প্রতিরাতেই ঘুমঘোরে শ্লেষ্মা জড়ানো কাশির শব্দ শুনতে পাই। ঘুমঘোরে শুনি বলেই সকাল অবধি তা আর মনে থাকে না সেভাবে। সম্ভবত পাশের বাড়িটা থেকেই আসে। আমার ঘরের বারান্দাটা পেরুলেই একটা দোতলা বাড়ি। ওই বাড়িটার আমাদের দিককার জানালা আর দরজা বরাবর বন্ধই থাকে, কখনো খোলা থাকতে দেখিনি। হয়তো আমার ঘুম থেকে ওঠার আগেই তা বন্ধ করে দেওয়া হয় কিংবা কখনো খোলা থাকে না, নাহয় আমার চোখে পড়ে না। কিন্তু একদিন আমার চোখে পড়লো, শুধু খোলা জানালাই না। জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঠিক যা যা দেখা যায় তার পুরোটাই। তার মধ্যে পড়ে একটা কাঠের সোকেস (যেখানে কিছু বইও আছে), পরিপাটি করে সাদা চাদর বিছানো একটা চৌকি, তার উপরে বালিশ, বালিশে সাদার উপর নীল ফুল তোলা কভার। বিছানার পাশে ছোট্ট একটা টেবিল, সেখানে একটি গল্পের বই উপুড় করা, তারই পাশে রাখা একগ্লাস পানি আর একটি হাতপাখা। ঘরটা এত গোছানো যে নিমিষেই চোখ ফেরানো যায় না। কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতে হয়। সচারাচর তো এমন বাড়ি-ঘর দেখা যায় না। এত অল্প তৈজসপত্র, আর এমন ছিমছাম। ঘরটার দিকে তাকালেই কেমন একটা স্নিগ্ধতা, পবিত্রতা দোলা দিয়ে যায় মনে।
হঠাৎ সম্বিত ফিরে পাই। কেউ দেখলে কী বলবে! কারো ঘরের দিকে এভাবে কেন তাকিয়ে আছি। নিজেকে সামলে চোখ ফিরিয়ে নিলাম দ্রুত। কিন্তু সহসা ঘরের ছবিটা চোখ থেকে সরাতে পারলাম না। এ বাড়িটাতে এসে উঠেছি প্রায় মাস তিনেক হতে চললো। বাড়িওয়ালা ছাড়া আর কারো সাথে এখনো অবধি সেভাবে কথা হয়নি। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময়ই বলে দিয়েছিলাম, 'আমি একটু চুপচাপ থাকতে পছন্দ করি।' তাই হয়তো কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে না। আমিও তেমন কাজ ছাড়া বের হই না কোথাও। এছাড়া কারো সঙ্গে কথা বলার জন্য আগ্রহ বা আকৃষ্টকরে কিছু থাকতে হয়, যা আমি এখনো অবধি কারো মাঝে দেখিনি। শুধুমাত্র একাকীত্ব কাটানোর জন্য যে কারো সঙ্গে কথা বলবো সে বয়স পেরিয়ে এসেছি অনেক আগেই। এখন একা থাকাটাকেই সবথেকে স্বস্তির বলে মনে হয়। কিন্তু আজ এই ঘরটা কেন জানি আমায় আকৃষ্ট করলো। ঘরের মালিকটাকে দেখতে ইচ্ছে করলো, বিছানাটাকে ছুঁয়ে দেখতে মন চাইলো। যেন ওই বিছানাতে আমার শরীর ছোঁয়ানো মাত্রই পবিত্রতায় ভরে উঠবে আমার মন, মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে যাবো আমি। মনে হলো সিলভিয়া প্লাথের সেই টিউলিপ ফ্লাওয়ার কবিতার কথা,
Look how white everything is, how quiet, how snowed-in.
I am learning peacefulness, lying by myself quietly.
As the light lies on these white walls, this bed, these hands.
ঠিক সে সময় মনে হলো, টেবিলের উপর যদি কিছু সাদা টিউলিপ থাকতো! মুচকি হেসে চিন্তাটাকে বাদ দিলাম। এরপর থেকে বেশিরভাগ সময় এ পাশের জানালাটা খুলে রাখি। কারণে অকারণে বাইরে ঘোরাঘুরি করি, রাত জেগে লেখালিখি করি, যদি ও বাড়ির কাউকে দেখতে পাই। কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হই আমি। দেখতে পাই না কাউকেই। তবে শুনেছি, এ পাশের ঘরটাতে দুজন বৃদ্ধ মানুষ থাকেন। স্বামী-স্ত্রী। ভদ্রলোক পেশায় একজন স্কুল টিচার ছিলেন। ভদ্রমহিলাও স্কুল মিসট্রেস ছিলেন। এখন দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত।
প্রায়ই আমার মনে হতে থাকে সেই ঘরটার কথা। চোখ থেকে সেদিনের ঘরের ভিতরের দৃশ্য ভুলতে পারি না।
এমনি একদিন ভোরে উঠে লিখছিলাম। হঠাৎ মনে হলো বারান্দায় কারো অস্পষ্ট ডাক শুনতে পেলাম। দরজাটা খোলার পর সে ডাকটা আরেকটু স্পষ্ট হলো। খেয়াল করে দেখি, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একজন বৃদ্ধা ডাকছেন, "কিছু মনে না করলে আমাদের বাড়িতে একটু আসবে বাবা?" বুঝতে পারলাম ইনিই হয়তো সেই স্কুল মিসট্রেস।
একটু দ্বিধা করে পরক্ষণেই বললাম, “জি, অবশ্যই।” বলে ঘর থেকে বের হলাম। তিনি এ পাশের দরজাটা খুলে দিলেন। গিয়ে দেখি সেই সাদা চাদরের উপর একজন বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। বিছানার পাশে রবীন্দ্রনাথ। ঘরের আরেকপাশে দেখলাম একটা হুইল চেয়ার। তার পাশে আরো একটি কমোড চেয়ার। সেদিন অবশ্য এত কিছু চোখে পড়েনি। অবশ্য কোনোকালেই বাইরে থেকে ঘরের সবকিছু চোখে পড়ে না। দূর থেকে আর কাছে থেকে দেখার বরাবরই এমন পার্থক্য থাকে।
“একটু দেখো তো বাবা, উনি প্রতিদিন রাতে কয়েকবার ঘুম থেকে ওঠেন। কাশতে কাশতে ঘুম ভেঙে যায়। আজ উঠছেন না। ডাকলাম তাও সাড়া দিচ্ছেন না।” বলার সময় কাঁপা কণ্ঠস্বর স্পষ্ট টের পেলাম।
পালস দেখে যা বুঝলাম, তিনি আর নেই। বৃদ্ধা খুব মনোযোগ দিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ করা দেখছেন। আমি ওনার দিকে তাকানোর সাহস কুলিয়ে উঠতে পারছি না। আসলে এই ক’দিনে তো ওনাদের সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আমি পেয়েছিলাম। আর বাকিটা কল্পনা দিয়ে সাজিয়ে নিয়েছিলাম। সেই কল্পনাতে এই দুইটি মানুষকে আমি ভীষণ সুখী দেখেছিলাম। একে অন্যের জীবনে অভ্যস্ত দেখেছিলাম। ঠিক এমনটাই যেখানে একজন আরেকজনের কাশি না শুনতে পেলেও টেনশন করেন।
“কী ব্যাপার, কিছু বলছো না কেন বাবা?”
“কাকিমা, আপনার ছেলে-মেয়েরা সবাই কোথায়?”
উনি অস্ফুট স্বরে কেঁদে উঠলেন বলে মনে হলো। পরক্ষণে মনে হলো সামলে নিলেন নিজেকে। আমি নতুন মানুষ সে কারণেই হয়তো।
আমি আবারো একই প্রশ্ন করলাম।
“ছেলে-মেয়েরা তো ঘুমাচ্ছে। এত ভোরে ডাকলে বৌমা বিরক্ত হয়। তাছাড়া একটু আগে আমি অনেকবার ওদেরকে ডেকেছি। কেউ সাড়া শব্দ দেয়নি। তাই না পেরে তোমাকে ডাকলাম।” ধীরে ধীরে বললেন তিনি।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ রইলাম।
“জানো বাবা, মানুষটা খুব ভালো ছিলেন। ওনার মুখে ‘ছিলেন’ কথাটা শুনে মনে হলো যে, তিনি ঠিক বুঝে গেছেন যে মানুষটি আর বেঁচে নেই। হয়তো বুঝেছেন আগেই শুধু আরেকজনের নিশ্চয়তার দরকার ছিল। আমি হুইল চেয়ার দেখিয়ে জানতে চাইলাম, ‘একা একা চলা ফেরা করতে পারতেন না?”
তিনি জানালেন, দ্বিতীয়বার স্ট্রোকের পর একা একা আর চলাফেরা করতে পারতেন না। শেষের দিনগুলোতে বেশ কষ্ট পেয়ে গেছেন। এই বয়সে একা একা সামলে উঠতে পারতেন না ওনার ভার। শুরুতে সবাই সাহায্য করতো। কিছুদিন পর আর কেউই কাছে আসতে চাইতো না। ছেলেদেরকে ডাকলে রাগে গজগজ করতে করতে এসে ধরতো। বৌমারা অপারগতা জানাতো। তাই একসময় আর কাউকেই ডাকতেন না। তিনি নিজে নিজেই করতেন সবকিছু। কিন্তু পেরে উঠতেন না মাঝেমাঝে। কয়েকদিন না-কি ওঠাতে গিয়ে পড়েও গেছেন। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতেন দুজনেই।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে উঠলেন। “মানুষটার খুব সখ ছিল জানো, তিনি যখন মারা যাবেন তখন ধবধবে সাদা চাদর বিছানো থাকবে। পাশে রবীন্দ্রনাথ থাকবে, সাদা টিউলিপ থাকবে।”
টিউলিপের কথা শুনে আমি একটু চমকে উঠলাম। জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে তাকে বললাম, “টিউলিপ?”
“হ্যাঁ, টিউলিপ। আমাদের বড়ো ছেলে নেদারল্যান্ডে থাকে, সেখান থেকে ছোটো নাতিটা প্রায় ফোন দিয়ে বলতো, ‘দাদু, তোমার জন্য সাদা টিউলিপ ঘরে এনে রেখেছি, কী যে সুন্দর, তুমি যদি দেখতে! তুমি কবে আসবে বলোতো?’ ওর মুখ থেকে টিউলিপের কথা শুনতে শুনতেই টিউলিপ ওনার মনে গেঁথে গেল। সেখান থেকেই সাদা টিউলিপের জন্য এমন করতো। আমি টিউলিপ কোথায় পাবো বলো? এরকম অসুস্থতার মধ্যে ফুলের কথা বললে ছেলেরা বিরক্ত হবে। শেষের দিকে এসে মৃত্যু ভয়টা জেঁকে ধরেছিল, কয়েকদিন পরপরই আমাকে বলতো, ‘সাদা চাদরটা বিছাও তো, সেই যে বিয়ের পরপর আমার জন্য একটা নীল ফুল তোলা কভার বানিয়েছিলে সেটা কই, সেটা এনে বালিশে লাগাও। টিউলিপ ফুল আনতে বলো তো কাউকে।’ কয়েকদিন পরপর এই কথা বলতেন। মাঝে মাঝে একটু বিরক্তও হয়ে উঠতাম। কিন্তু উনি বলতেন, ‘আমাকে কি একটু শান্তিতে মরতেও দিবা না? এই চাদরে মারা গেলে আমি খুব শান্তিতে থাকবো। সাদা টিউলিপ দেখে মনে হবে ফেরেশতারা আমার দিকে তাকায়ে হাসছে।’
এবারে তিনি জোরেই কেঁদে উঠলেন। মৃত্যুর জন্য কোনো সান্ত্বনা আমার জানা নেই। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মানুষকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবো তাও বুঝে উঠতে পারছি না।
কিছুক্ষণ পর জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি চারিদিক আলো হয়ে এসেছে। আমি পাশের রুমে গিয়ে কলিং বেল বাজালাম কয়েকবার। বিরক্ত হয়ে ঘরের দরজা খুললেন বছর পঁয়ত্রিশের একজন। নতুন মুখ দেখে কৌতূহলী হয়ে তাকালেন।
“জি, বলুন।”
“আপনার বাবা মারা গেছেন রাতে।”
কিছুক্ষণ থমকে থেকে কান্না উথলে উঠলো তাঁর মুখে। দৌড়ে ও ঘরে গেলেন। বৃদ্ধা মুখ তুলে চাইলেন না। শুনেছি খুব বেশি শোকে না-কি মানুষের রাগ-অভিমান থাকে না। কিন্তু এখানে তা মনে হলো না। বৃদ্ধা এবারে বিলাপ করতে থাকলেন, “তুই এখন ক্যান আসলি? ওই দ্যাখ, চিনি না, জানি না ওই ছেলেরে ডাকলাম। ও আসছে। তোরে ডেকে পাইনি। তুই যা, ঘুমা। আরো সকাল হোক তারপর উঠিস। এখন তো তোর ওঠার সময় না। যা, যা ঘুমা।”
জোরে কান্নার শব্দ শুনে উঠে এলেন অনেকেই। ধীরে ধীরে লোক সমাগম হতে থাকলো। আমি চলে এলাম ভিড় ঠেলে, রুমের চারিদিকটা আরো একবার দেখে।
মানুষের জীবনে এত এত দুঃখ কেন থাকে, সে কথা আমি ভেবে পাই না আজও। কারো কারো জীবনে একগুচ্ছ সাদা টিউলিপের দুঃখ থেকে যায়। পৃথিবী ছেড়েই চলে যায় এক গুচ্ছ সাদা টিউলিপের দুঃখ নিয়ে। অমর মিত্রের গাঁওবুড়ার কথা মতো কোনো বড়োবাবু কেন থাকে না যে মানুষের সব দুঃখ দূর করে দেয়? কেউ কি পারতো না এই মানুষটাকে এক গুচ্ছ সাদা টিউলিপ এনে দিতে? তবে কি গাঁওবুড়ার সেই লোকটার কথাই ঠিক, “এমন মানুষ আজকাল আর থাকে না, থাকে না।”
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।