প্রকৃত কবি কে?  এর উত্তর আমার কাছে অন্তত একটাই। প্রকৃত কবি তিনিই যিনি কবিতাকে সাধনার বস্তু হিসাবে নিজের জীবনে নিয়েছেন। যাঁর কাছে, যাঁর জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনা, অনুভব, কল্পনা, ভাবনা সবই কবিতার নিমিত্ত। তিনি যা দেখছেন, শুনছেন, অনুভব করছেন সবই কবিতার শরীর হিসাবে তার  অবচেতনের  ভাবনায় সঞ্চিত করে রাখছেন সবসময়। কখনও সঞ্চয়ের সেই মুহূর্তেই জন্ম নিচ্ছে কবিতা আবার কখনও অনেক অনেক দিন পরে কবিতার জন্ম হচ্ছে সেই পুরনো সঞ্চিত অনুভবের স্পর্শে। তিনি এভাবে কবিতা সৃষ্টি করতে পারেন কারণ তিনি কবিতার নির্মানকৌশল রপ্ত করেছেন সাধনা করে।

অনেক সাধারণ মানুষ কবির মতো শব্দবন্ধ বা বাক্য রচনা করতে পারেন কিন্তু কবিতা লিখতে পারেন না। আমাদের মনে রাখতে হবে, কবিতা একটি শব্দবন্ধ নয়, একটি চিত্রকল্প বা একটি ছবি নয়।  কবিতা অনেক শব্দবন্ধ, অনেক চিত্রকল্প আর অনেক ছবির মধ্যে লুকিয়ে থাকা কখনও একটি সহজসরল ছবি, কখনও বহুমাত্রিক ছবি।

আমি খুব সুন্দর একটি তুলির  আঁচড় কাটলেও সেটা ছবি হবে না, কারণ আঁচড় কাটার পুনরাবৃত্তির কৌশল আমি জানি না, বা শিখিনি। এক আঁচড়ের সঙ্গে অন্য আঁচড়ের সংযোগে আরেকটি সুন্দর ছবি আঁকার কৌশল আমি শিখিনি বা জানি না। এই না শেখার ব্যাপারটা আবারও সেই শিল্পের ব্যাকরণের মধ্যে লুকোনো নির্মাণকৌশলের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে। সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় এই যে, অন্য সমস্ত শিল্পে নির্মাণকৌশল শিখে সেই নির্মাণের ধারা পরিবর্তনের জন্য শিল্পীরা নিজেদের প্রাণপাত করেন অথচ কবিতার ক্ষেত্রে এর বিপরীত ছবিই আমরা দেখি। কবিতা লেখকদের অধিকাংশই কবি যশপ্রার্থী হতে চাইলেও শিল্পের নির্মাণ কৌশল শেখার ব্যাপারে তাদের অনীহা লক্ষ্য করার মতো। সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রশিল্প - কোনও ক্ষেত্রেই নির্বোধের এরকম রমরমা আমরা দেখতে পাই না।  শুধুমাত্র কবিতার ক্ষেত্রেই শাস্ত্র জ্ঞান না-জানা মূর্খদের দাপাদাপি এবং পদবীর অধিকারে চিল্লাচিল্লি দেখতে পাই। দীর্ঘদিন ধরে বাংলা কবিতা বাজারে মধ্যমেধার কবিদের এত গুরুত্ব পাঠকেরা দিয়েছেন যে আজ আমরা ভয়ানক সমস্যার মধ্যেই এসে দাঁড়িয়েছি। মধ্যমেধার মানুষমাত্রেই খুব সহজে ক্ষমতার কাছে বিক্রি হয়ে যান আর তাই আজ খুব সহজেই 'এপাং ওপাং ঝপাং' শব্দবন্ধের লেখকও কবি শিরোনাম পেয়ে যান। পাঠক-শূন্য কবিতার বাজারে কবিরা এখন ক্ষমতার দয়া-দাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকার চেষ্টায় নানাভাবে শিরদাঁড়া বিক্রি করার পথে হাঁটছেন।  অনেকক্ষেত্রে অকবির বই উদ্বোধনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক বিখ্যাত কবি তাকে 'কবি' স্বীকৃতি দিচ্ছেন আবার অন্যদিকে আলো ঝলমলে সরকারি মঞ্চে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ ক্ষমতার আরও একটু প্রসাদ লাভের চেষ্টায়  রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা করছেন। এটা দুঃখজনক একই মঞ্চে আলো করে বসেছিলেন আরও অনেক জনপ্রিয়, প্রথিতযশা কবি।

মিথ্যা বলার দায়ে যুধিষ্ঠিরের রথের চাকা যদি বসে গিয়ে থাকে, তবে এইসব কবিদের কবিসত্তারও কিছু না কিছু ক্ষয় এই আপোষকামীতার মধ্যে দিয়ে হয়ে চলেছে।

যা কিছু কবিতা নয় তাকে খুব বলিষ্ঠ কণ্ঠে যিনি 'অকবিতা' বলে ঘোষণা করতে পারেন না তিনিও সময়ের ক্ষয়কার্যে একসময় কবি নাও থাকতে পারেন।

একজন কবির সাধনা শুধুমাত্র তার বোধের চর্চা বা নির্মাণ কৌশলের মধ্যে দিয়েই বিকশিত হবে এমন নয়। তার দার্শনিক জ্ঞান আর দুরদর্শিতার সাহচর্যে আপামর  পাঠক যখন তাদের চিন্তার বিকাশ ঘটাতে সমর্থ হবে তখনই একজন সাধক, একজন দার্শনিক, একজন ভাষাশিল্পী এবং সর্বোপরি একজন আবেগ-অনুভবের কবিতা-লেখক কবি হয়ে উঠবেন।

কালের বিচারে কোন লেখা কবিতা হিসাবে থাকবে আর কোনটা থাকবে না এ কথা বলতেই যখন আমরা কুন্ঠাবোধ করি না, তখন কাকে কবি বলা হবে আর কাকে হবে না তাই নিয়ে এত ক্ষোভ কীসের? তবে, এরপরও যিনি নিজের পরীক্ষায় নিজেকে উত্তীর্ণ করিয়ে দিয়ে নিজেকে কবি শিরোপা দিতে চান তাকে অবশ্যই কাব্যজগৎ স্বাগত জানাবে আর আমি নিজেকে শুধুমাত্র একটি কালোত্তীর্ণ কবিতা লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। সমস্যা অন্য জায়গায়, ডানদিকে হাঁটলে রাজ্যসভার সাংসদ হওয়া যায়, বাঁদিকে হাঁটলে বাংলার বিবেক, সবচেয়ে ভালো সরল সোজা পথ।

আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ...

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।