নিঃসঙ্গ আলোর কাছে চুপ করে বসি। স্তব্ধতার গান শুনি একা রাতে। এখন আলোর মুখে কুয়াশার মুখোশ পরা আছে। ঘুম এসেছিল, উপেক্ষিত হওয়ায় চলে গেছে। ঠান্ডা রঙের ছবিতে ফুটিয়ে তুলছি অন্ধকার। আলো জ্বেলে যে আঁধার দেখা যায় না তার ভিতর থেকে তুলে এনেছি অনুভব। অনুভবের আলো নিয়ে খেলতে ভাল লাগে। কীভাবে, কী গতিতে রাত্রি এগিয়ে চলেছে তা মালুম হচ্ছে মাঝেমধ্যে। এই ঘুম না আসার সুযোগে কাল অসময়ে ঘুমানোর সুযোগ খুঁজতে হবে সারাদিন। শহরের এই প্রান্ত এলাকায় এখনও মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। এইমাত্র যেমন শোনা গেল।
ছবিগুলো আজ অন্যরকমভাবে ধরা দিল। শব্দকে আজ ডাকাডাকি করিনি। ওদের বিশ্রাম দিয়েছি। প্রযুক্তির ব্যবহারে কী শব্দ, কী ছবি, কী সাহিত্য, কী শিল্প - সবই চোখ রাঙানির মুখে। অস্তিত্ব বিলোপের মুহূর্তে নিজেকে প্রাণপণ বাঁচানোর চেষ্টা করতেই এরা ভিড় করে ডাকাডাকি করছে। আমিও সাড়া দিয়ে ঘেঁটে যাচ্ছি রং আর ইজেলের বাক্স, মোবাইল ফোন। হ্যাঁ, আমিও প্রযুক্তির দাস হয়ে পড়ছি ক্রমশ। এই যেমন এখন। মোবাইলের স্ক্রিনে টাইপ করতে করতে ভুলে যাচ্ছি ঘড়ির শাসানি। ভুলে যাচ্ছি কাল সকালের গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা। এ আমার ভোলার অবসর, অথবা অবসরের ভুল।
ভুল ভুলে থাকার মধ্যে অনেক সময় অনেক নতুন ছবি তৈরি হয়। এখনও হচ্ছে।
আশা ও আশঙ্কার রং, তুলিতে অবচেতনের অন্ধকার ধরা পড়ল কিনা সে বোঝার ক্ষমতা আমার নেই।
তবে স্বপ্নের গায়ে কিছু রং এসে পড়ছে বুঝতে পারছি। চুপ করে থাকলে অনেক কিছুই অনুভব করা সহজ হয়ে পড়ে। তবু চুপ থাকতে না পারায় অনেক কিছু হারাতে হয়েছে। ভবিষ্যতেও যে হবে তা জানি। তবে এ মুহূর্তে আমি এক্কেবারে চুপ। সঙ্গীহীন আলোর রঙের গল্প শোনা শেষ করে লিখে রাখছি অন্ধকারের শীৎকার। কিছুদিন আগেই দৃষ্টিশক্তি খুইয়ে ফেলার ভয়ে আমার পরিচিত এক শিল্পীকে চোখ বন্ধ করে কালো পেন আর কাগজে রেখাচিত্র আঁকার রেওয়াজ করতে দেখে এসেছি। কী অদ্ভুত! একটা চোখের দৃষ্টি চলে গেছে ইতিমধ্যেই। অন্য চোখটিতেও এক্কেবারে ভাল দেখতে পান না। তবু তিনি জানেন না এঁকে থাকতে পারবেন না আর তাই আঁকছেন নতুন কৌশল শিখতে শিখতে। এ লেখাও তেমন। একপ্রকার রেওয়াজ। কোনও প্রয়োজন ছিল না এই লেখার। তবু ছবির দুনিয়া থেকে উঠে এসে লিখতেই হল দু'চার কথা। হয়তো শিল্পী জীবন এমনই। তাঁরা যে সবসময় আঁকেন এমন নয়। না এঁকে থাকতে পারেন না বলেই এঁরা রং, তুলি, ক্যানভাস থেকে বঞ্চিত হলেও সাদা খাতায় আঁকতে থাকেন তাঁর দুর্ভাগ্যের ভবিষ্যৎ কাহিনি। একজন লেখক বা কবিও ঠিক তাই। না লিখে থাকতে না পেরেই তিনি লিখতে থাকেন তাঁর অন্ধকার অবচেতনের অহংকার। চারপাশের স্তব্ধতা বা কোলাহলের বোঝার কথা নয় এ সাধনার অভিশাপ। ভোর হতে আর মাত্র তিনঘণ্টা। সত্যিই কি তাই? দিনের আলোর দেখা পেলেই কি সব অন্ধকার কেটে যাবে? রাজনীতির দুর্নীতি কেটে যাবে? কাজের অপ্রতুলতা কেটে যাবে? খিদের কান্না কেটে যাবে? ধর্মের নেশা কেটে যাবে? মিথ্যা ভাষণ আর স্বৈরাচারী শাসন কেটে যাবে? যুবকের অলসতা কেটে যাবে? কিশোরের পাবজি'র নেশা কেটে যাবে?
উত্তর নেই আমার কাছে। শুধু মনে হয় একজন চিত্রশিল্পী যখন ৯০ ভাগ দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে নতুন করে আঁকার রেওয়াজ করছেন নিয়মিত, তখন এখনও আশা আছে। আছে দিনের আলো আর রাতের অন্ধকার কাটিয়ে ফেলার আধনার সুযোগ। হ্যাঁ এখন আমাদের প্রতিবাদ করার শক্তির জন্য সাধনা করতে হবে। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের আলোয় এই সমস্ত অন্ধকার একসময় কেটে যাবেই।
সাধনার জন্য, শিল্পের জন্য, স্বাধীনতার জন্য মাঝেমধ্যে অন্ধকারের আলো খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। তাতে যদি ঘুম না আসে এক একদিন তাহলে তার আনন্দই আলাদা। সুরে, শব্দে, রেখায়, রঙে চুপ করে নিজের সাথে কথা বলার এই সুযোগ না হারিয়ে নির্জনে নিজস্ব সংগ্রামের সময় এখন। দিনের আলো থাকুক বা রাতের অন্ধকার, মনে রাখতে হবে অন্ধকারের এক নিজস্ব আলো আছে আর আমাদের সেই খোঁজ চালিয়ে যেতেই হবে।