শরীর একদিন যায়। শব্দ থাকে। শব্দের তেমন তেজ না থাকলে, সেই শব্দও মরে যাবে কালের নিয়মে। দীর্ঘ সময় ধরে মলয়দার শব্দের সেই তেজ বাংলা সাহিত্যে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। এবার হয়তো তাঁর ছড়িয়ে থাকা অপ্রকাশিত লেখার সম্ভার নিয়ে সম্পাদক থেকে প্রকাশকেরা মুদ্রণের প্রস্তুতি নেবেন।
সে যাই হোক, আমরাও একে একে অদৃশ্যে চলে যাবো। তারই অপেক্ষা। তখন কেউ দু' চারলাইন খবর লিখবেন। কেউ বিশেষ পাতা করবেন। ফেসবুক জুড়ে ছবিতে ছবিতে ছয়লাপ হবে। তাতে কী! মৃত্যুর পর বেঁচে থাকা খুব কম লেখকের জীবনে ঘটে। বলাবাহুল্য, সেই সংখ্যাটি হাতে গোনা যায়!
মলয়দা আমার খুব কম দিনের 'ফেসবুক বন্ধু' ছিলেন।
তারপর তাঁর প্রোফাইল থেকে আমি হারিয়ে যাই, অথবা তিনি আমার থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই সময়ের সাহিত্যজগৎ নিয়ে তাঁর অনুভব, প্রতিবাদ, ব্যাঙ্গ - এসব আমি কিছু দেখেছি এবং পড়েছি। একবার তাঁর টাইমলাইনে একদল মহিষের ছবি পোস্ট দিয়ে কবিদের উদ্দেশ্যে তীর্যক কথা লিখেছিলেন। এই সময় যা হচ্ছে, তারই প্রকট ছায়া।
সম্প্রতি একটি লিটল ম্যাগাজিনে অসামান্য একটি সাক্ষাৎকার পড়লাম। কবি কেদার ভাদুড়ীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। দিন তিনেক ধরে পড়লাম। খুব আফসোস, মৃত্যুর আগে কখনও মলয় রায়চৌধুরীকে আমি মুখোমুখি দেখিনি। আর দেখবোই বা কী করে, তিনি তো মুড়িমুড়কির মতো কবিসভায় যেতেন না।
তবে কেদারদাকে নিয়ে আমার সামান্য স্মৃতি আছে। আমি যখন পত্রিকা প্রকাশ করতাম, তখন পোস্ট কার্ডে লেখা আহ্বান করতাম। কেদারদা যত্ন করে তাঁর কবিতা পাঠিয়ে দিতেন বাই পোস্টে। একবারই ময়দানে কলকাতা বইমেলায় তাঁর মুখোমুখি হই। মদহীন আড্ডা দিই কিছুক্ষণ।
এখনকার প্রজন্মের কবিতা লিখিয়েরা কতজন এই কেদার ভাদুড়ীর নাম জানেন, সন্দেহ আছে। আর এই প্রজন্মের কতজন ঠিকভাবে মলয়-পাঠ করেছেন? হাংরি আন্দোলনের ইতিহাস নিয়েও নিবিড় পাঠ দরকার। না হলে শুধু কবিসভায় ছুটে, তালিতাপ্পা মেরে কবি হওয়া যায় না। আর এখন তো কোনো আন্দোলন-ফান্দোলন কিছুই নেই। যা আছে, কেবলই ছবি।
মলয়দাও ছবি হয়ে গেলেন! কেদারদা কবেই ছবি হয়ে গেছেন! শক্তি-সুনীল-দীপক-তারাপদ-শরৎ-সন্দীপন-অরুণেশ-তুষার কবে! হে মহাকাল তোমার গর্ভে প্রবেশের পর আবার একসঙ্গে হয়তো দেখা হবে। মলয়দা, আপনার কথা রাখতে পারিনি। যে দুই কবিকে নিয়ে গদ্য লিখতে বলেছিলেন, তা আর লিখতে পারিনি। হয়তো আর কখনও সেই গদ্য লিখতে পারবো না। এবার শুধু ফিরে পড়বার পালা। হয়তো তাও হবে না। হয়তো একদল মহিষের সঙ্গে মাঠে মাঠে চরে বেড়াবো। কালের রাখালও তার বাঁশি আমাকে বাজাতে দেবে না। বিষাদের সুর মিলিয়ে যাচ্ছে কোন অজানা আকাশে।
আপনার 'ফেসবুক বন্ধু' আশিস।
আলোকচিত্রঃ লেখকের কাছ থেকে প্রাপ্ত।