শীত-রোদ্দুর গায়ে মেখে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বেরিয়ে পড়লাম ইতিহাসের পথে। স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধংসস্তূপের কথা ও ছবি বিস্ময়ের উদ্রেক করত মনের মধ্যে। ২৫শে ডিসেম্বরের সকালটাই বেছে নিলাম নালন্দা ও পাওয়াপুরী ঘুরে দেখবার জন্য। ২৪শে ডিসেম্বর রাতে দানাপুর এক্সপ্রেস চড়ে ভোররাতে পৌছলাম বকতিয়ারপুর। ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। ঠাণ্ডা ভালোই পড়েছিল। এখান থেকে রাজগীর যাবো আমরা। রাজগীর যাওয়ার জন্য প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরতে পারেন। প্রাইভেট গাড়ি মিলবে। ৫০ কিমি রাস্তা। আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে উষ্ণ চায়ে চুমুক। সুন্দর রাস্তা। কুয়াশা জড়িয়ে ধরেছে চারপাশের প্রকৃতিকে। ভোরের সূর্য রাঙিয়ে দিল আকাশ। হোটেল আগে থেকে বুক করে রাখায় অসুবিধে হয়নি। এই সময় রাজগীরে প্রচুর মানুষ। তাই গিয়ে হোটেল ঠিক করবো এরকম ভাবনা মনে না রাখাই ভালো। স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম নালন্দার উদ্দেশ্যে।
'আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'র তত্ত্বাবধানে থাকা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ দেখে মুগ্ধ হলাম। বিস্ময়কর স্থাপত্যকীর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আপনি ফিরে যাবেন অতীত ইতিহাসের অতলে। ৫০ বর্গ কিমি জায়গাজুড়ে থাকা এই ধ্বংসাবশেষ মোহনীয় চিত্রকল্প তৈরি করেছে। মৌর্য সম্রাট অশোকের হাতে নালন্দার পত্তন হয়েছিল। প্রায় ৬০০ বছর পরে নালন্দা বিশ্বের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল গুপ্তযুগে। ওখানে বৌদ্ধশাস্ত্র পঠন-পাঠন হতো, তাছাড়া সাহিত্য, দর্শন, বেদ, ব্যাকরণ, ন্যায়, জ্যোতিষ, রসায়ন প্রভৃতিও পড়ানো হতো। হিউয়েন সাঙ এখানে অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, নালন্দায় ছাত্রসংখ্যা ছিল ১০,০০০ ও অধ্যাপক ছিলেন ২,০০০। এখানকারই উপাচার্য ছিলেন শীলভদ্র। ১৮৬০ সাল থেকে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে খননকার্যের ফলে নালন্দার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। বুদ্ধদেব রাজগৃহে ছিলেন অনেকদিন। রাজা বিম্বিসার বুদ্ধদেবের কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন।
নালন্দা থেকে ফেরার পথে দেখে নিলাম একটি অসাধারণ জৈন মন্দির। এখান থেকে গেলাম পাওয়াপুরী। পাওয়াপুরী জৈন তীর্থগুলির অন্যতম। শ্বেতপাথরে তৈরি কমল সরোবরের এই জলমন্দিরটি খুবই পবিত্র। এখানে মহাবীর নির্বাণলাভ করেন বলে কথিত আছে। জলমন্দিরে আছে মহাবীবের পদচিহ্ন।
রাজগীরে ফিরে সন্ধ্যায় ঘুরে দেখলাম পান্ডব পুকুর। তৈরি হয়েছে অসাধারণ একটি পার্ক। বিনোদনের সবরকম ব্যবস্থা আছে। পাহাড়ের গায়ে আলো ফেলা হয়েছে। লেকের মধ্যে ফোয়ারা আছে - আছে বোটিং-এর ব্যবস্থা।
এরপর গরম জলের কুন্ড দেখতে গেলাম। খুবই আকর্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য স্থান। দেখলাম সন্ধেবেলাতে বেশ ঠান্ডার মধ্যে অনেক মানুষ কুন্ডর জলে গা ডুবিয়ে পুণ্যার্জনে মগ্ন।
পরের দিন ঠিক করলাম রাজগীরের বাকি জায়গাগুলো ঘুরে দেখবো। টাঙ্গা করে রাজগীর ঘোরার মজাই আলাদা। পাহাড়-ঘেরা রাজগীরের নাম ছিল রাজগৃহ। অজাতশত্রু নাম রেখেছিলেন গিরিব্রজ। বৈভার, বিপুল, রত্নগিরি, উদয়গিরি, শোনগিরি - পাঁচ পাহাড়ে ঘেরা রাজগীর। প্রথমেই গেলাম বিশ্বশান্তি স্তূপ দেখতে। রোপওয়ে করে উঠতে ভালোই লাগে। নার্ভ যাদের দুর্বল তাদের একটু ভয়ই লাগবে। ভিড় এতই ছিল যে আমরা হেঁটে উঠবো ঠিক করলাম। তিরিশ মিনিটে প্রায় ১,০০০ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই পথের ক্লান্তি কোথায় যেন উবে গেল - শীতল হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে গেল। পাহাড়চূড়া থেকে নামলামও রোপওয়ে করে। রোমাঞ্চিত হলাম। নৈসর্গিক দৃশ্য মন ছুঁয়ে যাবেই।
এরপর একে একে দেখে নিলাম বেণুবন, মণিয়ার মঠ, বিম্বিসার জেল, শোনভাণ্ডার, জাপানিজ টেম্পল, বিরায়তন মিউজিয়াম ইত্যাদি।
পরদিন চলে গেলাম বুদ্ধগয়ায়। রাজগীর থেকে বুদ্ধগয়া যাওয়ার রাস্তা অপূর্ব। রাস্তার দু'ধারের তালগাছের সারি ও পাহাড়ের যুগলবন্দি নৈসর্গিক দৃশ্যকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল প্রধান বুদ্ধগয়ার প্রধান আকর্ষণ মহাবোধি মন্দির। ৬০ ফুট চওড়া ও ১৮০ ফুট উঁচু পিরামিডধর্মী চূড়াবিশিষ্ট দ্বিতল মন্দির। মন্দিরে বিরাজ করছেন বুদ্ধমূর্তি। মন্দিরের পাশে বোধিবৃক্ষ, সুজাতা দিঘি। মন্দির চত্বরে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সন্ন্যাসীরা প্রার্থনায় মগ্ন। চারপাশে প্রচুর মন্দির। নানান দেশের মনেস্ট্রি। থাইল্যান্ড, চীন, ভুটান, তিব্বত, বাংলাদেশ, জাপান প্রভৃতি দেশের মনেস্ট্রিগুলির কারুকাজ ও বুদ্ধমূর্তি নজরকাড়া। বুদ্ধগয়াতেই আছে 'দ্য গ্রেট বুদ্ধ' - ৮০ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তি। অস্তগামী সূর্যের আলোয় এক মায়াময় পরিবেশ তখন সেখানে।
এখান থেকে গয়ায় গেলাম ফল্গুনদীর ধারে গড়ে ওঠা বিষ্ণুপাদ মন্দির দর্শন করতে। কালো পাথরে তৈরি এই মন্দিরটিতে বিষ্ণুর পায়ের ছাপ আছে বলে কথিত। এই মন্দিরে মৃত প্রিয়জনের আত্মার শান্তি কামনায় পিন্ডদান করতে অনেকেই আসেন।
গয়া থেকে ভোরে রাজধানী এক্সপ্রেস ধরে শিয়ালদহ ফিরলাম।
কীভাবে যাবেনঃ হাওড়া থেকে দানাপুর এক্সপ্রেসে বকতিয়ারপুর নেমে গাড়িতে অথবা রাজগীরগামী ট্রেনে।
কখন যাবেনঃ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস যাওয়ার জন্য ভালো সময়।
থাকবার জায়গাঃ থাকবার জন্য রাজগীরে প্রচুর হোটেল আছে।
আলোকচিত্রঃ লেখক।