বিবিধ

রবীন্দ্র-কথা




অপরাধ-শিক্ষকদের-ছাত্রদের

ছেলেদের অপরাধকে আমরা বড়দের মাপকাঠিতে মাপিয়া থাকি, ভুলিয়া যাই যে ছোট ছেলেরা নির্ঝরের মতো বেগে চলে - সে জলে দোষ যদি স্পর্শ করে তবে হতাশ হইবার কারণ নাই, কেন না সচলতার মধ্যে সহজ প্রতিকার আছে, বেগ যেখানে থামিয়াছে সেইখানেই বিপদ - সেইখানেই সাবধান হওয়া চাই। এইজন্য শিক্ষকদের অপরাধকে যত ভয় করিতে হয় ছাত্রদের তত নহে।

অপ্রয়োজনের মূল্য ও সংসার

প্রয়োজনের দাবি প্রবল এবং তা অসংখ্য। কেন না, যতটা আয়োজন আমাদের জরুরি তা আপন পরিমাণ রক্ষা করে না। অভাব মোচন হয়ে গেলেও তৃপ্তিহীন কামনা হাত পেতে থাকে, সঞ্চয়ের ভিড় জমে, সন্ধানের বিশ্রাম থাকে না। সংসারের সকল বিভাগেই এই যে 'চাই-চাই'-এর হাট বসে গেছে, এরই আশেপাশে মানুষ একটা ফাঁদ খুঁজে যেখানে তার মন বলে 'চাই নে', অর্থাৎ এমন কিছু চাই নে যেটা লাগে সঞ্চয়ে। তাই দেখতে পাই প্রয়োজনের এতো চাপের মধ্যেও মানুষ অপ্রয়োজনের উপাদান এত প্রভূত করে তুলেছে, অপ্রয়োজনের মূল্য তার কাছে এত বেশি। তার গৌরব সেখানে, ঐশ্বর্য সেখানে, যেখানে সে প্রয়োজনকে ছাড়িয়ে গেছে।

অবকাশ

বস্তুবাদীরা মনে করে অবকাশটা নিশ্চল কিন্ত যাহারা অবকাশরসের রসিক তাহারা জানে বস্তুটাই নিশ্চল, অবকাশই তাহাকে গতি দেয়। রণক্ষেত্রে সৈন্যের অবকাশ নাই; তাহারা কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া ব্যূহরচনা করিয়া চলিয়াছে, তাহারা মনে ভাবে আমরাই যুদ্ধ করিতেছি। কিন্তু যে সেনাপতি অবকাশে নিমগ্ন হইয়া দূর হইতে স্তব্ধভাবে দেখিতেছে, সৈন্যদের সমস্ত চলা তাহারই মধ্যে। নিশ্চলের যে ভয়ংকর চলা তাহার রুদ্রবেগ যদি দেখিতে চাও তবে দেখো ঐ নক্ষত্রমন্ডলীর আবর্তনে, যুগ-যুগান্তরের তান্ডব নৃত্যে। যে নাচিতেছে না তাহারই নাচ এই-সকল চঞ্চলতায়।

অবকাশ ও আমরা

পেয়ালার যতটা চিনেমাটি দিয়ে গড়া ততটাই তার প্রধান অংশ নয়, বস্তুত সেটাই তার গৌণ, যতটা তার ফাঁক ততটাই তার মুখ্য অংশ। ঐ ফাঁকটাই রসে ভর্তি হয়, পোড়া চিনেমাটি উপলক্ষ্য মাত্র। ঘরের খুঁটিটা যেমন, গাছ ঠিক তেমন জিনিস নয়। অর্থাৎ সে কেবলমাত্র নিজের তলাটার মাটিতেই দাঁড়িয়ে থাকে না। তার দৃশ্যমান গুঁড়ি যতটুকু মাটি জুড়ে থাকে তার অদৃশ্য শিকড় তার চেয়ে অনেক বেশি মাটি অধিকার করে বলেই গাছটি রসের জোগান পায়। আমাদের কাজও সেই গাছের মতো; ফাঁকা অবকাশের তলা থেকে গোপনে সে রস আদায় করে নেয়। দশে মিলি তার সেই বিধিদত্ত অবকাশের লাখেরাজের ওপর যদি খাজনা বসায় তাহলে তার সেই কাজটাকেই নিঃস্ব করা হতে থাকে। এই জন্যেই দেশের সব সাময়িকপত্রে হরির লুঠের জোগান দেবার জন্যে অন্য কোনো দেশেই কবিকে নিয়ে এমনতরো টানাহ্যাঁচরা করে না।

অবকাশ ও সভ্যতা

কেবলমাত্র জীবিকা নির্বাহ করার জন্যে তো মানুষের মনুষ্যত্ব নয়। একান্ত জীবিকাকে অতিক্রম করে তবেই তার সভ্যতা। সভ্যতার সমস্ত শ্রেষ্ঠ ফসল অবকাশের ক্ষেত্রে ফলেছে। মানুষের সভ্যতায় এক অংশে অবকাশ রক্ষা করার দরকার আছে।

অন্ধতা ও সেবা

যে অন্ধতা মানুষকে পুণ্যের জন্য জলে স্নান করিতে ছোটায় সেই অন্ধতাই তাকে অজানা মুমূর্ষুর সেবায় নিরস্ত করে।

সৌজন্যেঃ অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।