[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]
ব্রিটিশ সেনার পোশাক পরিহিত কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯১৭ সালে তোলা ছবি।
পর্ব - ৯
- কাজীদা!
বারান্দার ধাপি থেকে হাঁক দিয়ে উত্তরের অপেক্ষা না করেই গোবিন্দ ঘরে ঢুকে পড়েছে। 'আপনি রেডি তো?'
সূর্য আড়ালে যেতেই নজরুল পোশাক বদলে মোটামুটি রেডি হয়েই বসে ছিলেন। ধুতিকে জড়িয়ে পরা তাঁর অভ্যাস, সঙ্গে গেরুয়া পাঞ্জাবি। তার উপরে শালটা জড়াতে জড়াতে নজরুল বললেন, 'কীরে? তোর তো আসার কথা ছিল না? মঘা কই?'
- সে একটা মড়া নিয়ে নবদ্বীপ গিয়েছে। দুপুরের আগেই রওনা দিয়েছে, এতোক্ষণ ফিরে আসবারই কথা। তবু নবদ্বীপ শ্মশান বলে কথা - কত সময় লাগবে কে জানে। মঘার কথায় ভরসা নেই - এই ভেবে তারকদাকে বলে আমিই চলে এলাম।'
'ভরসা নেই মানে? মঘা কাউকে কথা দিয়ে কখনো কথার খেলাপ করে না!' দুজনকেই রীতিমতো চমকে দিয়ে নাটকীয় ভাবে ঘরের মধ্যে প্রমোদরঞ্জনের আবির্ভাব।
মঘার আগমনে গোবিন্দ অনেকটা স্বস্তি বোধ করলেও খানিকটা যেন অপ্রস্তুত।
- আরে তা নয়। কিন্তু নবদ্বীপের শ্মশান বলে কথা। ভিড় তো লেগেই থাকে। তাই বলছিলাম।
- সে ভিড় তো আজও ছিল। তার উপর বাগদি-মেথরের মড়া হলে তো কাঠ-কুটোও দিতে চায় না। কিন্তু সে যতই বামুন-ঠাকুর আর ভদ্দর লোকের মড়া হোক - কেশনগরের সৎকার সমিতির উপর কথা বলার সাহস ডোমগুলোর আছে?
নজরুল হো হো করে হেসে উঠলেন - 'শ্মশানে যে মঘার আলাদা খাতির সে তো সেদিন হেমন্তদার কথাতেই বুঝেছি! সে যাই হোক, এসে তো পড়েছিস। হেমন্তদা কুষ্টিয়া চলে গেলেন, এরপর মঘাও যদি না থাকে - তাহলে আমার সংবর্ধনা তো অপূর্ণ থেকে যাবে!'
গোলাপট্টি থেকে ছুতোরপাড়া সামান্যই পথ। দুজনের মাঝখানে যেতে যেতে নজরুলের কৌতুহল - 'শ্মশানে সৎকার নিয়ে এতো সমস্যার কথা আগে শুনিনি। তোদের সৎকার সমিতি হবার আগে তাহলে কী অবস্থা ছিল ভেবে পাচ্ছি না। তাছাড়া নবদ্বীপ তো অনেকটা দূর, যা শুনছি চার-পাঁচ ক্রোশের ব্যাপার?'
- কেশনগরে জাতপাতের গোঁড়ামি অতুলনীয় কাজীদা! মঘা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল।
'এখানকার বামুনদের যেমন অহংকার, তেমনই গোঁড়া। উঠতে বসতে ছোঁয়াছুঁয়ি, ছোটো জাত বড়ো জাত - এই নিয়েই ব্যস্ত।'
'ওদের দাপটও কম নয় দাদা। দ্বিজেন্দ্রলালের মতো মানুষকেও ছাড়েনি, একঘরে করে রেখেছিল' কথার মাঝখানে গোবিন্দ মন্তব্য করে।
- 'এই গোঁড়াদের নিয়ে তবু পারা যায় দাদা, কিন্তু মুশকিল বেশি এই শিক্ষিত পাতি-বামুন গুলোকে নিয়ে। মুখে এরা খুব প্রগতিশীল, কিন্তু ভেতর ভেতর সব গোঁড়ামির হাড়। ছোটো জাতের মড়া হলে শ্মশানে যাবার কেউ নাই। এদের ভণ্ডামি দেখলে ইচ্ছে করে জিয়ালার কচা দিয়ে এদের আচ্ছা করে পেটাই!' মঘা বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ে, পারলে যেন এক্ষুনি ধরে পেটাতে শুরু করে।
'বেশ বলেছিস তো! গোঁড়া লেবু আর পাতি লেবু!' হাসতে হাসতে নজরুল মঘার পিঠে একটা চাপড় দিলেন। 'ভারি আশ্চর্য লাগেরে মঘা, খারাপও লাগে। কোথাকার বিদেশীরা এসে দেড়শো-দু'শো বছর ধরে দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে, দেশের মানুষের সাথে কুকুর বেড়ালের মতো ব্যবহার করছে - তা নিয়ে কোথায় ক্ষোভে ফেটে পড়বে, তা নয়তো সবাই জাতপাত নিয়ে ব্যস্ত! আরে, জেলের ভেতর গিয়েও মানুষের ছোঁয়াছুঁয়ির বহর দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছি!'
ছুতোরপাড়ার মাঠে টেবিলের দুপাশে বাঁশের খুঁটিতে দু'খানা হ্যাজাক জ্বালিয়ে তারকদাস ইতিমধ্যেই মঞ্চ সাজিয়ে ফেলেছে। সামনে বেশ গোটাকতক বেঞ্চি। লোক সমাগম খুব যে বেশি তা নয়, হবার কথাও নয়। তবু হ্যাজাকের আলো এড়িয়ে আশেপাশে বেশ কিছু চাদর মুড়ি দেওয়া মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দু'জন বয়স্ক সম্ভ্রান্ত চেহারার মানুষ নজরুলকে অভিবাদন জানিয়ে চেয়ারে বসালেন। 'বিদ্রোহী কবির নতুন করে পরিচয় দেবার কিছু নেই' বলে শুরু করলেও তারকদাসের ভরাট কণ্ঠস্বরে নজরুল ইসলামকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে কৃষ্ণনগরবাসী কতটা গর্বিত, কতটা সৌভাগ্যবান - তার বিস্তারিত বর্ণনা শোনা গেল। তার প্রাণবন্ত পরিচালনায় জমে উঠল অনুষ্ঠান। সভার সভাপতি শামসুদ্দিন আহমেদ, শহরের নামী উকিল, নজরুলের গলায় একটা বড়ো আকারের রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে দিলেন, কাঁধে ঝুলিয়ে দিলেন একটি নকশা করা কাশ্মীরি শাল। গোবিন্দপদ একটি কাচ বাঁধানো অভিনন্দনপত্র পাঠ করে শুনিয়ে তুলে দিল নজরুলের হাতে। একদিকে সম্প্রীতির অগ্রদূত, অপরদিকে বাংলার শোষিত-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষজনের হয়ে লড়াই করার অগ্রণী সৈনিক হিসেবে তুলে ধরে সে লেখার ছত্রে ছত্রে নজরুলের প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কৃষ্ণনগরবাসীর গভীর প্রত্যাশা। আবেগে অনেকটাই অভিভূত এবং উৎসাহিত হয়ে নজরুল কথা বলার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।
ছড়িয়ে থাকা লোকজন সবাই ভিড় করে প্রায় ঘিরে ধরেছে সভার মঞ্চটিকে। তারকদাসের ঘোষণার রকম দেখেই তিনি অনুমান করেছেন - লোকজন নজরুলের গান শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। সেজন্য টেবিলে রাখা হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে আগে রীডের উপর একটু আঙুল বুলিয়ে নিয়ে কথা শুরু করলেন - 'কৃষ্ণনগরে এসে যে ভালোবাসা, যে সম্মান আমি পেয়েছি তার জন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার আমার অন্ত নাই। চারিদিকে হতাশা, জাতপাতের বিবাদ, পরাধীন দেশের কথা, দরিদ্র সাধারণ মানুষের কথা ভাবার মতো মানুষের বড়ো অভাব। কিন্তু এই শহরে এসে, এখানকার যুবকদের আন্তরিক আবেগ দেখে আমার মনে নতুন করে জোয়ারের ঢেউ জেগে উঠছে। মুখের কথা নয় - গানের কথা দিয়ে আমার কথা বলি।'
এই বলে গান ধরলেন - জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া! দু'লাইন করে গান, তার ফাঁকে ফাঁকে কথা। আসার পথে মঘাদের কথার রেশ ধরে বলে চললেন - লেবু দুই রকমের হয়, গোঁড়া লেবু এবং পাতিলেবু - দুই লেবু গাছই সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। তা নাহলে জাতপাতের লড়াই নিয়েই থাকতে হবে, মাঝখান থেকে ইংরেজরা দেশটাকে লুটেপুটে খাবে। আমাদের নেতাদের মধ্যে একদল আছে ধামাধরা, যারা নেতা হতে চায়, কিন্তু ইংরাজদের বিরাগভাজন হতে চায়না। দেশের রাজা-গজা জমিদারেরা এই দলে, এরা ক্ষমতার ধামা ধরে থাকে। আরেকদল আছে জামা-ধরা - শাসকের বিরুদ্ধে লোকদেখানো আন্দোলন করে, নরম ভাষায় প্রতিবাদ করে, আর ইনিয়ে বিনিয়ে এটা ওটা আবদার করে। এদের দিয়ে কিছু হবে না - আমরা চাই টুঁটি ধরা দল - যারা ইংরেজের টুঁটি টিপে ধরতে পারবে!
ঘন ঘন হাততালি। মানুষের মধ্যে উত্তেজনা উপছে পড়ছে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সেরে ঘরে পৌঁছে দেবার পথে তারকদাসের অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস - কাজীদা, আজ খুব ভালো বলেছেন। আমাদের ছেলেদের মনোবল দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। শরীরে একটু নজর দিন, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। ঠান্ডা লাগাবেন না, কেশনগরের ঠান্ডা কিন্তু খুব খারাপ।
নজরুল হেসে উঠলেন - আজ ছেলেদের যা উৎসাহ দেখলাম - তা শরীরে গরম ধরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। আর এই যে - জব্বর একখানা শাল দিয়েছ তোমরা - ঠান্ডা ঢুকবে কোথা দিয়ে? একটা কাজের কাজ করেছ - তোমার বৌদি দেখে বেশ খুশি হবে!
(ক্রমশ)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।