কবির কাছে শব্দ হল চূর্ণ, কবি তাকে অচূর্ণ করেন উপমায়, প্রতীকে, রূপকে, চিত্রকল্পে, উপস্থাপনায়, কাঠামোয়, বাক্যবিন্যাসে তথা অভিনবত্বে। কবিতার স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখে দিতে, পারস্পরিক হয়ে ওঠার নিজস্ব সাংকেতিকতা গড়ে তুলতে নতুন নতুন কাব্য ভাষা ব্যবহার করেন। সুতরাং কাব্যভাষার প্রধান শর্ত হল কবি প্ররোচিত সংকেত বহন। 'কবির সমসাময়িক জীবনের শর্তে শব্দের অভিষেক। 'শব্দ ভূতবিলাসী। কবি তাকে ভবিষ্যৎবিলাসী করে তোলেন।' ভাবনার ভিতর সর্বদাই একটা এলাকা দেখা দেয় যা ভাষার নাগালের অপেক্ষায় থাকে। কবি অবিরাম এই এলাকাটির অন্বেষণে ব্যস্ত থাকেন। জিজ্ঞাসাহীন পথ চলা এক ধরনের বিশ্রাম, কবিরা বিশ্রামের কাঙাল অথচ, তাঁর চিন্তন বা মনন কখনই বিশ্রাম পায় না। ক্রিয়াশীল মস্তিষ্ক জীবনকে দেখে নিতে চায়, চিনে নিতে চায় জেনে চায় অসীম কৌতূহল তার। Look আর Observe-এর মধ্যে বিস্তর প্রভেদ রয়েছে। সাধারণ মানুষ পথ চলতে চলতে যে কোন জিনিস দেখতে পারেন। কিন্তু, তাদের দেখার মধ্যে কোন জিজ্ঞাসা থাকে না। আর কবিরা পথ চলতে চলতে সেই জিনিসটাকেই বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁদের মধ্যে হাজার 'জিজ্ঞাসা' সৃষ্টি হয় তাঁদের চিন্তনে তখন প্রবল পীড়নের সৃষ্টি হয়। কবিরা তখন শব্দের দ্বারস্থ হন। জায়মান কবিতার দিকে তাকিয়ে কবি প্রসব যন্ত্রণা যুক্ত হন। শব্দ সাজানোর প্রক্রিয়ায় এক একজন কবি এক একরকমের নিজস্ব সাংকেতিকতা বিস্তার করেন। নিজের চিন্তাধারাকে প্রমাণ করার তাগিদ হেতু কবিরা হাতে কলম তুলে নেন। একজন শিল্পী রং তুলি হাতে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। তাড়না একটাই নিজের চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠা করবার সংকল্প।
কবির কাছে কবির জীবনদর্শন পরিষ্কার। আমরা পাঠকেরা যদি কবির সেই জীবনদর্শনের ও জীবনাদর্শের অংশিদার হতে চাই, তবে কবিকে ভালোভাবে জানতে হবে। কবির সৃষ্টির জন্য তাঁর জীবনাদর্শ লুকিয়ে আছে। আমাদেরকে সেই লুকনো সম্পদ কবিকে তন্নিষ্ঠ পাঠ করে আহরণ করতে হবে। কবি এক অর্থে শব্দ নির্মাতা। নিজস্বময় পরিধির ভিতর বিভিন্ন প্রসঙ্গ কবিকে লিখতে প্ররোচিত করে, এই নির্মাণ কবির সামাজিক অস্তিত্ব, কবির ভালোবাসা, বেদনা-প্রেম ও কষ্টের ফসল হল কবিতা, যা বর্ণ ও ধ্বনির বিন্যাসে এক কথায় ভাষার প্রতীকে অবয়ব অর্জন করে। প্রতীক ও উপমায় ক্রমশ উদ্ভাসিত হতে থাকে বিষয়বস্তু। অনেক সময় বিমূর্ত করে তোলে কোন কোন ইশারা, যা কবিকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল, সমৃদ্ধতর ও মহিমান্বিত করে। 'কবিতায় ধ্বনি বা ছন্দোবন্ধন কয়েকটি আপাত সামান্য শব্দের সমাবেশ থেকে এক অনন্য পরম ভাবমণ্ডলে উৎসারিত করে। ইদানীংকালের কবিতার প্রায়শই ছন্দের স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্য করা যায় না। বোধহয় অনেকে খেয়ালও করেন না যে, গদ্য কবিতাতেও 'সঞ্চার করতে হয় অন্তর্গত ছন্দের রণন' যা পাঠকের মনে যেটিকে বারবার পড়ার স্পৃহা জাগায়।' যা মগজের মধ্যে গুন্ গুন্ করে ফেরে। কবিতার শরীরে চায় সুরের মোহ, চায় রহস্যময়তা, এখনকার কবিতায় যা রয়ে যাচ্ছে তা হল অনেকটা 'পণ্ডিতিছায়া' বা 'জাহিরিতন্ত্র'।
রবীন্দ্র দর্শন বা রবীন্দ্র ঐতিহ্যের মূল সুরটি হল পূর্ব বিধানের বিরুদ্ধে নব বিধানের সংঘাত। অনুক্ষণ বিবাদমান স্থিতি। রবীন্দ্রনাথ একেই 'দ্বৈরাজ্য' বলে অভিহিত করেন। যাপনের সমস্ত এলাকার মত কবিতাও লালন করে স্পষ্ট দুটি যুক্তিপথ- 'একটি কসমোসেন্ট্রিক, অন্যটি লোগো সেন্ট্রিক'। কসমোসেন্ট্রিক কবির উপাদানগুলি হল দেশজ শব্দের প্রতি আগ্রহ, যে কোন আসক্তি, জ্ঞান-গম্যির তোয়াক্কা না করা, শব্দ ও অর্থালংকারের সাবেকি পদ্ধতি আঁকড়ে থাকার প্রবণতা, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ছন্দের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে চিরকালীন বিস্ময়ে ঘুরপাক খাওয়া ইত্যাদি। পৃথিবী জুড়ে এত যে ড্রাগস্ কায়ার ধুম, তাও ঐ কসমোসেন্ট্রিক আয়োজনের অংশভাগ। যত বস্তুবাদী জীবনযাপন মানুষকে ছোবল দেবে, মানুষ ততই ঝুঁকবে কসমোসেন্ট্রিক প্রবণতার দিকে।" শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই প্রবণতার উজ্জ্বল উদাহরণ। নিজেকে গোপন করতে শক্তি মদ্যপানের আড়াল পছন্দ করতেন। প্রতিদিনের কাজ বলতে ছিল দুটি কবিতা ও মদ্যপান।"
কসমোসন্ট্রিক কবির পুঁজি হল সহজাত প্রবণতা ও যাপনের অভিজ্ঞতা। কসমোসেন্ট্রিক পথের যুক্তি হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যতটা রহস্যময় সে নিজেও ততটাই রহস্যময়। সে যতটা ক্ষুদ্র, সমগ্র তেমনই সংক্ষিপ্ত। অর্থাৎ সেনিজের মানদণ্ডে ধরতে চেয়েছে নিখিলের দর্শন।
অন্য যুক্তি পথ হল জ্ঞান বা লোগোসের সাহায্যে এগিয়ে চলা। কসমোসেন্ট্রিক যুক্তির পথের কবিরা, কবিতায় জ্ঞানের স্পর্শ দেখলেই বলেন, 'এটি কবিতা হয়নি'। কবিতার নির্মাণ বা গড়ে তোলার চেয়ে কবিতা হয়ে ওঠায় বিশ্বাস করেন। কবিতার ভিতরে কোন দর্শন যেন গড়ে না ওঠে। জ্ঞান গম্যিকে সর্বদা এরা তাচ্ছিল্য করে এসেছে। কসমোসেন্ট্রিক যুক্তির পুরোপুরি বিপরীত অবস্থান লোগোসেন্ট্রিক বা জ্ঞানভজনের পথ। এদের মতে কোন বিষয়ই খাপছাড়া নয়, যুক্তির ঐক্যসূত্রে গড়ে ওঠা। নিজের সংশয় থেকে মুক্তির দিকে এগোতে সাহায্য করে জ্ঞানের আলোক। 'কিছু মানুষ সবসময়ে থাকেন, যাঁরা জ্ঞানগম্যি পছন্দ করেন না। লোগোসেন্ট্রিক এলাকা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন- হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন কসমোসেন্ট্রিক এলাকার বিস্ময়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে।" সার্বিকভাবে রবীন্দ্রনাথকে লোগোসেন্ট্রিক পথের কবি বলা যায়। এরোপ্লেন আবিষ্কার হয়েছে কত বছর হয়ে গেল। কিন্তু, কতজন মানুষ এরোপ্লেন চড়েছেন? এখনও বহুলাংশে মানুষ পরম বিস্ময়ে ঘাড় তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে পাখির সমতুল্য এরোপ্লেন দেখেন। "একইভাবে জ্ঞান ও জ্ঞানের উপহারগুলি আজও মুষ্টিমেয়র আয়ত্বে এবং এরকমই থাকবে হয়তো বহুকাল ...।" তবু আসার আলো 'কিছু লোক ঝুঁকে দ্যাখে কবিতার স্থির জলে মুখ,...।
১৯৩৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর 'আমার সাহিত্য সাধনা'য় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন "মনে আছে একসময়ে নারায়ণ পত্রে বিপিনচন্দ্র পাল আমার রচিত গানের সমালোচনা করেছিলেন। সে সমালোচনা অনুকূল হয়নি। তিনি আমার যে সব গানকে তলব দিয়ে বিচারকক্ষে দাঁড় করিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বিস্তর ছেলেমানুষি ছিল। তাদের সাক্ষ্য সংশয় এনেছিল সমস্ত রচনার 'পরে। তারা সেই পরিণতি পায়নি যার জোরে গীতসাহিত্য সভায় তারা আপনাদের লজ্জা নিবারণ করতে পারে।" গান যখন গান হয়ে ওঠে, তখন সেটা সাল-তারিখ বা সময়ের পরিধিকে অতিক্রম করে ধ্রুবতারার মত জ্বলজ্বল করে লোকের মুখে মুখে গুন্ গুন্ করে ওঠে। ড. আবু সয়ীদ আয়ুব বলেছেন, "অনেক সময় প্রকৃতি পর্যায়ের গানকেও প্রেমের গান বললে সঠিক হতো।" রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্যায়ের গানগুলো শোনার পর একথা আমার ভিতরেও একইভাবে অনুভূত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যমানসীকে সাদর আহ্বান জানাচ্ছেন এই গানের ভিতর দিয়ে "এসো আমার ঘরে।/ বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে, / স্বপন দুয়ার খুলে এসো অরুণ আলোকে / মুগ্ধ এ চোখে।/ ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে এসো আমার ঘরে / দুঃখ-সুখের দোলে এসো, প্রাণের হিল্লোলে এসো, / ছিলে আশার অরূপবাণী ফাগুনবাতাসে / বহনের আকুল নিশ্বাসে / এবার ফুলের গ্রুল্প রূপে এসো বুকের 'পরে।"
প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুর প্রভাব রবীন্দ্রমননকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়ে যায়। 'ফাল্গুন মানেই গুন্ গুন্। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত প্রতিটি ঋতু নব নব আকাঙ্ক্ষায় রবীন্দ্র মনে প্রভাব ফেলে বের করে এনেছে নতুন নতুন গান ও কবিতা। বর্ষা ও বসন্ত ঋতুকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি গান লিখেছেন রবি ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ 'আমার সাহিত্য সাধনা'য় লিখেছেন, "অতি অল্প বয়স থেকেই স্বভাবতই আমার লেখার ধারা আমার জীবনের ধারার সঙ্গে সঙ্গেই অবিচ্ছিন্ন এগিয়ে চলেছে। চারিদিকের অবস্থা ও আবহাওয়ার পরিবর্তনে এবং অভিজ্ঞতার নূতন আমদানি ও বৈচিত্র্যে রচনার পরিণতি নানা বাঁক নিয়েছে ও রূপ নিয়েছে। মনের ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে যখন ফুল ফোটায়, ফল ফোটায় তখন সেইটের আবেগ ও বাস্তবতাই কবির কাছে হয় একান্ত প্রত্যক্ষ। তার মাঝে মাঝে সময আসে যখন ফলন যায় কমে, যখন হাওয়ার মধ্যে প্রাণশক্তি প্রেরণা হয় ক্ষীণ তখন ইতস্তত যে ফসলের চিহ্ন দেখা দেয় সে আগেকার কাটা শস্যের পোড়া বীজের অঙ্কুর। এই অফলা সময়গুলো ভোলবার যোগ্য।"
কাব্য মানসীর উদ্দেশ্যে লেখা গানগুলি হল- ১. (বারে বারে) "আমি কান পেতে রই আমার আপন হৃদয় গহন-দ্বারে .../... কে সে মোর কেই বা জানে, কিছু তার দেখি আভা / কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা।/ মাঝে মাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় কি কথা রে, / ও যে আমায় জানি পাঠায় বাণী গানের তানে লুকিয়ে তারে।" ২. 'যদি তারে নাই চিনি গো সেকি সে কি আমায় নেবে চিনে/ এই নব ফাল্গুনের দিনে জানি নে, জানি নে। / সে কি আমার কুঁড়ির কানে কবে কথা গানে গানে, / পরাণ তাহার নেবে কিনে এই নব ফাল্গুনের দিনে/ জানি নে, জানিনে। / সে কি আপন রঙে ফুল রাঙাবে। / সেকি মর্মে এসে ঘুম ভাঙাবে।...।” ৩. "আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী?/ বলো কোন্ পারে ভিড়িবে তোমার সোনার তরী।" (যদিও এটি 'সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থের 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' নামক কবিতা) ৪. 'যে ছিল আমার স্বপন চারিণী / তারে বুঝিতে পারি নি। / দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে...' ৫. 'পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে। / এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে, / ... আজি ভাবি মনে মনে মরীচিকা অন্বেষণে / বুঝি তৃষ্ণার শেষ নেই মনে ভয় লাগে সেই/ হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা চলেছে নিরুদ্দেশে।' ৬. ('কাব্য মানসীকে আহ্বান') "মধুর মধুর ধ্বনি বাজে / হৃদয় কোমল মন মাঝে।/ নিভৃত বাসিনী বীণাপানি অমৃত মুরতিমতী বাণী/ হিরণ কিরণ ছবি খানি পরাণের কোথা সে বিরাজে।/ মধু ঋতু জাগে দিবানিশি দিক কুহরিত দিশি দিশি / মানস মধুপ পদতলে মুরছি পড়িছে পরিমলে।/ এসো দেবী, এসো এ আলোকে, একবার হেরি তোরে চোখে / গোপনে থেকো না মনোলোকে ছায়াময় মায়ময় সাজে।"