গল্প ও অণুগল্প

তনুজা ও চাকরি-পরীক্ষা



পিয়ালী রায়


তনুজা ম্যাম আজ এসেছেন?

না রে আসেন নি। ম্যাডাম ছুটিতে আছেন।

দূর ভালো লাগে না! কি সুন্দর ফেদারস্টিচ শেখাচ্ছিলেন, বলেছিলেন টেবিলক্লথটা শেষ হলে কাপড় দিয়ে হার-মালা-চুড়ি করা শেখাবেন!

ক্লাস সেভেনের ক্লাসে পড়ানো শেষ হতেই মেয়েদের প্রশ্নের মুখোমুখি বৃন্দা। এরপর কেন আসছেন না, তনুজা ম্যাম অসুস্থ কিনা এসব একরাশ প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই ভাগ্যিস পরের ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেল, তাই কোনোক্রমে এড়িয়ে যাবার সুযোগ পেল। পরপর ক্লাস থাকলে সাধারণত দুটো ক্লাসের মাঝে স্টাফরুমে আর ঢোকে না বৃন্দা। তাই সেভেন থেকেই সরাসরি চলে যায় ক্লাস নাইনের ক্লাস নিতে। ক্লাস নাইনের মেয়েদেরও সেই একই প্রসঙ্গ। 'নববর্ষা' কবিতাটা তনুজা ম্যাম অর্ধেকটা পড়িয়ে সেই যে গেলেন আর পড়া হল না।

কেন, তোরা সবিতা ম্যামকে বলিস নি কবিতাটা শেষ করে দেবার কথা?

দীক্ষা উঠে দাঁড়িয়ে বলে না শেষ হয়েছে কিন্তু তনুজা ম্যামের পড়ানো, উফ অসাধারণ!

পাশ থেকে অমৃতা দীক্ষার কথার সমর্থনে বলে ওঠে যেদিন নববর্ষা কবিতাটা ম্যাম পড়াচ্ছিলেন সেদিন সত্যি সত্যি আকাশে মেঘ করে এসেছিল। ওদের কথোপকথনের নীরব শ্রোতা হওয়া ছাড়া বৃন্দার আর কিছু করার নেই। কোনোরকমে তনুজা প্রসঙ্গ থামিয়ে বৃন্দা পড়ানো শুরু করে।

ঘন্টা পড়ার পর ক্লাস থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে স্টাফরুমে ঢোকে বৃন্দা। চক-বই-খাতা গুলো টেবিলের ওপর রেখে হাতটা বেসিন থেকে ধুয়ে আসে। পরপর তিনটে ক্লাস নিয়ে একটু ক্লান্ত লাগে তাই চেয়ারের পেছনে মাথাটা হেলান দিয়ে চোখ বুজে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়। এখন টিফিন টাইম। একে একে ক্লাস নিয়ে সবাই স্টাফরুমে জড়ো হচ্ছে। বৃন্দার উল্টোদিকে বসা অনুত্তমা টিফিন খেতে খেতে ডানদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে গেল। তারপর বলল কি ফাঁকা লাগছে তনুজার চেয়ারটা তাই না! সকলেই ওকে সমর্থন জানায়। বৃন্দা ক্লাস সেভেন ও নাইনের ক্লাসে ওর অভিজ্ঞতার কথা বলতেই সকলেই জানাল তারাও কমবেশি তনুজা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। অনুত্তমা দু:খের সাথে বলে কি যে করল মেয়েটা, কি জানি কি হবে!

তনুজা বছর পাঁচেক আগে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বৃন্দাদের স্কুলে যোগ দেয়। নাটক, কবিতা, ছবি আঁকা সব বিষয়েই ওর দক্ষতা অল্পদিনের মধ্যেই ছাত্রী, শিক্ষিকা, অভিভাবক সকলের কাছে ওকে জনপ্রিয় করে তোলে। যেবার স্কুলের সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব নিজেই যেচে নিল তনুজা সেদিন সবাই একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। তনুজা খানম সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব নিতে চাইছে! সকলের মনেই দোলাচল ছিল। কিন্তু সেবারের সরস্বতী পুজোর আলপনা, আয়োজন সবাইকে চমকে দিয়েছিল। আচার-আচরণ পোশাক-আশাকে তনুজা যথেষ্ট সংস্কারমুক্ত। এমনকি ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধ সংস্কার নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতেও সে সরব। এ হেন তনুজার এমন নীরব বিদায় স্কুলের কেউই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না।

মাস চার পাঁচেক আগে স্কুলের অফিসরুমে একটা কানাকানি চলছিল। ক্রমশ: সেটা স্টাফরুমেও সংক্রামিত হল। বৃন্দা কয়েকজনকে ফিসফাস করতে শুনেছে কিন্তু কিছুটা ব্যস্ততা আর কিছুটা সংকোচবশত কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি। শেষে সেদিন টিফিন টাইমে রণিতার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে দোকান যাবার সময় রণিতাই প্রসঙ্গটা তোলে।

তনুজার খবরটা জানো তো বৃন্দাদি?

বৃন্দা অবাক চোখে রণিতার দিকে তাকিয়ে দুপাশে মাথা নেড়ে বলে কেন কি হয়েছে তনুজার?

ও মা জানো না! তনুজার নামে তো অফিসে চিঠি এসেছে।

কিসের চিঠি!

এরপর বড় বড় চোখ করে রণিতা যা বলে চলে তা বৃন্দাকে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ করে দেয়। রণিতার কথা অনুযায়ী চাকরি পরীক্ষার অনিয়মের অভিযোগে রাজ্যজুড়ে যে তল্লাশি শুরু হয়েছে তাতে তনুজাও অভিযুক্ত। শুধু তাই নয় তনুজার ওএমআর শিট এখন সবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। একদম খালি উত্তরপত্র জমা দিয়ে কি করে চাকরি পায় এই নিয়ে সকলে সরব। একজন তো ওর চরিত্র নিয়েও কু-ইঙ্গিত করেছে।

রণিতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিষটি কিনে স্টাফরুমে ফিরে বৃন্দা একদম চুপ করে বসে থাকে। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ওর। তনুজার জন্ম ও বেড়ে ওঠা যে শহরে সেই শহরে বৃন্দা অনেকবার গেছে। তনুজার মাস্টারমশাই, আত্মীয়স্বজন অনেকেই বৃন্দার পূর্ব পরিচিত। সেই সুবাদে তনুজাও বৃন্দাকে বড় আপন বলে ভাবে। এই স্কুলে আসার পর অনেকটা ছোট বোনের মত নানা বিষয়ে বৃন্দার কাছে আবদার করে।

কিছুদিনের মধ্যেই স্টাফরুমের সবাই জেনে গেল তনুজার কথা। সামনাসামনি কেউ কিছু বলে না, কিন্তু ও ঘরে না থাকলেই চলে ওকে নিয়ে আলোচনা। যদিও তনুজার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ওর মনের মধ্যে কি চলছে! দেখতে দেখতে স্টাফরুমটা দুটো দলে ভাগ হয়ে গেল। একদল ওর পক্ষে আর অপরদল বিপক্ষে। কত পড়াশোনা করা যোগ্যতাসম্পন্ন ছেলেমেয়েকে বঞ্চিত করে তনুজা বা তনুজার মত আর যারা চাকরি করছে অবিলম্বে তাদের বরখাস্ত করা উচিত, এই যদি একদলের বক্তব্য হয় তো অপরদলের কথা সরকারি চাকরির মত নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পেলে এমন সাধুপুরুষ কে আছে যে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করবে না! শাস্তি পেতে হলে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত যাঁরা তনুজার মত ছেলেমেয়েগুলোকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলেছে।

এত সব ঘটনার মাঝেও তনুজা কিন্তু অসম্ভব রকমের শান্ত। বাইরে থেকে দেখে ওকে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। যদিও ওর সামনে কেউ কিছু বলে না কিন্তু স্টাফরুমে ওর অনুপস্থিতিতে সকলের একই প্রশ্ন মেয়েটা এত কুল আছে কি করে? মাস দেড়েক এইরকম লুকোচুরি খেলাই চলে বৃন্দাদের স্টাফরুমে। এতবড় একটা খবর এখন ওপেনসিক্রেট। সিক্রেটটা একদিন স্টাফরুমে ওপেন করে দিল সুমনা। স্পষ্টবক্তা হিসেবে সুমনা এমনিতেই সবার কাছে পরিচিত। এই স্পষ্টবাদিতার জন্য ও অনেকেরই চক্ষুশূল। সরাসরি তনুজার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে বসল,
- তোদের চাকরি কেসটার লেটেস্ট আপডেট কিছু পেলি? তোদেরও তো একটা সংগঠন হয়েছে শুনলাম, তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না?

দহনশয়নে পিপাসার্ত তপ্ত ধরণী যেমন অমৃতবারির বার্তা পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে তনুজাও যেন এতদিন কারো কাছ থেকে এইটুকু প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিল। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ওর চোখের জলের জোয়ার এসেছে আজ। বড়দি অফিসরুম থেকে স্টাফরুমে এসে জড়িয়ে ধরলেন তনুজাকে।

এত ভালো রেজাল্ট, এত গুণ তোমার কি জন্য করতে গেলে তনুজা এই কাজ! তুমি তো এমনিতেই চাকরি পাবার জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত, তবুও এই কাজ করতে গেলে কেন!

উত্তর না দিয়ে বড়দিকে জড়িয়ে কেঁদেই চলে তনুজা।

সারা স্টাফরুমে পিন পতনের নীরবতা। সকলের চোখ ছলছল। বেশ কিছু ক্ষণ পর তনুজা চোখ মুছে একটু শান্ত হয়ে বলে,
- আমি তো চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নের নাইন্টি পারসেন্ট উত্তর করতে পারতাম কিন্তু চাকরি পাওয়া পাকা করতে আমাকে বলা হয়েছিল সাদা খাতা জমা দিতে। ছোট থেকে স্বপ্ন দেখেছি দিদিমণি হব। তাই এই লোভটুকুতে পা না বাড়িয়ে থাকতে পারিনি বড়দি। এ আমি কি করলাম বড়দি। কেন নিজের চেষ্টায় পরীক্ষাটা দিলাম না!

কারো মুখে সান্ত্বনা জানানোর ভাষা নেই।

এই ঘটনার কয়েকদিন পর স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তী। এবারও তনুজা হাসিমুখে মেয়েদের নাচ, নাটক সব শিখিয়েছে। সুন্দর করে মঞ্চ সাজিয়েছে। অবশেষে গত সোমবার বড়দিকে ফোন করে জানিয়েছে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ও আর স্কুলে আসবে না। সকলের উদ্দেশ্যে স্কুলের হোয়াটসএপ গ্রুপে লিখে গেছে আবার আসিব ফিরে তোমাদের নীড়ে।

আয় তনুজা। এবার সব পাপ ধুয়ে মুছে সসম্মানে ফিরে আয় তোর এই স্নেহনীড়ে তোর ছানাদের কাছে, বিড়বিড় করে বৃন্দা।