বিবিধ

হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার সার্কাস



তুষার ভট্টাচার্য


কবি ভাস্কর চক্রবর্তী একদা রমণীয় শীতের আবাহন করে লিখেছিলেন অনুপম পংক্তিমালা - "শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা, আমি তিনমাস ঘুমাবো"। আর এক বিখ্যাত কবি বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন - "শীতের প্রার্থনা বসন্তের উত্তর"। বস্তুত, শীতের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে আমবাঙালির একধরনের রোমান্টিক বিলাস এবং এই বাংলায় মনোরম শীতের সময়ই নানা ধরনের মেলা, যাত্রাপালা এবং সার্কাসের উপস্থিতি দেখা যায়। বর্তমানে বাংলার লোকায়ত যাত্রাপালার বিজ্ঞাপন, সংবাদপত্রে পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়ায় নজরে পড়লেও, সার্কাস প্রদর্শনের কোনও বিজ্ঞাপন বা প্রচার তেমনভাবে নজরে আসেনা।

বাংলার বুক থেকে শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জনের অন্যতম মাধ্যম সার্কাস কি তবে চিরতরে হারিয়ে গেল?

মোটামুটিভাবে ন'য়ের দশক পর্যন্ত জাম্বো সার্কাস, অলিম্পিক সার্কাস, ফেমাস সার্কাস, ভারত সার্কাস, অজন্তা সার্কাস প্রভৃতি সার্কাসের দলগুলি শীতকাল এলেই কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন জেলায় শো প্রদর্শন করত।


প্রিয়নাথ বসু (১৮৬৫-১৯২০)

প্রসঙ্গত, অভিবক্ত বাংলায় ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়নাথ বসু (১৮৬৫-১৯২০) সর্বপ্রথম 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস' নামের একটি সার্কাসের দল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর এই সার্কাসের দলে সুশীলা সুন্দরী (১৮৭৯-১৯২৪) নামে এক বাঙালি মহিলা সেকালের সামাজিক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সার্কাসের এরিনায় বিভিন্ন খেলা প্রদর্শন করেছেন। পরবর্তীতে প্রফুল্ল ঘোষ, গণপতি চক্রবর্তী, সুরেন্দ্রমোহন বসু প্রমুখ সার্কাসে বিভিন্ন খেলা প্রদর্শন করে সুনাম অর্জন করেছেন।


সুশীলা সুন্দরী (১৮৭৯-১৯২৪)


বিষ্ণুপন্থ মোরেশ্বর (১৮৪০-১৯০৫)

অবশ্য ভারতে প্রথম সার্কাসের দল তৈরি করেছিলেন কেরালার বিষ্ণুপন্থ মোরেশ্বর (১৮৪০-১৯০৫)। তিনি ১৮৮৭ সালে 'গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস' দল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময়ে তাঁর সার্কাস দলে দেখানো হতো জাগলিং, তলোয়ারের খেলা, ক্লাউনদের হাসি-ঠাট্টার মজা এবং জন্তুজানোয়ার আর পশুপাখির প্রদর্শন। কেরালা সরকার সার্কাসকে রাজ্যে এবং দেশে জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ১৯০১ সালে থালাসেরি নামক জায়গায় 'সার্কাস একাডেমি' তৈরি করে। বিশিষ্ট সার্কাস খেলোয়াড় কুনকি কানন এবং এম. কে. রহমান এই সার্কাস একাডেমি থেকেই উঠে আসেন।


ফিলিপ অ্যাশলে (১৭৪২-১৮১৪)

যদিও ভারতে নয় সার্কাসের জন্ম হয়েছিল গ্রেট ব্রিটেনে ১৭৭০ সালে সালে। ইংরেজ অশ্বারোহী ফিলিপ অ্যাশলে (১৭৪২-১৮১৪) এবং তাঁর স্ত্রী প্যাটি জোন্স 'রয়্যাল সার্কাস' নামের একটি সার্কাস কোম্পানি তৈরি করেন। তাঁরাই সর্বপ্রথম সার্কাসের এরিনায় সংগীতের ব্যবহার করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করতেন। ফিলিপ অ্যাশলেকেই 'সার্কাসের জনক' বলা হয়ে থাকে।

বস্তুত কিছুদিন আগেও বাংলার জেলা-শহর-মফস্বলে সার্কাস এলেই দেখা যেত ভাঙা জিপগাড়িতে মাইক লাগিয়ে ভাঙা হিন্দি-বাংলা মেশানো প্রচার এবং লিফলেটও বিলি করা হত। 'কলকাতার যীশু'র মতো সমস্ত রাস্তা স্তব্ধ করে মন্থর, ধীর লয়ে কলা গাছ খেতে খেতে হেঁটে যেত গলায় ঘন্টি লাগানো হাতি। ছোট, কচিকাঁচারা এই দেখে মহানন্দে হাতির পিছনে ছুটতো।

সেইসময় শীতকালে মাঠজুড়ে সার্কাসের তাঁবু টাঙানো হতো। তাঁবুর ফাঁক দিয়ে দেখা যেত লোহার খাঁচায় বন্দী বাঘ, সিংহ, বাঁদর প্রভৃতি। গালে রঙ মেখে জোকারদের হাসি মশকরাও ছিল সার্কাসের আর এক অন্যতম আকর্ষণ।

প্রসঙ্গত, ন'য়ের দশকের পরে কেন্দ্রের 'পশু ক্লেশ নিবারণি আইন' মোতাবেক সার্কাসে বাঘ, সিংহ প্রভৃতি পশুর খেলা প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে সার্কাসের আকর্ষণ একদমই কমে যায়।

বিশেষত, শিশুরা পশুহীন সার্কাস দেখার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। এছাড়াও ইদানীংকালে টিভিতে 'ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক' এবং 'ডিসকভারি' চ্যানেল দেখার ফলে তাঁদের কাছে সার্কাসে গিয়ে পশুপাখির খেলা দেখার তাগিদও একেবারেই কমে গিয়েছে।

এই আধুনিক বিজ্ঞানের সময়ে লোকায়ত অনেক কিছুই কালের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে। সার্কাসও সম্ভবত শিশুদের কল্পনার জগৎ থেকে বিলীন হতে চলেছে। এটাই আক্ষেপের বিষয়।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।