সাতের দশকে সুব্রত ভট্টাচার্যর সই প্রত্যাহারের ছবি। ছবি সৌজন্যঃ এবিপি ভায়া গুগলসার্চ।
বিগত শতাব্দীর সাত, আট এবং নয়ের দশকের কলকাতা ফুটবলের দলবদল নিয়ে কোনও লেখা লিখতে গেলে সেই সুদূর অতীতের অনুগামী হতেই হয়।
আমার কলকাতা ময়দানের ফুটবলে চোখেখড়ি হয়েছিল ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে। তখন দলবদল হত মার্চ মাসে, আইএফএ অফিসে। তখন বলত সুতারকিন স্ট্রীট, এখন যাকে বলে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রীট। সে অফিসটা এখনও হয়ত সেই একই জায়গায় আছে। কিন্তু "সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে" এখন আর বলা যায় না।
এই অফিসে বিগত শতাব্দীর সাত-আট-নয় দশকের দলবদলের (নাকি অদলবদল?) সেই মাউন্টেড পুলিস মুখরিত, মারমুখী পুলিশ শোভিত, ফুটবলবুভুক্ষু সমর্থক প্লাবিত ঝোড়ো মাতাল দিনগুলিই শুধু আজ আর নেই। সেই দিনগুলি বেঁচে ছবিতে, স্মৃতিতে আর সেদিনের সমর্থকদের চিরকালীন ফুটবল-রোমান্সে। সুতারকিন স্ট্রীট জুড়ে সেসব দলবদলীয় ইঁটপাটকেলের এক দু'টুকরো পাওয়া যেতেই পারে আজও, ঠিকমতো খুঁজলে। দলবদলের সময়ে উত্তাল হওয়া বিগত শতাব্দীর সাত আর আটের এবং নয়ের দশক জানে। দলবদলে ইঁটপাটকেলের বৃষ্টি ছিল স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার, সেই সময়। বড় টিমের ভাল খেলোয়াড় দল বদলালে এটা হতোই। যারা জানেন, তারা জানেন।
দলবদল শেষ হলেই এটা চুকে যেত। প্রিয় দলের খেলোয়াড়ের দলবদলের ক্ষোভ বিক্ষোভ সব এরপরে মীমাংসিত হত মাঠের মধ্যে। খেলোয়াড়রাও খেলেই সবকিছুর জবাব দিতেন। মাঠের বাইরে এসবের আঁচ পড়ত খুব কম। তখন সামাজিক মাধ্যম ছিলনা। ভাগ্যিস।
সাতের দশকের ১৯৭৩ সাল। আগের বছর মাঠ কাঁপানো মোহন সিংকে ইস্টবেঙ্গল দল থেকে ছিনিয়ে আনল মোহনবাগান এবং ঐ ১৯৭৩-এই আগের বছর সুপারফ্লপ সুভাষ ভৌমিক দল বদলে মোহনবাগান থেকে এলেন ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৭৩-এর ইতিহাস বলে, সুভাষ ভৌমিক ফাটিয়ে দিয়েছিলেন আর মোহন সিং চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১৯৭৪-এ সুরজিত সেনগুপ্ত মোহনবাগান ছেড়ে ইস্টবেঙ্গলে গিয়েছিলেন আর ঠিক উল্টো রাস্তায় হেঁটেছিলেন স্বপন সেনগুপ্ত। ১৯৭৫-এ হাবিব আকবরকে ইস্টবেঙ্গল থেকে তুলে নেয় মহমেডান। ১৯৭৬-এ তাদের নিজের করে নেয় মোহনবাগান। এই ১৯৭৬-এই সমরেশ চৌধুরীকেও তার ঘরের ক্লাব ইস্টবেঙ্গল থেকে তুলে নিয়েছিল মোহনবাগান, পরের বছরই ফিরে আসার আগে। এবং ১৯৭৭ সাক্ষী, ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডানে যান তরুণ বসু (১৯৭৫-এ মোহনবাগান থেকে ইস্টবেঙ্গলে যান) এবং ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে অশোকলাল ব্যানার্জী। ঐ ১৯৭৭-এই মোহনবাগানের কাছে ইস্টবেঙ্গল হারায় তখনও দুই ঘরের ছেলে গৌতম সরকার আর সুধীর কর্মকারকে এবং শ্যাম থাপাকেও। ১৯৭৮ জানে শ্যামল ব্যানার্জীর ইস্টবেঙ্গল থেকে মোহনবাগানে দলবদলের উপাখ্যান। এছাড়া ১৯৭৯-তে রঞ্জিত মুখার্জী আর তপন দাসকেও ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে যেতে হয়েছিল মোহনবাগানে, সমরেশ চৌধুরীকে যেতে হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডানে আর হাবিব-আকবরকে মোহনবাগান ছেড়ে মহমেডানে। এই ১৯৭৯-তে শেষবারের মত ইস্টবেঙ্গলে ফিরেছিলেন প্রয়াত সুভাষ ভৌমিক, মোহনবাগানের মায়া কাটিয়ে।
আটের দশক দেখেছিল ১৯৮০-তে সুরজিত সেনগুপ্তর নেতৃত্বে একঝাঁক ইস্টবেঙ্গলীর (ভাস্কর গাঙ্গুলী, চিন্ময় চ্যাটার্জী, শ্যামল ঘোষ, রমেন ভট্টাচার্য, প্রশান্ত ব্যানার্জী, সাবির আলি, মীর সাজ্জাদ, ডেভিড উইলিয়ামস) ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডানে যাওয়া। গোলকিপার সন্তোষ বসুর মোহনবাগান ছেড়ে মহমেডানে এবং মিহির বসুর ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানে যোগদান। ১৯৮১-তে মহমেডান থেকে মোহনবাগানে ফেরেন প্রয়াত সুরজিত সেনগুপ্ত। ভাস্কর গাঙ্গুলী, চিন্ময় চ্যাটার্জী, প্রশান্ত ব্যানার্জী, মিহির বসু ইস্টবেঙ্গলে ফেরেন ১৯৮২-তে। এই আশির দশক জানে ১৯৮১-তে মোহনবাগান ছেড়ে মহমেডানে যান প্রসূন ব্যানার্জী, মানস ভট্টাচার্য, বিদেশ বসু। ফিরে আসেন পরের বছর। আর ১৯৮৪-তে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানে গিয়ে ১৯৯০-এ উল্টোরথে চড়েন প্রশান্ত ব্যানার্জী। ১৯৮৫-তে বিকাশ পাঁজি আর কৃশানু দের মোহনবাগান ছেড়ে ইস্টবেঙ্গলে যাওয়া আর ১৯৯২-এ আবার উল্টোপথে ফেরা।এর উল্টোটাও ছিল। অলক মুখার্জীর ১৯৮৬-তে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানে যাওয়া আর ১৯৯১-এ মোহনবাগান ছেড়ে ইস্টবেঙ্গলে ফিরে আসা, ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪-এ আবার মোহনবাগানে খেলা এবং ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ নিজের অফিস দল এফসিআই-এর হয়ে মাঠ কাঁপিয়ে দীর্ঘ কেরিয়ারে শেষ অবধি দাঁড়ি টানা। ন'য়ের দশকে ১৯৯১-এ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য আর ১৯৯৫-এ তরুণ দে ঘরের ছেলের তকমা ছেড়ে মোহনবাগানে চলে যান। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৩ মোহনবাগানে, ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ ইস্টবেঙ্গলে, ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ আবার মোহনবাগানে, ১৯৯০-তে আবার ইস্টবেঙ্গলে আর সবশেষে ১৯৯১ ও ১৯৯২ মোহনবাগানে খেলা সুদীপ চ্যাটার্জী নিঃসন্দেহে ছিলেন ওই সময়ের দলবদলের 'ম্যান অফ দি ম্যাচ'।
১৯৯৭-১৯৯৮ থেকে ইউবি-র একছাতার তলায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের আসার পরে দলবদলের সেই বৃষ্টি আর ঝরেনি সেভাবে। এমনকি বাইচুং ভুটিয়ার দলবদল নিয়েও না। ২০১৮-তে অবশ্য সেই দলবদলের স্মৃতি, কিছুটা হলেও ফিরিয়েছিলেন মেহতাব হোসেন।
এখন সবকিছুই সহজলভ্য ও স্বচ্ছভাবে প্রকাশিত সামাজিক মাধ্যমের জন্য। তবু দল বদলানো খেলোয়াড়দের সফ্ট টার্গেট করা যায়, কোনদিনই ক্লাব কর্তাদের অচলায়তনে একটা আঁচড়ও কাটতে পারা যায়না, শত চেষ্টা করেও। যেখানে পোষায়, সেখানেই যান খেলোয়াড়রা। তাদের উপর না বর্ষিয়ে ক্লাব কর্তাদের অচলায়তন বদলে দেবার চেষ্টা করে দেখলে হয়ত কলকাতা ফুটবলের উপকারই হতো। ব্যারেটো ও ডং সে কথাই প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন।
এটা মনে রাখা ভাল যে, সবাই গোটা সিনিয়র কেরিয়ার এক বড় ক্লাবে খেলে যাওয়া শৈলেন মান্না, চুনী গোস্বামী, সুব্রত ভট্টাচার্য বা সত্যজিত চ্যাটার্জী অথবা তুষার রক্ষিত হননা। ময়দানী আবেগগুলো একদিনে তৈরী হয়না। ভিত্তি লাগে।আর সেটা জুগিয়ে গেছেন এঁদের মত চরিত্ররাই। ময়দান এটা সবচেয়ে ভাল জানে।
ময়দানের ঘাসে, হাওয়ায়, মাঠে, গ্যালারীতে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতীক হয়ে থেকে যান এঁরাই। দলবদলের নিয়মের ব্যতিক্রম হয়ে। কেউ মানলেও, না মানলেও। যারা জানেন, তারা জানেন।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।