গল্প ও অণুগল্প

আমার মা (চতুর্থ পর্ব) [ধারাবাহিক উপন্যাস]



অচিন্ত্য সাহা


।। ৪ ।।

আমার বাড়ির কেউ আমার খোঁজ নিতে আসেনি বা যোগাযোগও করেনি। সেটা নিয়ে আমার মনে কোনো দ্বিধা ছিলো না। কেননা যে অনিশ্চিত জীবনের পথে চলতে শুরু করেছি সেই সখ আমার একান্তভাবেই নিজের, সে পথ যতই কঠিন বা কণ্টকিত হোক না কেন তা আমাকে একাই অতিক্রম করতে হবে। কে আমার খোঁজ খবর রাখলো বা না রাখলো তা আমার মনে কোনোভাবেই রেখাপাত করলো না। তখন আমার একটাই লক্ষ্য আমাকে অনেক দূর যেতে হবে, অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে, পিছনে তাকাবার কোনো অবকাশ নেই।

দেখতে দেখতে দু'বছর কেটে গেল। সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা, এর জন্য অবশ্য আলাদা করে প্রস্তুতি নিতে হয়নি। প্রতিদিন নিয়ম করে পড়াশোনা করেছি, শুধু প্রতীক্ষায় ছিলাম কবে সেই শুভক্ষণ আসবে। প্রথম দিন বাংলা প্রখম ও দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা। আমি কোনোদিনই পরীক্ষার আগের দিন বইয়ের পাতা উল্টে দেখিনি। পরীক্ষার জন্য ক'দিন টিউশনি থেকে ছুটি নিয়েছি। মনটাকে শান্ত করে একমনে বিষয় ভাবনা একছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই। সেদিন বন্ধুরাও তাদের নিজের নিজের পড়া নিয়ে ব্যস্ত, তাই আমি একা একা বসে বসে নানান কথা ভাবছি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার পর কী করবো, কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করবো, এ ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তির পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। এমন সাত পাঁচ ভাবছি ঠিক সেই সময় বাড়িওয়ালার মেজো মেয়ে একটা বই নিয়ে হাজির। এবার সেও পরীক্ষার্থী, পর পর পাঁচ বার অকৃতকার্য হবার পর এটাই তার শেষ সুযোগ। মাঝে মাঝে আমার কাছে পড়া বুঝতে আসে, অঙ্ক করতে আসে। আমি তাকে নিরাশ করি না। সে এবার যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করছে, পাশ তাকে হতেই হবে নাহলে এ বাড়িতে ভার আর জায়গা হবে না। মনে মনে ভাবলাম হয়তো কালকের পরীক্ষার বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে আসছে। কিন্তু আমার ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিল পাঁচশো পৃষ্ঠার একটি বই - রবিঠাকুরের 'গোরা' উপন্যাস। আমি লোভ সামলাতে পারলাম না। ছোঁ মেরে বইটা নিয়ে নিলাম। আমার রাতের ঘুম ছুটে গেল। সারারাত জেগে পড়ে ফেললাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গোরা' উপন্যাস। ব্যাপারটা অনেকের কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই বাস্তব। পরদিন পরীক্ষার হলে নিশ্চিন্তে পরীক্ষা শেষ করে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ঘরে ফিরে দেখি সুরঞ্জন এসেছে। আমার ছোটো কাকার ছোটো ছেলে। আমার চেয়ে মাস দশেকের ছোটো। ওরা গুমা হাবড়ায় থাকে। মাঝে মাঝে আমাদের এখানে আসে। দাদার বাড়ি থেকে আমার চলে আসার খবর পেয়ে ঠিকানা জোগাড় করে ঠিক আমার এখানে চলে এসেছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম - তুই হঠাৎ এই অসময়ে? এখন আমার পরীক্ষা চলছে।

- কেন কোনো অসুবিধে আছে?

- না, তা নেই। তবে...

- আমি দিদির বাড়ি যাবো। তোর সাথে দেখা করতে এলাম। তুই কী ঠিক করলি?

- কীসের কী ঠিক করলাম। আমি তো মনস্থির করেই বেরিয়েছি। আর কোনোদিনও বাড়ি ফিরবো না। যা করার আমাকে একা একাই করতে হবে। আমার কারোর সাহায্যের প্রয়োজন নেই। যদি কোনোদিন সত্যিকারের মানুষের মতো মানুষ হতে পারি সেদিন ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো, তার আগে নয়।

- ভুল। জীবনে মস্ত বড়ো একটা ভুল করতে যাচ্ছিস। এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি, দেখ এখনো সময় আছে।

- আমি একবার যা স্থির করেছি তার নড়চড় হবে না। আরে, দেখতে দেখতে দু'বছর কেটে গেল। বাকি বছরগুলোও চলে যাবে। আমার লক্ষ্যে অবিচল থাকলে সাফল্য একদিন আমার হাতের মুঠোয় নিজে এসে ধরা দেবে। যাক সেসব কথা। কী খেয়েছিস বল? আমি এখন হাত পা ধুয়ে কিছু মুখে দেবো। তুই কিছু খাবি?

- না, আমি আসার সময় খেয়ে এসেছি, এখন কিছু খাবার দরকার নেই।

- ঠিক আছে। তাহলে তুই বোস আমি ফ্রেশ হয়ে নি। তারপর বাকি কথা হবে।

- নারে, আমি বসবো না। চলি, পরে কোনোদিন...

সুরঞ্জন চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ ওর যাত্রা পখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনের কোণে একটা অযাচিত ব্যখা চিনচিন করে উঠলো, ওটাকে আমল না দিয়ে আমি আমার দৈনন্দিন কর্মে আত্মনিয়োগ করলাম।

(ক্রমশ)