গল্প ও অণুগল্প

আমার মা (তৃতীয় পর্ব) [ধারাবাহিক উপন্যাস]



অচিন্ত্য সাহা


।। ৩ ।।

দিদির বাড়িতে বসে মায়ের মুখে আরও একবার একখা শুনে আমার শৈশবের সেই স্মৃতি মনের মধ্যে জেগে ওঠে তখন আমিও সহ্য করতে না পেরে বলে উঠলাম - জানি তুমি আমাকে কোনোদিনই পছন্দ করো না। ঠিক আছে তুমি যা চাইছ তাই হবে। আজ থেকে মনে করবো এ পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, কেউ ছিলো না কোনোদিন। আমি এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা। তোমরা মনে কোরো আমাদের জয় নামে কেউ কোনোদিন ছিলো না, যে ছিলো সে মারা গেছে। মাকেও জানিয়ে দিলাম তুমিও মনে করবে তোমার ছটি সন্তান। একজন মারা গেছে। আজ থেকে আমিও সবাইকে বলবো আমার কেউ নেই, কিছু নেই, এ বিশ্বসংসারে আমি একা।

সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। কথা না বাড়িয়ে একবুক শূন্যতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশ্যে। শিমূলতলায় আমার এক বন্ধুর কাছে পৌঁছে ওকে সব ঘটনা বললাম। সে রাতটা ওর বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন বেরিয়ে পড়লাম অল্প ভাড়ায় কোথাও একটা ঘর পাওয়া যায় কীনা ভার সন্ধানে। ঘর পাওয়া যে সহজ ব্যাপার ছিল তা নয়। যেখানেই যাই কেউ অত অল্প বয়সের একটা ছেলেকে ঘরভাড়া দিতে চায় না, তাঁদের ধারণা আমি ঠিক সময়ে ভাড়ার টাকা দিতে পারবো না, অথবা আমাকে নিয়ে বাড়তি কোনো ঝামেলা হতে পারে তাই ভেবে পত্রপাঠ বিদায় করে দেওয়াই শ্রেয় আমি পড়লাম মহা সমস্যায়, বন্ধুর বাড়িতে থাকলে আমার স্কুল, টিউশনির ক্ষতি হয়। কেননা অত দূর থেকে পায়ে হেঁটে সবদিক সামলানো কষ্টকর। এদিকে হাতে মাত্র কুড়ি পয়সা সম্বল। টিউশনির টাকা পেতে এখনো দিন পনের বাকি। একটা পরিচিত দোকান থেকে মাঝে মধ্যে ধার করে মুড়ি চানাচুর অথবা পাউরুটি বিস্কুট খেয়ে দিন কাটে। কোনো কোনো দিন শুধু টিউবওয়েলের জল খেয়েও কাটিয়ে দিতে হয়। অবশেষে অনাদি নগরের এক খ্রিস্টান বাড়িতে মাসিক পনের টাকার বিনিময়ে একখানা ঘর পাওয়া গেল। বাড়িওয়ালা মেশোমশাই জাহাজে চাকরি করতেন, প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী তিনি। নিজের চেষ্টাতেও সম্পত্তির পরিমান বাড়িয়েছেন, কঠোর পরিশ্রমী মানুষ। মাসিমা সেই গরবে গরবিনী। তবে উভয়েই মানুষ হিসেবে চমৎকার। ওঁরা বললেন "বাবা তুমি ছেলেমানুষ প্রখম তিন মাসের ভাড়া দিতে হবে না। তাছাড়া তোমার তো রান্না করার জন্য কোনো বাসনপত্রও নেই। কদিন নাহয় আমাদের কাছে খেয়ে নিও।"

আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম "তা হয় না মাসিমা, আপনারা আমাকে ঘরভাড়া দিয়েছেন, এটাই আমার কাছে অনেক বড়ো। আমি দুই একদিনের মধ্যেই কিছু একটা ব্যবস্থা ব্যবস্থা করে নেবো।"

ওঁরা বুঝতে পারলেন এ ছেলে অন্য ধাতুতে গড়া। বাসনপত্র নেই, শোবার জন্য বিছানাপত্র নেই, থাকার মধ্যে আছে মাত্র কুড়ি পয়সা এবং একসেট জামাপ্যান্ট আর একটা স্কুল ইউনিফর্ম। মাসিমা গরু পুষতেন, তার খাবারের জন্য ছিল বিচুলি। মাসিমা কয়েক আঁটি বিচুলি এবং একটা চটের বস্তা দিলেন। আমার বন্ধু ওর বাড়ি থেকে ওর মায়ের একটা পুরনো ছেঁড়া শাড়ি এলে দিল। বিচুলি বিছিয়ে তার ওপর চট এবং শাড়ি পেতে বিছানা বিছিয়ে নিলাম। সদ্য সদ্য টিউশনির টাকা পেয়েছি, সেই টাকা সাথে নিয়ে দুই বন্ধু মিলে চলে গেলাম পাল্বতীর্থ হোটেলে। অনেক দিন পর পেট ভরে দুটো ডালভাত খেলাম। চলতে থাকলো আর এক জীবন সংগ্রাম। এখানে এসে ছাত্র সংখ্যা বেড়ে গেল। একে একে সংসারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে শুরু করলাম। কয়লার উনুনে ভাত ডাল আলু সেদ্ধ বা ডিমসেদ্ধ চাপিয়ে পড়াতে বসতাম। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে রান্নাটা দেখতে হতো। পড়ানো শেষ হলে স্নান সেরে খাওয়া দাওয়া করে স্কুলের পথে রওনা দিতাম। পৃথিবীর এই ঊষর ভূমিতে একা একা বেঁচে থাকা যে কতটা কষ্টকর তা খুব অল্প সময়ে বুঝতে পারলাম। তবুও সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে মনে মনে ধারণ করে, মনোবল অটুট রেখে এগিয়ে চললাম আমার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। এই সময় ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘটনা না বললেই নয়। আমার সহপাঠী আসিফ বললো তাদের বাড়িতে একটা ঘর পড়ে আছে। আমি যদি মনে করি তাহলে সেথানে গিয়ে থাকতে পারি। আমি আসিফের চোখে দেখেছিলাম আমার প্রতি তার ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। আমি না বলতেই ও খানিকটা মনোক্ষুণ্ণ হলো। ওকে অনেক বোঝালাম। আমার অসহায়তার কথা জানালাম, ওর মহত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে সেটা বললাম। এরপরে একদিন ও ওর বাবাকে নিয়ে এলো। আসিফের বাবা বড়ো ভালোমানুষ। তিনি ব্যাপারটা বুঝলেন। বললেন "না বাবা, তুমি তোমার দখে চলো, তোমার স্বাধীন ইচ্ছায় আমি কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে চাই না। তবে কোনো প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমাকে জানিও।"

আমার বাড়িওয়ালী মাসিমা মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নেন আমি কী রান্না করছি, কী খাচ্ছি সব ঠিকঠাক চলছে কীনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার সহপাঠী অপর এক বন্ধুর বদান্যতায় জুটে গেল একটা লজঝড়ে মার্কা সাইকেল। ওর কাকু নেভিতে চাকরি করতেন, তাঁর একটা পুরনো ভাঙাচোরা সাইকেল ছিলো। আমি কাকিমার দুই মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নিলাম। আমার যাওয়া-আসার সমস্যার কথা বিবেচনা করে তিনি ওই অব্যবহৃত পুরনো সাইকেলটি দিলেন। সেটিকে কাঁধে তুলে দোকানে নিয়ে গেলাম। প্রায় শ'দুয়েক টাকা খরচ করে তাতে প্রাণ সঞ্চার করলাম। সেই থেকে তিনি আমার এক প্রিয় সঙ্গী হয়ে উঠলেন। আমার কাজও অনেকটা সহজ হয়ে গেল। প্রতিদিন অনেকটা সময় বাঁচিয়ে দিল আমার সেই দ্বিচক্রযানটি। ফলে পথচলার ক্লান্তি লাঘব হওয়ার পাশাপাশি আমি নতুন নতুন বই পড়ার সময়ও পেলাম অনেক বেশি। শৈশব থেকেই বইপড়ার অভ্যাস ছিল, নেশাও ছিল। হাতে বাড়তি কিছু টাকা থাকলেই বই কিনে ফেলতাম। আমার বন্ধুরা বলতো "যার খাবার পয়সা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয় তার এই অদ্ভুত শখ দেখলে ভাজ্জব বনে যেতে হয়।"

আমি মনে মনে হাসতাম। যারা অর্থোপার্জনকে জীবনের সবচেয়ে বড়ো জিনিস বলে মনে করে আমি তাদের দলের নই। কে বোঝাবে ওদের। একটা বই পড়ার অর্থ হলো "একজন প্রিয় বন্ধুর সাথে সময় কাটানো।" বুড়ো, রাজু কমল, অলোক... সবাই এককথা বলে। এই সময় একে একে নিকোলাই অস্ত্রভস্কির 'ইস্পাত', বরিস পলেভয়ের 'মানুষের মতো মানুষ' ইয়াংমোর 'যৌবনের গান', ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা', জন রীডের 'দুনিয়া কাঁপানো দশদিন' এবং আলফ্রেড হিচককের রচনা পড়ে ফেললাম। মনের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসছে সেটা বুঝতে পারলাম, পড়ার তাগিদ ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি' ভারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণের লেখা, মহাশ্বেতা দেবীর লেখা আমার মনোভূমিতে নতুন ফসল উৎপাদনের জোয়ার এনে দিল। শুধু পথ খুঁজতে লাগলাম, আমার বন্ধুরাও ব্যাপারটা আঁজ করতে পারছিলো। আমার কৌতূহল ক্রমশ বাড়তে লাগলো, আর বন্ধুরাও ধীরে ধীরে একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগলো।

(ক্রমশ)