গল্প ও অণুগল্প

কন্যাদান



অনিন্দিতা মুখার্জী সাহা


সকাল থেকে হৈ হৈ চলছে সুচরিতাদের বাড়িতে। ছেলে আজ ওর ভাই বোনদের নিয়ে আসবে, বিয়ের আগে বৌদির সাথে একবার পরিচয় করাবে, এটাই উদ্দেশ্য। বিয়ের তারিখ, আর বাকি সব বিষয়গুলো আগেই ঠিক হয়ে গেছিলো, মার্চ মাসের পনেরো তারিখ রেজিস্ট্রি আর আগস্ট মাসে বিয়ে, সুচরিতার বাবা মায়ের ইচ্ছেতেই রেজিস্ট্রিটা আগে করানো হচ্ছে।

সুচরিতার জন্য অবশেষে একটা পাত্র যোগাড় হওয়াতে যেন শান্তি পেয়েছেন অনীশবাবু আর দোলাদেবী।

গ্রাজুয়েশন শেষ করে বাড়িতে বসেই সরকারি পরীক্ষার জন্য পড়াশুনো করছিলো সুচরিতা। দেখতে শুনতে সুন্দরী নয়, অকারণে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে বলেই হয়তো ওনাদের এতো তাড়া। তারপর পিছনে আরেকটা বোন আছে, তার ওপর সে যখন খুব সুন্দরী, তখন আরও সমস্যায় পড়তে হয় বাবা-মাকে।

এর আগে একটা সম্বন্ধ এসে তো সুচরিতার বদলে বোন পৃথাকেই পছন্দ করে ফেলেছিলো, দোলাদেবী রাজি থাকলেও অনীশবাবু কিছুতেই রাজি হননি। এবার সেই ভয়ে আর ছোটো মেয়েকে সামনে আসতে দেননি ওনারা।

যদিও এতে কোনো দুঃখ নেই সুচরিতার, আসলে ও ওর রূপের জন্য ছোট থেকেই মাসি, কাকী, জেঠি এমনকি মায়ের মুখেও শুনে আসছে, "এই মেয়ের বিয়ে দেওয়া চাপ হবে।" কিছু কথা ছোট থেকে মনে গেঁথে গেলে বড় হয়ে ওটা মেনে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়না। সুতরাং রূপ, বিয়ে এসব নিয়ে ভীষণ উদাসীন সুচরিতা, ওর দুঃখের জায়গাটা অন্য, চাকরির এতো পরীক্ষাতো দিচ্ছে কিন্তু একটাও হচ্ছে কৈ!

সুচরিতা যখন উচ্চ মাধ্যমিকে রেজাল্ট নিয়ে মনোজ স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো তখন স্যারই ওর মাথায় ঢুকিয়েছিল, "একটু পড়াশোনা করে আই.পি.এস বা সি.পি.ও টা লাগিয়ে দে, তারপর তোর যা সুন্দর হাইট, পুলিশের চাকরি তোর কে আটকায়!"

বিয়ে হবে না! বাজে দেখতে!ছেলেদের মতো লম্বা এসবের মাঝে মনোজ স্যারের কথাখানা ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল সুচরিতাকে। সেই থেকে আই.পি.এস, এস.এস.সি, সি.পি.ও এমনকি বি.এস.এফ কিছু বাদ দেয়নি, কিন্তু কোথায় কি!

সেই তো বাবার টাকা ধ্বংস করে বিয়ে করতে চললো, এসব ভাবতে ভাবতেই সুচরিতার হঠাৎ খেয়াল হলো হাতটা জ্বালা করছে।

অন্যমনস্ক হয়ে একই জায়গায় বারবার ঘষে চলেছে ও। বেসন, দুধ, হলুদ মিশিয়ে মাখিয়ে দিয়েছিল মেজো মামি, ওটাই শুকিয়ে গিয়ে কিছুতেই যেন উঠতে চাইছে না। পুরো ব্যাপারটাই বড্ড অপছন্দের তাও মুখের ওপর কাউকে কিছু বলতে পারেনা ও। পারলে সবার প্রথম চিৎকার করে বাবাকে অনেক কথা শোনাতো। বাবাই তো বলতো মেয়েরা বাজারের পণ্য না, তাহলে কেন বাবা নিজের হাতে ওকে বিক্রি করে দিচ্ছে, কিছুতেই বুঝতে পারছে না সুচি!

"দিদিভাই তাড়াতাড়ি দরজা খোল, মিলিদি এসেছে, আজ ওর তাড়া আছে" -পৃথার ডাকে খেয়াল হলো ও এখন ব্রাইডাল প্যাকেজে আছে, পনেরো দিন অন্তর ওর ফেসিয়াল চলে।আজ তো মিলির আসারই কথা! এসব করে যদি কালোরা ফর্সা হতে পারতো তাহলে আর চারপাশ এতো অন্ধকার থাকতো না।

"বসতে বল, আসছি!" বাথরুম থেকে সুচরিতা বললো, তারপর ভরা বালতি থেকে মগের পর মগ জল নিয়ে এমনভাবে ঢাললো যাতে ব্যাসনের চিটপিটানির সাথে মনে জমে থাকা রাগ, অভিমান, দুঃখ সব ধুয়েমুছে যায়।

"কি গো, মিষ্টি গুলো আনতে বললাম, এখনও বসে আছো?" -দোলাদেবীর কথায় পেপার থেকে মুখ তুলে অনীশবাবু বললেন, "শুরু হোলো তোমার! ওরা আসবে তো সন্ধ্যেবেলা, পাশেই দোকান, এখন থেকে এনে কি করবো শুনি?"

অনীশবাবুর গলায় ঝাঁঝ ছিল কিন্তু সেটা দোলাদেবী আমল না দিয়েই বললেন, "তাহলে আর কি? পেপার পড়ো, সারাজীবন কোনো দায়িত্বতো নিতে হলো না! বৌয়ের ঘাড়েই দিয়ে দিলে সব!" বলেই দোলাদেবী আর দাঁড়ালেন না, হয়তো এবার উল্টো জবাবটা শোনার মতো ধৈর্য্য ওনার আর নেই।

অনীশবাবুরও আজ উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না।পেপারটা খালি সামনেই খোলা মনে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছেন নিজেকে, যিনি পণ নেওয়ার ঘোর বিরোধী আজ সেই মানুষই পণ দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন, একেবারেই অক্ষম উনি নন, পাত্রপক্ষ যা চেয়েছেন তার দ্বিগুন দেওয়ার ক্ষমতা ওনার আছে, কিন্তু এভাবে মেয়েকে অপমান করতে উনি চাননি। খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন কি?

কি এমন হতো যদি ছোটটার আগে বিয়ে হয়ে যেত! ভেবেই একটা চোরা কষ্ট হচ্ছে বুকে, মেয়েটাও আজকাল কেমন এড়িয়ে এড়িয়ে যায়! চেষ্টাও তো করছে, কত পরীক্ষা দিচ্ছে, এইভাবে মেয়েটাকে বিক্রি না করে সময় দিলে হোতো না! -সারাদিন এই এক চিন্তা ঘুরছে অনীশবাবুর মাথায়।

হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা খুলতেই দেখলেন অনীশবাবুর ভাই, তার বউ আর ছেলেরা সব এসেছেন। উচ্ছ্বাসের আওয়াজটা আরও দ্বিগুন হয়ে গেল। ওপর থেকে নেমে এলো পৃথা আর সাথে ওর মামার মেয়েরাও।

সামান্য কিছু অনুষ্ঠান হলেই জেঠু, কাকা, মামারা সব একসাথে হয়, এটাই নিয়ম এই বাড়ির। পাত্রের ভাইবোন আসছে শুনে পৃথাও আবদার করলো ওদের ভাইবোনরাও আজ আসুক! সুচরিতার এই পুরো বিয়ে নিয়ে কোনো মতামত নেই।

গল্পে আর হাসাহাসিতে মশগুল ডাইনিং, সেই মাঝেই অরিশ মানে অনীশবাবুর ভাই বললো, "দাদা সুচির কন্যাদান কিন্তু আমি করবো, তোমার তো পৃথা রইলো, আমার দুইই ছেলে, তাই সুচির কন্যাদানের দায়িত্ব আমার!" অনীশবাবু মনে মনে ভাবলেন, "কর, আমার ইচ্ছেও নেই, কন্যা কি দানের সামগ্রী! হায় ভগবান কেন যে কিচ্ছু মানতে পারছি না, তুমি আমায় সহ্য ক্ষমতা দাও!"

আবার কলিং বেলের আওয়াজ। এখন আবার কে এলো ভেবে অনীশবাবু দরজা খুলতেই ওপাশ থেকে, "এটা সুচরিতা লাহিড়ীর বাড়ি?"

অবাক হয়ে দেখলেন অনীশবাবু- একজন পিওন গোছের লোক দাঁড়িয়ে, ওনাকে দেখেই হাত পা কাঁপতে শুরু করলো অনীশবাবুর। হাত পা যে সবসময় যে ভয়ে কাঁপে তা নয়, কখনো আনন্দে কাঁপে, উত্তেজনায় কাঁপে। কাঁপা কাঁপা গলায় অনীশবাবু চিৎকার করে ডাকলেন, "সুচি, তাড়াতাড়ি আয়, তাড়াতাড়ি!"

ওপরে বসে তখন সবে মুখের ক্রিমটা পরিষ্কার করছিলো মিলি, এরপর প্যাক লাগাবে, বাবার সাথে বেশ কিছুদিন ধরে কথা বলছে না সুচরিতা, পণ নিয়ে বিয়ে- এতে যে বাবা রাজি হয়ে যাবে কিছুতেই মানতে পারছে না ও। কিন্তু বাবার গলায় এরকম ডাক শুনে বড্ড ভয় পেয়ে গেলো সুচরিতা, কোনোরকমে চুড়িদারটা গলিয়ে ছুটে নেমে এলো নীচে, দেখলো বাবা দাঁড়িয়ে আছে বাইরের দরজার সামনে। ওখানে গিয়ে সুচরিতা মুখ বাড়াতেই দেখলো একজন পিওন দাঁড়িয়ে, হাতে একটা সরকারি স্ট্যাম্প দেওয়া খাম।সই করে চিঠিটা নিয়েই খামটা ছিড়ে পড়তে শুরু করলো সুচি, পড়ার সময় চোখে মুখে উত্তেজনাটুকু স্পষ্ট দেখতে পেলো সবাই।

তারপর চিৎকার করে বললো "এসেছে, এসে গেছে, যার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সেটা এসে গেছে বাবা।"

মেয়ের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে টেনে পড়তে শুরু করলেন অনীশবাবুও। আনন্দ ধরে রাখতে না পেরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে আসলো একে একে, অরিশ বললো "কি হয়েছে দাদা?"

অনীশবাবু বললেন "বি. এস. এফ এ চাকরি পেয়েছে আমাদের সুচি!"

অরিশ বললো "বি. এস. এফ মানে তো বর্ডার, কি বলছো তুমি?"

সুচি বলছে, "তাতে কি হয়েছে কাকাই, ছেলেরা যদি ওখানে কাজ করতে পারে মেয়েরা পারে না কেন?" দোলাদেবী বললেন "কিসব যা তা বলছিস, মরে টরে পরে থাকবি জানতেও পারবো না, ওসব চলবে না এবাড়িতে।"

এবার সূচি আর চুপ করে থাকতে না পেরে বললো- "কি চলে মা এ বাড়িতে? কালো মেয়েকে মোটা টাকায় বিক্রি করা? কে বলতে পারে, দুদিন পরে ওই বাড়িতেও আমি মরে টরে পরে থাকবো না? যারা পণ নেয় তারা যে কত ভালো মানুষ সে বেশ জানা আছে আমার!"

অরিশ বললেন "কবে যেতে হবে?"

অনীশবাবু চিঠিটা দেখে বললেন- "বিশে মার্চ মেডিক্যাল টেস্ট, পনেরোতে বেরিয়ে যেতে হবে"।

এবার দোলাদেবীর আঁতকে ওঠার পালা, বললেন -"মানে? সেদিনই তো ওর রেজিস্ট্রি?"

অনীশবাবু বললেন, "সেসব ক্যানসেল করে দেব, এ বিয়ে আমারও পছন্দ ছিল না, আর এখন তো প্রশ্নই আসেনা!"

তারপর সবাইকে বললেন, "থেমে গেলে কেন সবাই, মজা করো, আনন্দ করো, কতবড় কাজে যাচ্ছে আমাদের সুচি"।

পৃথা বললো, "দিদিভাই মিলি দি বসে আছে ওপরে"

সুচি বললো- "কি হবে আর ওসবে"

অনীশবাবু বললেন, "যা, মা যা, সেজে নে, যুদ্ধে যাওয়ার আগেও সাজতে হয় বৈকি!"

তারপর নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, "সুচির কন্যাদান আমিই করবো বুঝলি?"

অবাক হয়ে তাকালো অরিশ, অনীশবাবু আবার বললেন, "খাকি আর সবজে রংয়ের পোশাকটা পরে মাথায় ওই রংয়েরই টুপি, কোমরে সবজে চামড়ার মোটা বেল্ট, উফ! দেশমাতার উদ্দেশ্যে আমার কন্যাদান! কি যে গর্ব হচ্ছে আমার!"

বলতে বলতে সুচরিতার সামনে গিয়ে অনীশবাবু নিজের ডানহাতটা কপালে ঠেকিয়ে বললেন,

"জয় হিন্দ", সুচরিতা আনন্দে কেঁদে ফেলে বললো, "বাবা, ফিজিক্যাল এক্সামে যদি আটকে যাই!"

অনীশবাবু বললেন, "আর কোথাও আটকাবি না, ওই দেখ বাইরে!"

তাকিয়ে দেখলো সুচি আকাশে আজ আবারও রামধনু উঠেছে, এই সাতটা রং যতবার আকাশে ফুটে উঠেছে ততবার ভালো খবর এসেছে সুচির জীবনে।

দোলাদেবী ঠাকুরের পা থেকে লাল সিঁদুর এনে কপালে পরিয়ে দিলেন মেয়ের, তারপর বললেন, "যা, জিতে আয়, করে আয় নিজের স্বপ্নপূরণ"।

সুচরিতা জড়িয়ে ধরলো মাকে, মায়ের কাঁধে মাথা দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করলো, হয়তো বন্ধ চোখেই কল্পনারা সত্যির রূপ পায় আর স্বপ্নরা হয় বাস্তব।

সুচরিতা মনে মনে বললো, "এটাই জীবনযুদ্ধ, এ লড়াইয়ে তাকে জিততেই হবে"।