আজকে তপনবাবুর বই উদ্বোধন হবে বইমেলায়। 'নাগ পাবলিশার্স' থেকে। তপনবাবু হরিপালে থাকেন। তার পক্ষে ট্রেন বাস ঠেঙিয়ে করুণাময়ীর 'বইমেলা প্রাঙ্গণ'-এ হাজির হওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তবু প্রথম বই প্রকাশ বলে কথা। বিশে জানুয়ারি শনিবার মেয়ে জামাই গিন্নি সকলে মিলে তপনবাবুর বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে হাজির হবার জন্য সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়েন। তপনবাবু সবাইকে নিয়ে ট্রেনে চেপে বালিতে নেমে তারপর ট্যাক্সি করে বইমেলায় যাবেন এরকমটাই ভেবেছেন। উনি বহুদিন ধরে বিভিন্ন ছোট পত্র-পত্রিকায় গল্প লিখে আসছেন। কিন্তু ওঁনার নিজের একক গল্পের বই প্রকাশ হবে তা কখনও ভেবে উঠতে পারেননি। রিটায়ার করার পর এক বন্ধুর সুত্রে এই পাবলিশার্সের সাথে আলাপ। কিছু টাকাকড়ি খসালে দিব্যি তাঁর নিজের নামে একখানি বই প্রকাশ হবে এই নিশ্চয়তা পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রণাঙ্গণে। প্রথমে বৌ মুখ ফিরিয়ে থাকলেও শেষে বরের উৎসাহে ওঁনার পাশে থাকবেন - কথা দিলেন। বালিতে নেমে ওঁনারা ট্যাক্সি ধরলেন। বালি ব্রীজে যথারীতি জ্যাম। ফাঁকায় ফাঁকায় থাকা তপন-বৌদির তখন হাঁসফাঁস অবস্থা। যাক দুগ্গা দুগ্গা বলে আরও মিনিট চল্লিশের পর ওঁনারা পৌঁছতে পারলেন করুণাময়ী বাস স্ট্যান্ডে। এবার নির্দিষ্ট দোকানের নম্বর খোঁজার পালা। পাবলিশার্স বলেছেন ৪০৪ নম্বর দোকান। মনে হয় ৪ নম্বর গেটের সামনে। তপনবাবুর সেটুকুই মনে আছে। ভাবলেন একবার ফোন করে নেবেন। জামাই ফোন লাগালো। ও হরি! নট রিচেবল... নট রিচেবল... বলেই যাচ্ছে। যাই হোক একটু এদিক ওদিক লোককে জিজ্ঞেস করে হাতে ম্যাপ নিয়ে ওঁনারা মেলার ভেতরে ঢুকে হাঁটতে শুরু করলেন। বৌদির তখন বেশ শরীর খারাপ লাগছে। মেয়েকে, বরকে বিরক্ত করে যাচ্ছেন 'আর কত দূর' 'আর কত দূর' বলতে বলতে। যারা কলকাতা বইমেলায় যান তারা ভালোমতো জানেন যে পায়ে জোর না থাকলে ও তল্লাটে না যাওয়াই ভালো। যাক গে তপনবাবু মেয়ে ছোট থাকতে গিন্নিকে নিয়ে একবার বইমেলায় এসেছিলেন। তারপর নিজে দু একবার একাই ঘুরে গেছেন। গিন্নির হাঁটুতে অস্টোআর্থারাইটিস। তাই ওঁনার জন্য এই হাঁটা আর ভীড়ভাট্টা বেশ কষ্টদায়ক। তবু স্বামীর গর্বে গর্বিত হতে কে না চায়! প্রায় মিনিট পনেরো খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেলো ৪০৪ নম্বর স্টল। প্রকাশক মশাই খুব ব্যস্ত। শুধু তো তপনবাবুর নয় তার আজকে আরও সাত জন লেখক লেখিকার বই প্রকাশ। প্রকাশ করবেন একজন নাম করা গল্পকার শ্রী রাজীব ভট্টচার্য। তিনি আসছেন গাড়িতে। গেটের কাছে উনি লোকও পাঠিয়েছেন। ছোট জায়গা। সাত জন লেখক লেখিকা ও তাদের সঙ্গীদের ভীড়ে জায়গাটা সরগরম। অথচ খান পাঁচেক চেয়ার। কারুরই প্রায় বসার জায়গা নেই। তপন-বৌদি পরিস্থিতি দেখে বেশ বিরক্ত। বরের বুড়ো বয়সের ভীমরতি আর সহ্য হচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পরে লেখকেরা সবাই হাতে নিজেদের বই নিয়ে দাঁড়ালেন। অতিথি লেখক প্রত্যেকটি বই হাতে নিয়ে তাদের ফিতে খুলে উদ্বোধন করলেন। খচাখচ ছবি উঠছে। তপনবাবুর জামাই-এর মোবাইলটা বেশ দামী। ভালো ছবি ওঠে। শ্বশুরমশাই-এর ছবি তোলার সাথে সাথে অল্পবয়সী লেখিকাদেরও ছবি তুলে দিচ্ছে ফটাফট। লেখিকারা তাদের নিজেদের মোবাইলও এগিয়ে দিচ্ছেন তপনবাবুর জামাইকে। জামাই একটু বেশীই মনপ্রাণ ঢেলে ছবি তুলছে। বরের কান্ড দেখে মেয়েরও রাগ হচ্ছে অল্পস্বল্প। নিজের গুরুত্ব যেন কমকম ঠেকছে।
এবার সব নবীন-প্রবীণ লেখকেরা নিজেদের বই বিষয়ে বক্তব্য রাখতে থাকেন ছোট করে। তপনবাবু লেখিকাদের দিকে তাকিয়ে নিজে কী বলবেন খেই হারিয়ে ফেলছেন। প্রকাশককে ধন্যবাদ দিয়েই তাড়াতাড়ি কাজ সারলেন। রাখী বলে একজন অল্পবয়সী লেখিকা তপনবাবুকে 'কাকু' বলে ডাকাতে ভেতরে ভেতরে তাঁর একটু উষ্মাও হচ্ছে। কিন্তু সামনেই মেয়ে, বৌ। কিছু বলাও যাচ্ছে না। তারপর যখন একজন সুন্দরী লেখিকা তপনবাবুর লেখা আগে পড়েছেন বলে খুব প্রশংসা করলেন তখন তো তপনবাবু একেবারে গদগদ। ওঁনার সাথে ছবি তোলার পোজ দিতেই গিন্নি তড়িঘড়ি এসে তপনবাবুর আর এক দিকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। জামাইকে বললেন তোলো আমার সঙ্গে। সুন্দরী লেখিকা তো তপন-বৌদির কান্ড দেখে হেসে ফেলেছে ফিক করে। তপনবাবু লজ্জায় অপমানে লাল হয়ে গিন্নির দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাতে যেতেই দেখেন মেয়ে আর বৌ গটমট করে হাঁটা দিয়েছে গেটের দিকে। জামাই ইশারায় বলছে, 'ওদিকের কেস জন্ডিস'। পরিবারের এইরকম কান্ডজ্ঞানহীন ব্যবহার দেখে তপনবাবুর লেখক হৃদয় পাষাণ হয়ে গেলো। কিন্তু যাই হোক একা তো ছাড়া যায় না গিন্নিকে। রিটায়ার্ড মানুষের যে বৌ বিনে প্রাণ টেকে না। এই বয়সে বই-এর থেকে বৌ আগে দরকার। তাই জামাইকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে বলে নিজে কোনওরকমে প্রকাশক ও অগ্রজ লেখকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছুটতে শুরু করলেন। প্রকাশকের দেওয়া খাবারের প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার নেবার কথাও খেয়াল করলেন না। পেছনে পড়ে রইলো সঙ্গী লেখক-লেখিকারা আর তাদের গল্প, আলাপ-আলোচনা, হাসি-ঠাট্টা সব। তপনবাবু ছুটলেন বইমেলা ছেড়ে ঘরের পানে - সংসার সান্নিধ্যে।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।