বিবিধ

খাল-বিলের আখ্যান (ষষ্ঠ পর্ব)



মমতা বিশ্বাস


মার্চ মাসের শেষে ভোটের দামামা বেজে উঠল। ত্রি-স্তর পঞ্চায়েত ভোট। ঢাক-ঢোল বাজিয়ে জেলা শহরে নমিনেশনপত্র জমা দেওয়া শুরু হয়ে গেল। রাস্তা-ঘাটের দুই ধারে কলাফুলের ফেস্টুনে ছয়লাপ। ক্লাবে সন্ধ্যে হলেই রঙিন জলের বোতলের পেটি আসছে। যে ভাবেই হোক অঞ্চল তাদের দখল নিতেই হবে। দলের দাদারা বোঝাচ্ছে ক্ষমতায় তারাই আছে অন্যদল পঞ্চায়েত পেলে কোনো উন্নয়ন হবে না। গত পাঁচবছরে শালুকফুল পঞ্চায়েত পেয়ে কী দিয়েছে মানুষকে? তারা, এবার কেউ পায়তারা ভাজলে সুদে-আসলে উশুল করে নেবে। রাস্তা-ঘাটে-মাঠে-দোকানে একটাই আলোচনা - 'ভোট'। খুবলে খুবলে ইট উঠে পড়া রাস্তায় তরুণ যুবক বাইক বাহিনী ধুলোর ঝড় তুলে হুস্ হাস করে যাতায়ত করছে। কঞ্চিতে বাঁধা ফেস্টুন বো বো করে ঘোরে বাতাসে। আমজনতাকে এভাবেই ঘোরাতে চাই। তাদের মর্জি মতো। ক্ষমতার জাহির এভাবেই দেখায়। শালুকফুল পঞ্চায়েত পেল বলে, গ্রামের রাস্তাটায় পিচ পড়ল না। দুর্ভোগ সবাইকেই ভুগতে হচ্ছে। বিলের খালটা সংস্কার হল না। যেটা খুব জরুরী ছিল। কেউ বলে টাকাটা ফেরৎ গেল, কেউ বলে পকেটে ঢুকল। খালটা সংস্কার হলে পাট নিয়ে এ অঞ্চলের চাষীদের এমন দুর্ভোগ পোহাতে হত না। রেশন, ঘর, বিভিন্ন ভাতা, শ্রীর টাকা সুষ্ঠু বণ্টন হয়নি - এসবই ভোটপর্বে আলোচনার বিষয়। আলোচনা থেকে তর্ক-বিতর্ক। হাতাহাতিতে পৌঁছে যায় কখনও কখনও। মণিকুমার শ্রোতা। গণ্ডগোল জোরালো হয়ে উঠলে সরে যায় সেখান থেকে। বৈশাখের পয়লায় প্রচণ্ড বৃষ্টিতে তিলের জমিতে জল জমে গেল। জল বেরিয়ে যাওয়ার একমাত্র রাস্তার মুখে কলাফুলের নেতার জমি।

সরকার বাড়ির মেজকর্তা বলছিল, "ছবিরউদ্দিন তোমার জমির আলটা কেটে দিলে জল বেরিয়ে খালে পড়বে; নাহলে পেকে ওঠা তিল নষ্ট হয়ে যাবে। অনেক চাষীর ক্ষতি হয়ে যাবে।"

দুই এক কথায় তর্কাতর্কি। মাঠে দুইপক্ষের লোক জড়ো হয়ে বিশাল গণ্ডগোল। শেষে রক্তারক্তি হয়ে গেল। জল জায়গায় বসে গেল। অপুষ্ট তিল গাছ, শিকড় পচে হলুদ হয়ে গেল।

ভোটের নমিনেশন জমা দেওয়ার আগে এই বুথের কাস্তে সমর্থকরা মিটিং এ বসেছিল। আগেরবার তারায় পেয়েছিল, ফলে মণিকুমারদের বুথে কোনো কাজ হয়নি। পঞ্চায়েতে গিয়ে পিছনের সারিতে চুপ করে বসে থাকতে হয়েছে মেম্বারকে। কোনো কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। শালুক ফুলের হাওয়া ভালো‌, তাই কাস্তে ছেড়ে শালুকফুলের দলে যোগ দেবে তারা। তাছাড়া দলের মধ্যে একটা ধর্মীয় ধর্মীয় ভাব আছে। যে ভাব বহু মানুষ কে খুব সহজে একছাতার তলায় আনা যায়। আফিং- এর মতো। মণ্ডলবাড়ির পাঁচটি পরিবার দল বদল করলেও একটি পরিবার কাস্তেতে থেকে গেল, ফলে রেষারেষি চরম পর্যায়ে। বাবা-ছেলের দল আলাদা। এক সপ্তাহ পরেই ভোট।

বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলল। ৪৫ ডিগ্রী। তার সঙ্গে জুড়ে গেল ভোটের গরম। গ্রামে -গঞ্জে মানুষ মরার হিড়িক লেগে গেল। পড়ছে কী মরছে, বা রাত্রে শুয়ে আর উঠছে না। বয়স সব ৩০ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। প্রচুর মৃত্যুর অভিঘাতে শোক ক্ষণস্থায়ী! শোকের রেশ তাড়াতাড়ি কাটিয়ে ভোট মহোৎসবে মেতে উঠেছে। বঙ্গে অদ্ভুত একটা সময় চলছে।

মণিকুমার সন্ধ্যেবেলায় মাঠ থেকে এসে হাতপা ধুয়ে টিভিটা অন করে বসেছে সবে। ABP চ্যানেলে খবর শুনবে। ভোটের সাতকাহন। ভালো না লাগলে সিরিয়াল দেখবে।

"মণিকুমার বাড়ি আছো নাকি? বলে ডাকল মেজ সরকার।"

"আছি।" বলে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে তার সঙ্গে পাড়ার আরও পাঁচ/সাত জন উঠোনে দাঁড়িয়ে। মণ্ডল মশাই বলে ওঠে, "ভোট দুটো আমাদের দিও। তোমার খুড়িমা আমাদের বুথে দাঁড়িয়েছে। এবার মহিলা সিট কিনা। শালুক ফুলেই ভোটটা দিও। আগের বারের মতো এবারও শালুক ফুল পঞ্চায়েত পাবে। কাস্তের দল আমরা ছেড়ে দিয়েছি। কাস্তের দল আর কোনোদিন পঞ্চায়েত পাবে না। নিজেদের সুবিধে পেতে আর রাস্তাঘাটের উন্নতি করতে হলে পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে থাকলে চলবে না। বউমাকে বোলো ভোটটা আমাদের যেন দেয়।"

মণিকুমার ঘাড় নেড়ে সায় দেয় ঠিকই কিন্তু শালুকফুলে ভোট সে দেবে না। ফুলটুসিও রাজি হবে না। বিলের খাসের জমির দখলদারি কাস্তের দলের লোকেরা দিয়েছিল। বড়োসরকারের দল লড়েছিল বলেই না বসতবাড়ির জন্য তার বাবা পাঁচ কাঠা জমির পাট্টা পেয়েছিল। মণিকুমারের মা গল্প করত সরকার বাড়ির ফ্যান জলে তারা ভাই-বোনেরা বড়ো হয় উঠে। বড্ডো দয়ালু ছিল বড়োসরকার মশাই। উনি পঞ্চায়েত প্রধান থাকাকালীন এই বিলের মাঝ বরাবর খাল কেটে গ্রামবাসীদের কতবড়ো উপকার করেছিলেন। দুই ফুলের গুতোগুতিতে কাস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। ন্যায় -সততা ধুলোয় লুটোচ্ছে। এই সব রান্নাঘরে ঢোকা রাজনীতি নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে না পারলেও ; মণিকুমারের ভালো লাগে না। ভোট আসলে পাড়ার মানুষরা কেমন হয়ে ওঠে। চেনা যায় না। কখন যে, কে কোনদিকে গড়াবে বোঝা যায় না। উঠোনে দাঁড়িয়ে মণিকুমার এই সব কথা ভাবছিল।

"অত ভাবার কী হল? আমি শালুক ফুলে ভোট দেব না। তেমন হলে ভোটই দেব না। সন্ধ্যের পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসানি, টাকার লোভ দেখাচ্ছে। ভোট কেনা-বেচা বাপের জন্মে শুনিনি।"

"ভোট না দিলি গ্রামে বাস কত্তি পারব? চারপাশতে ছিড়ে খাবে না। তিনদলের মদ্দি গণ্ডগোল। কেউ, কারও বাড়ি যায় না। যে কুনু একটা দল ধরে থাকতি হবে। মণ্ডল বাড়ির পাঁচ গেরস্ত দুই দল হয়েছে। কাঁচি আর শালুকফুল। ছোটোছোটো ছানাপুনারা কাকি-জ্যেঠির সাতে কতা কয় না।"

"ভারি খারাপ। কী মিল ছিল সব। কাকি-জ্যেটির ঘরে না খেলি পেট ভরিনি। আর একন মাথায় ঠুল লাগলিও কতা কয় না।"

"শোন ফুলটুসি কালু ৫০০ টাকা নিয়ে সাধাসাধি করচে কলাফুলে ভোট দিয়ার জন্যি।"

"খবরদার টাকা নেবা না। পছন্দ যাকে তাকে ভোট দেবা। কলাফুলের নেতারা সরকারের ঘর করে দেবে বলে লিখে নিয়ে গেল। আশায় ছিলাম সরকারেরতে পাওয়া টাকার সাথে সমিতির জমানো টাকা দিয়ে দুই খোপ দালান দেব। পোড়া কপাল আমার। সেই টাকা নাকি কলাফুলির দলের হারু মিস্ত্রী পায়েচে।"

"সে তো দেবেই। কলাফুলির নেতার ল্যাজ ধরে ঘোরে। বিডিও আইসেই বা কি হল? কিচ্চু না। তনুর বিয়েতে চার হাজার টাকা কাটমানি দিয়ে, তবে কন্যাশ্রীর টাকা পায়। এ সব তো আর কারও অজানা নেই।"

"ওই পাড়ায় এত হৈচৈ হচ্ছে ক্যান ?"

"দাঁড়া দেকে আসি। মনে হচ্চে মণ্ডল বাড়ি গণ্ডগোল লাগেচে।"

গ্রামপঞ্চায়েতের ভোটের উত্তাপে গ্রামবাসীদের একটাই আলোচনার বিষয় ভোট। বুথ দখল, পঞ্চায়েত দখল, পঞ্চায়েত সমিতি দখলের লড়াই-এ গ্রামের আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে ওঠে; সীমান্তবর্তী স্পর্শকাতর আর পাঁচটা গ্রামের মতো। গণ্ডগোল হচ্ছে মণ্ডল বাড়িতে। হাড়ি পৃথক হলেও উঠোন একটায়। কর্মসূত্রে ছেলেরা উত্তর প্রদেশে থাকে। ভোট দেওয়ার জন্য বাড়ি এসেছে। জড়িয়ে পড়েছে ভোট আবর্তে। বাবা একদলের সমর্থক, ছেলে অন্যদলের।

না হলে এমন কাণ্ড হয়? ছোটোদের মনে বিষ ঢোকায় কেউ! একান্নবর্তী পরিবারের উঠোনের এ-মাথায়, ও-মাথায় ডিজের গুঁতোগুঁতি চলে রাত বারোটা পর্যন্ত! সেজোর নাতি আর মেজোর নাতির মানতের কালীপূজো। একই দিনে করতে হল? করুণা পাল পর্যন্ত তাজ্জব বনে গেছে। ভিন্ন হলেও একই বাড়িতে একই দিনে মায়ের আরাধনা ! ঠাকুর বায়নার সময় ছোটো মণ্ডলকে করুণা পাল বলে, "দশ-বারোটি গ্রামের সব ঠাকুর আমি বানায় কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে এমন অভিজ্ঞতা হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। ভায়ে ভায়ে পাল্লা দিয়ে পুজো? ভালো কাজ নয় মণ্ডলের পো। এই আমাদের গ্রামে দেখ তিনদলের সমর্থকরা আছে। কোনো গণ্ডগোল নেই। রাসোৎসব গ্রামের সবাই মিলে করে। মত আলাদা হতেই পারে, তাই বলে ভায়ে ভায়ে এমন রেষারেষি! ভালো নয়, ভালো নয়!

সেদিনের গণ্ডগোলে কালুর মাথা ফেঁটে পাঁচটা সেলাই পড়েছে। আসলে কালুকে নিয়েই গণ্ডগোল। রক্ত প্রচুর বেরিয়ে গেছে। ভীষণ দুর্বল। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। ফুলটুসি ওকে দেখতে গিয়ে বলেই ফেলল, মাথা ফেঁটে তোর ভালোই হয়েছে। তোকে নিয়ে একটা চাল চালতে চেয়েছিল কলাফুলির নেতারা। শোনা যাচ্ছে তোকে শেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছিল। ভোটের দিন কলাফুলের দল কাজ হাসিল করে একটা অস্থির অবস্থার সৃষ্টি করে ছাপ্পা ভোট দেবে। তুই,ওদের ভোট কেনার কাজ নিয়েছিলি। সন্দেহের তালিকায় আর থাকল না ওরা। উল্টে প্রচার করত ব্লাকপার্টির লোকেদের কাজ। একটু বুদ্দি নিয়ে চল।"

"এট্টু ভালো করে বুজিয়ে যা রাঙাবউ, তোর কতা একটু মান্যি করে। কানা, খোড়া তিনডে পেট ওর উপর। ও, না থাকলি, না খায়ে মরে যাব না?"

"কীরে কালু, তোর বুদ্ধি কবে হবে বল তো? গরীব মানুষগের ওসবের তে দুরে থাকতে হয়। এই বুড়োমানুষটার আর কষ্ট দিসনে। কালু ভোট বুজেসুজে দিস। দিদি, তুমি ও তোমার ভোট দিবা। অন্য কেউ ভোট দিয়ে দিতি চালি রাজি হবা না। খালের জিয়োলমাছ দিয়ে গেলাম, কাঁচকলা, পেঁপে দিয়ে ঝোল করে দিও। যায় রে কালু। সাবধানে থাকিস।"

বাড়ি ফিরে ফুলটুসি তুলসীতলায় সন্ধ্যেবাতি দিয়ে চাল ধুয়ে হাড়ি উনুনে বসিয়ে দিল। রান্না শেষের মুখে মণিকুমার বাড়ি এল। টুসিকে বলে, "ভোট করতি আসা লোকগের রাতির রুটি তরকারি করে দিতি হবে। ওগের একজন দুকানে মোমবাতি কিনতি আইসে আজ রাতির আর কাইলকের সকালের আর দুপুরের খাবার বানিয়ে দিয়ার লোকের খোঁজ কচ্চিল। কেউ কোনো কথা কয় না। মুক দেকে বড্ড মায়া হল না খায়ে থাকপে, আমিই আগ বাড়িয়ে বললাম, "কয়জনের খাবার, কী খাবে? জানালি -আমার বউকে দিয়ে বানিয়ে দেব। তা লোকটি বলল, 'পাঁচ জনের।"

(ক্রমশ)

আলোকচিত্রঃ লেখিকার কাছ থেকে প্রাপ্ত।