দীর্ঘ বাইশ বছরের ওকালতি জীবনে কেউ উকিলবাবু বলে ডাকলো না। সবাই তো ম্যাডাম, ম্যাম, দিদি ঐসব নামেই সম্বোধন করে এসেছে আমাকে। অমুক বাবু, তমুক বাবু, এইসব ডাক সাধারণতঃ পুরুষ মানুষদেরই লোকে ডাকে যদিও উকিলবাবু, ডাক্তারবাবু এদেরকে পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে ডাকার রেওয়াজ আছে, কিন্তু সাধারণতঃ আমরা ছেলেদেরকেই এইসব নামে ডেকে থাকি। কিন্তু আমার জীবনে ওকালতি প্রফেশনের শুরুতেই এই ডাক শুনলাম - বাইরের নয় একদম নিজেরই এক মানুষের কাছ থেকে। সেই নিজের মানুষটাই ডঃ হরমোহন সিংহ, আমার অতি আদরের বড়মামা। আজও মনে পরে সেই দিনটার কথা - নতুন বৌ আমি, ঘরের এক কোনায় গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছি, আমার শাশুড়ি মায়ের ইশারায় আমি বড়মামার কাছে এসে ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “উকিলবাবু?” আমি তখন অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি, লক্ষ্য করলাম ওনার চোখে মুখে হাসির আভা - এর পরবর্তী কথাটা তো আমি একদমই আশা করি নি, আমার কানের কাছে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন “আজ কত হল?” আমি কি বলব তখন ভেবেই পাচ্ছি না - দেখি বড়মামার মুখের হাসি তখন চওড়া হয়েছে, বেশ বোঝা যাচ্ছে উনি মজা করছেন, এদিকে উত্তর খুঁজে না পেয়ে আমিও অপ্রস্তুত, সত্যি তখন দিনে ২০০ টাকাও পেতাম কিনা সন্দেহ। নতুন প্র্যাকটিস শুরু করেছি। এত বোকা আমি যে ভয়ে বলেই ফেললাম, ২০০ টাকা, ওনার তো হাসি আর ধরে না এভাবে প্রথম মোলাকাতেই সম্পর্ক এত সহজ করে নিলেন যা ভাবাই যায় না। এত আদর মাখানো একটা নাম দিলেন যা মন ছুঁয়ে গেল। এরপর যতদিন উনি বেঁচে ছিলেন আমায় উকিলবাবু বলেই ডাকতেন।
আজ লিখতে বসে অনেক ছোটো ছোটো স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে আমার মনে। আমার ছোটবেলাটা কেটেছে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে। সারাদিন অনেক হৈচৈ, মজা এসব নিয়েই কেটেছে, কিন্তু বিয়ের পর অনুভব করলাম এরা সবাই খুবই শান্ত স্বভাবের। বাড়িতে হৈচৈ সেভাবে হয়ই না - শুধু বড়মামা যখন আসতেন আমাদের বাড়িতে তখন যেন আলো জ্বলে উঠত, একটা উৎসবের মত পরিবেশ তৈরী হত। বড়মামার সাথে সাথে অনেক লোকজন আসতেন। আমার শাশুড়ি মা নিজের হাতে অনেক খাবারদাবার বানাতেন, বড়মামা যা যা পছন্দ করেন সব। বড়মামা কলকাতায় এলে যখন আমাদের বাড়িতে থাকতেন তখন দেখেছি কত জ্ঞানীগুণী মানুষ আসতেন ওনার সাথে দেখা করতে, বড়মামা সবসময় লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। তাবলে কিন্তু আমাকে উকিলবাবু বলে ডেকে সেদিন কত ইনকাম হয়েছে জিজ্ঞেস করে নিতেন একফাঁকে। আমিও ততদিনে বুঝে গেছি এটা বড়মামা মজা করেই জিজ্ঞেস করেন - তাই আমিও কত ইনকাম হয়েছে আর বলতাম না। এইভাবেই হাসিমজা করে দিনগুলো কেটে যেত। ছোটবেলায় ঠাকুমা, কাকা-কাকিমাদের নয়নের মণি আর অসম্ভব আদরের মধ্যে মানুষ হওয়ার কারনে এই টুকরো টুকরো ভালোবাসাগুলো আমার বুঝতে দেরি হলো না, খুব সহজেই উনি আমার কাছে মামাশ্বশুর থেকে আদরের বড়মামা হয়ে গেলেন।
দিনেরবেলায় খুব একটা ওনাকে পেতাম না আমরা - নানাধরনের লোকেদের আবদার, প্রয়োজন উনি ঠান্ডা মাথায় শুনতেন এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য করতেন। এছাড়া নানারকমের কাজে বড়মামাকে বেরোতেও হতো। আমাদের গল্প করার সময় ছিল রাতে। বড়মামা বাড়ি ফেরার পর হাতমুখ ধুয়ে যখন খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে বসতেন তখন। আমি লক্ষ্য করতাম সারাদিনের এত ক্লান্তি মানুষটাকে ছুঁতেও পারে না, সমানে তিনি আমাদের সবার খোঁজ নিতেন আর নানারকমের গল্প করতেন। আমরা সব মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম। শাশুড়িমা বড়মামার পায়ে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন বড়মামার দিকে - নিজের চোখে দেখেছি ভাই-বোনের সেই ভালোবাসা, অটুট বন্ধন, যা আজকের দিনে বিরল।
আমার মা একমাত্র মেয়ে হবার কারনে আমাদের কোনো মাসি ছিল না, আর একমাত্র মামা আছেন যিনি চিরকাল বাইরে বাইরেই থেকেছেন - তাই ছোট থেকেই মামা, মাসি এই ডাকগুলোর প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিল, যেটা পূর্ণ হয় এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর। দেখলাম এখানে বাড়ি ভর্তি মামা-মাসি, কতরকম ভাবে তাদেরকে ডাকা হয় - বড়, মেজ, ফুল, ন, ভালো ইত্যাদি। এত আদরের ডাকগুলো ডাকতে পেয়ে আমি তো মহা খুশি। আর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো এই ভাইবোনদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক - যা একসূত্রে বেঁধে রেখেছিলেন বড়মামা, এত ব্যস্ততার মধ্যেও উনি ঠিক খেয়াল রাখতেন তার বোনের। মাঝে মাঝেই তার বোনকে গাড়ি চড়িয়ে বিভিন্ন আত্মীয়দের বাড়ি নিয়ে যেতেন। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতেও নিয়ে গেছেন, আমার মনে আছে, ভাইবোনদের নিয়ে একটা ক্যাম্প করেছিলেন সুদপুরে - যেখানে একঘেয়ে সংসার থেকে মুক্তি নিয়ে সব ভাইবোনেরা একসাথে থাকতেন যার যতদিন খুশি, নিজেরাই রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব করতেন - সে এক দারুন ব্যাপার! এইযে সব অভিনব আইডিয়া - এগুলো ভাইবোনের ওপর কতখানি টান থাকলে হয় সেটা বোঝা যায়। এছাড়াও প্রতিদিন সবাইকে ফোন করে সবার খোঁজখবর নিতেন - সেই তালিকায় আমি কখনো বাদ পড়িনি। এখানে ফোন করে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলার পরই আমার খোঁজ করতেন - যদি বাড়ি থাকতাম তাহলে কথা হত। অত্যন্ত বড় বংশের সন্তান ছিলেন আমাদের বড়মামা। একধারে ছিলেন স্বনামধন্য চিকিৎসক, অন্যদিকে সফল রাজনীতিবিদ। বড়মামার এই সাফল্যের পিছনে ছিল অনেক পরিশ্রমের কাহিনী - যা একজনকে বাকিদের থেকে আলাদা করে দেয়। পরবর্তীকালে বড়মামাকে নিয়ে লেখা বই থেকে তার ছাত্রজীবন, কর্মজীবন ও রাজনৈতিক জীবনের বহু অজানা কথা জানতে পারি, যা এককথায় অনবদ্য এবং অতি ব্যতিক্রমী। কিছুতেই মেলাতে পারি না এই জ্ঞানীগুণী মানুষটার সাথে আমার নিজের দেখা অনুভূতির। যা ছিল - অত্যন্ত সহজ, সরল, সাদামাটা পোষাক পরা, স্বল্পাহারী, হাসিখুশি, সহানুভূতিশীল, মজার মজার কথা বলা অতি উদার এক মানুষের ছবি।
বড়মামা যে অঞ্চলের বিধায়ক ছিলেন, সে অঞ্চলের রূপকারও বলা হয় তাকে। তার অসংখ্য কর্মযজ্ঞের মধ্যে একটা হল আনন্দনিকেতন। আমরা বলি, আমাদের শান্তিনিকেতন। এখানে বেশ কয়েকবার আসার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, বেশ কয়েক একর জায়গা জুড়ে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষদের থাকার জায়গা, তাদের চিকিৎসা, কর্মশিক্ষা, উন্নতজীবনের শিক্ষা এবং কর্মে নিয়োগ করে তাদের সমাজে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা - এক সুবিশাল কর্মকান্ড চলছে সেখানে। সুসজ্জিত বাগান, পশুপালন, গ্রন্থাগার, মুদ্রণখানা, বৃদ্ধাবাস, আবাসিকদের থাকার জায়গা, মাঠ - সবকিছুই আছে এই আনন্দনিকেতনে। এখানে যতবারই এসেছি, এক আশ্চর্য অনুভূতি ঘিরে ধরেছে আমাকে। আনন্দনিকেতনে পৌঁছনোর পর থেকেই দুহাত বাড়িয়ে আমায় আপন করে নিয়েছে এখানকার আবাসিকরা, যাদের আমরা মানসিকভাবে অসুস্থ বলি, অথচ এদের স্পর্শে, এদের ভালোবাসায়, এদের সাথে কথা বলে এই ধারণা মনে উঁকি দেয় যে, দিনরাত লাভক্ষতির হিসেব করা আমরা কি কোনো অংশে এদের থেকে বেশি সুস্থ? এখানে এসে সময় যে কিভাবে কেটে যায় বোঝা যায় না। এখানকার আবাসিকদের আন্তরিকতায় তখন এদেরই একজন হয়ে যাই, আর মনে মনে বড়মামার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। এই বিশাল কর্মকান্ডের ভার ভগবান তো যার তার হাতে দিতে পারেন না, তাই তিনি যোগ্য লোকের হাতেই এই ভার তুলে দিয়েছেন।
বড়মামা হঠাৎ আমাদের সবাইকে ছেড়ে অমৃতলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। অবশ্য মৃত্যুর আগে বেশ কয়েকবছর তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, সে সময় বেশ কয়েকবার তার কাছে যাই এবং তিনি যথারীতি তার চিরাচরিত ভঙ্গিতে মৃদু হেসে “উকিলবাবু? কত হলো?” এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে কিন্তু ভোলেন না, কারন এই কথাটা বললেই আমার মুখে হাসি খেলে যেত, মনে হয় বড়মামা বারবার সেটাই দেখতে চাইতেন। বড়মামার মৃত্যুর আগে আমার সাথে ওনার শেষ কথা হয়েছে ভিডিও কলিংয়ের মাধ্যমে, বড়মামার জন্মদিন উপলক্ষে ওনার ভাগ্নে সেবার আনন্দনিকেতনে যায়, তখন বড়মামার আর কথা বলার ক্ষমতাটুকুও নেই। খুব কষ্ট করে একটা শব্দ হয়ত কোনোমতে মুখ থেকে বের করতে পারতেন। বড়মামাই ইশারায় আমার সাথে ফোনে কথা বলতে চান, তখন মোবাইলে লক্ষ্য করলাম বড়মামার মুখে সেই পরিচিত হাসি লেগে রয়েছে, উকিলবাবু কথাটা বলতে পারলেন না শুধু অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেলাম "কত হলো?" বহুদিন পরে সেদিন হাসির বদলে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেছিলাম। অশ্রুসজল চোখে বলেছিলাম, তোমার উকিলবাবুকে আর কেউই ঐ নামে ডাকবে না, আর সে চায়ও না অন্য কেউ তাকে উকিলবাবু বলে ডাকুক।
বড়মামার মৃত্যুর পর আনন্দনিকেতনে গিয়েছি, সেখানে বড়মামার ঘরে গিয়ে দেখি, বিছানায় ওপর মালা দিয়ে সাজানো বড়মামার বড় একটা ছবি। সেই ছবিকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছি, তখন মনে হলো পেছন থেকে যেন বড়মামা বলে উঠল - উকিলবাবু? কত হলো?