এই জায়গাটা ছিল প্রাচীন ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশের একটা রাজ্যে। কিন্ত তখনকার ভারতের সীমানা অনেক দূর বিস্তারিত। সেইসব অঞ্চল এখন বিভিন্ন আলাদা আলাদা দেশ হিসেবে পরিচিত। এর সঠিক অবস্থান সম্পর্কে এখনও মতানৈক্য আছে।
এখনকার পাকিস্তানের পশ্চিম প্রান্তে, আফগানিস্তানের গা ঘেঁষে, ছিল তোমার জন্মস্থান, 'কেকয়া'।
রাজা অশ্বপতি ছিল তোমার পিতা। মায়ের কথা তোমার সারা জীবন মনে পড়েছে। কিন্ত মা'কে যখন, তোমার বাবা নির্বাসন দিয়েছিল তখন তোমার বয়স মাত্র বারো বছর। মা'র নাম কি ছিল, সেটা পর্যন্ত জানার সুযোগ হয়নি জীবনে! শুনলেও আশ্চর্য লাগে এখন! কিন্তু সেই সময়কার সমাজ নারীকে পেছনে ফেলে রাখার চেষ্টায় পারদর্শী হয়ে উঠছে ক্রমশ! তখন যত প্রাজ্ঞ ঋষি মুনিরা ছিলেন তাঁরা, নারীর সমান অধিকারকে, অস্বীকার করতে বলছেন!
পরবর্তীকালেও সেই সময়ের গল্পকাররা, নারীর মুখে সামান্য কথা জুগিয়েছেন, তাদের দৈনন্দিন রোজনামচার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন! অথচ, মহাকাব্যগুলিতে যুদ্ধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কারণ ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের হোতা ছিল পুরুষরাই। নারীদের জন্য ছিল শুধুই সংসার ও সন্তান পালন। শিল্পের জগতে, পূজো-অর্চনার আঙিনার সীমাবদ্ধ জীবনে, রাণী থেকে সাধারণ নারীর সময় কাটত! বিদ্যাচর্চা বা ক্রীড়ার অঙ্গনে তাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে তো নারী নৈব নৈব চঃ।
কৈকেয়ী, তোমার মনে পড়ে, তোমার মা ছিলেন, সমসাময়িক মহিলাদের থেকে একদম আলাদা। তোমার মা'র প্রথমা এবং একমাত্র কন্যা তুমি, তারপর সাতটি পুত্র। মা কিন্ত তোমাকেই সবচেয়ে ভালবাসতেন! মা, তোমাকে রাজপ্রাসাদের নীচের কুঠুরীতে রাখা পুঁথির সম্ভারের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন। মা'র জানার আগ্রহ ছিল অপরিসীম, অনেকটা সময়, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে মা, পাঠাগারের পুরোনো পুঁথির মধ্যে কাটাতেন।
বাবা অশ্বপতি ছিলেন কঠিন, কঠোর একজন রাজা, যিনি রাজ্য এবং সংসার সমান দক্ষতায় চালাতেন। নামের মধ্যে দিয়েই বোঝা যায়, রাজার নামকরণের উৎস! বাবার অশ্বশালা ছিল রকমারি সুন্দর, অশ্বের সম্ভারে পূর্ণ। বাবা একবার কোনও ঋষিকে পূজায় সন্তুষ্ট করে তাঁর কাছে বর পেয়েছিলেন। পক্ষীকূলের ভাষা বোঝার এক আশ্চর্য ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। কিন্ত কথিত আছে, সেই ভাষার মানে নাকি অন্য কাউকে বলতে পারবেন না রাজা অশ্বপতি। তাহলেই তাঁর মৃত্যু হবে। এ কথার সত্য মিথ্যা যাচাই করার সুযোগ পাওনি তুমি। তবে এইরকম একটি ঘটনার জন্যই তোমার মা'কে নির্বাসিত করেছিলেন বাবা! সেকথা জানার পর থেকে, বাবার প্রতি রোষ পুষে রেখেছো আজীবন। মা'কে আর কোনওদিন তুমি দেখতে পাওনি। সত্যিই কি মা নির্বাসিত হয়েছিলেন রাজ্য থেকে, নাকি আরও বড় কোনও অভিশাপ নেমে এসেছিল মায়ের জীবনে, তাও জানেনা কেউ।
তোমার যমজ ভাই যুধাজিত ছিল তোমার প্রিয়তম ভাই! মা আর আসবে না কখনও, একথা এসে তোমাদের দুজনকে বলে গেল প্রাসাদের বিশ্বস্ত এক দাসী। তুমি ছুটে গেলে তোমার প্রিয় দাসী মন্থরার কাছে! মন্থরা কাছে টেনে নিল তোমাকে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আর বলল, "এসব কথা নিয়ে কারোর সাথে আলোচনা কোরোনা, কেমন! রাজপ্রাসাদ থেকে একবার যে চলে যায়, সে আর ফিরে আসেনা।"
কি এমন হয়েছিল যে, মা'কে চলে যেতে হল, এই চিন্তায় তোমার আর যুধাজিতের রাতে ঘুম আসত না, দিনেরবেলা ঘরের কোণে লুকিয়ে বসে কেবলই অশ্রুপাত করতে দুজনে!
বাকী ছয় ভাই ছোট তখন, সাংসারিক ঝামেলা বোঝার বয়স হয়নি কারোরই।
একদিন চুপিচুপি তোমরা গিয়ে দাঁড়ালে বাবার সভাগৃহের একপাশে। দেখলে আরও কয়েকজন বসে আছে, বাবা তাদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। শুনতে পেলে একজন বলছে, "মহামান্য রাজা, আপনি উচিত কাজই করেছেন, কোনও অনুশোচনা রাখবেন না, মহারানীর আপনাকে প্রশ্ন করা একদম ঠিক হয়নি।" এ কথার অর্থ কি জানতে আবার তোমরা ছুটে এলে ধাইমা মন্থরার কাছে!
মন্থরা তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে তাদের বলল সেই ঘটনার কথা!
রাজা রাণী একদিন বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছিল রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন বাগানে, সেখানে একটা সরোবরে দুটি রাজহাঁস প্রেমলীলায় মত্ত, তারা নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলছে! রাজা অশ্বপতি সব শুনে মিটিমিটি হাসছিল তখন রাণীমা রাজাকে অনুরোধ করতে লাগল, কেন রাজা হাসছে, সেকথা বলার জন্য! যদিও রাজা যদি পাখিদের ভাষার অর্থ অন্য কাউকে বলে দেয়, তাহলে নাকি তার মৃত্যু হতে পারে! রাজা অস্বীকার করতে লাগল, পাখিদের কথোপকথনের মানে বলতে চাইল না। কিন্তু তাঁর রাণীও তখন নাছোড়বান্দা, রাজা কি এমন শুনল যে এত হাসতে লাগল, একথা তাকে জানতেই হবে! এমনিতে রাজা তাকে এত ভালবাসে যখন, তার সাতটি সন্তানের পিতা, তার এইটুকু আবদার কেন রাখবে না! কিন্তু না, রাণী নিজের অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করেছিল, রাজার বিরক্তির উদ্রেক করেছিল, সুতরাং যে স্ত্রী, স্বামীর সম্ভাব্য মৃত্যুকে উপেক্ষা করে, এমন অনুরোধ করতে পারে, তার জন্য নির্বাসনই উপযুক্ত শাস্তি বলে, মনে হল রাজার! হলোই বা সে তার সাতটি সন্তানের জননী, তার অঙ্কশায়িনী বা অর্ধাঙ্গিনী যাই হোক, তার নিজের প্রাণের মূল্য তার থেকে অনেক বেশী!
মায়ের অজানাকে জানার কৌতুহলের দাবি এইভাবে মেটাতে হল! তুমি যখন পরবর্তীকালে গ্রন্থাগারে এসে বসতে, এইসব কথাই তোমাকে বিশেষ করে ভাবাত!
বৈষ্ণবী প্যাটেল
নারীর অবস্থানটা ঠিক কোথায়? পুরুষ তার প্রিয় নারীকে তাহলে যেকোনও অজুহাতে ছুঁড়ে ফেলতে পারে?
কারণ রাজার জীবনে অসংখ্য নারী, তার করায়ত্ত! সেখানে একজন নারী, হলই বা তার সন্তানের জননী, তাকে ছাড়া তার দিব্যি চলে যাবে!
তুমি কৈকেয়ী, তোমাকে, সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে, যাতে কারো ক্ষমতা না হয়, তোমাকে পদদলিত করার! নিজেকে তোমার শক্ত করে গড়তে হবে। পুরুষের সমকক্ষ হতে হবে!
গ্রন্থের নামঃ কৈকেয়ী (Kaikeyi: A Novel)
লেখিকাঃ বৈষ্ণবী প্যাটেল (Vaishnavi Patel)
ভাষাঃ ইংরাজী
প্রকাশকঃ রেডহুক (Redhook)
বাঁধাইঃ পেপারব্যাক
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫১২ পাতা
মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয় মুদ্রায়): ১,৭৩৪ টাকা
(ক্রমশ)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।