।। ২ ।।
মা'কে ছাড়াই একবছর কেটে গেল! যুধাজিত আর সে যমজ, দুজনে,দুজনের আরও কাছাকাছি এসে গেল এই কঠিন সময়টায়! একেবারে ছোট ভাই, যার বয়স মাত্র তিন, সে খুব কান্নাকাটি করত, মাকে খুঁজে বেড়াত! কৈকেয়ী আর যুধাজিত, এই ছোট ভাইগুলোকেও সামলে রাখতে লাগল! বাবা, কোনওদিন খেয়াল করেনি, কৈকেয়ী কি খাচ্ছে, কি পড়ছে! মা চলে যাওয়ার পরে, মারই সমবয়সী ধাইমা মন্থরা তোমাকে সমস্ত ঝড়ঝাপটা থেকে আগলে রেখেছে। ভাইদের সঙ্গে পাঠশালায় যেতে তোমার ভাল লাগত। খুব মন দিয়ে বিদ্যাভ্যাস করতে তুমি। পন্ডিতমশাইরা তোমার মনোযোগের কারণে তোমাকে যুধাজিতের থেকে বেশী ভালবাসতেন। মন্থরার সজাগ দৃষ্টি ছিল এইসব দিকে। তোমার স্বাস্থ্য কি করে ভাল থাকবে, কি করলে তোমার শরীরের যত্ন হবে, সেই চিন্তায় মন্থরা সারাদিন ব্যস্ত থাকত!
বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হলে, তুমি যুধাজিত আর অন্য ভাইদের সঙ্গে গিয়ে রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যানে ছুটোছুটি, লুকোচুরি খেলতে। কিন্ত এমন সুখের দিন আর থাকল না, রাজার আদেশে যুধাজিতের জন্য অস্ত্রশিক্ষা আর ঘোড়সওয়ারীর ব্যবস্থা হল। তখন তুমি শুকনো মুখে প্রাসাদের অলিন্দ দিয়ে সেসব দেখতে আর তোমারও খুব ইচ্ছে হতো শেখার! তোমার সূচীশিল্প আর অঙ্কনশিল্প শেখার ব্যবস্থাও করে দিল মন্থরা। কিন্ত তোমার মন পড়ে থাকত বাইরে, যুধাজিতের তরবারী শিক্ষার দিকে। নিজের ঘরে কাঠের নকল তলোয়ার বানিয়ে, মন্থরার সঙ্গেই সেই সব শিক্ষা আয়ত্ত করার চেষ্টাও করতে।
একদিন যুধাজিতের কাছে অভিমান করে বললে, "তোমার থেকে আমি অনেক ভাল তরোয়াল চালাতে পারি, শুধু মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে আমি সুযোগ পেলাম না! মা, থাকলে ঠিক শেখার ব্যবস্থাও করে দিত!" যুধাজিত বলল, "কেন রাগ করছ,আমি যা শিখছি, সব তোমাকে শেখাব!"
কৈকেয়ীর বিশ্বাস হয়নি সেকথা, কিন্ত পরদিন সকাল বেলা যুধাজিত তাকে নিয়ে চলল প্রাসাদের বাইরে এক বিশাল প্রান্তরে, যার ধার দিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী সরস্বতী নদী, আর তার ও ওপারে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি আর ঘন জঙ্গল! সে বলল, "এখানে কেউ আমাদের ওপর নজরদারি করতে পারবেনা।" শুরু হল তোমার অস্ত্র শিক্ষা, শিখতে লাগলে ঘোড়সওয়ারীও! তোমাদের ভাইবোনের এই নিভৃত জগতে, যুধাজিত ছিল তোমার গুরু আর তুমি তার শিষ্যা।
রোজ দ্বিপ্রহরে যখন, প্রাসাদের সব কিছুই হয়ে পড়ত একটু ঢিলা ঢালা, প্রহরীরা ও বিশ্রাম নিতে চাইত, সেই সময়টা কাজে লাগিয়ে চলতে লাগল তোমাদের দৈনন্দিন অভ্যাস! মাস ছয়েকের মধ্যেই যুধাজিত বিস্মিত হয়ে দেখল, কী অসাধারণ নিপুনতায় চলে তোমার তরোয়াল, যে কোনও ভাল যোদ্ধার মতনই! আর তোমার ঘোড়সওয়ারীর অবিশ্বাস্য দক্ষতা দেখে যুধাজিতের যেন নিজেকেও একটু খাটো মনে হতো! তবে সে তোমাকে এতটাই ভালবাসত যে, নিজের হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠে তোমাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিত।" বাহ, কৈকেয়ী, দারুণ করছ তুমি, প্রাসাদের যে কোনও যোদ্ধাকে তুমি অবলীলায় হারিয়ে দিতে পারবে!" যখন তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ত, তখন দুজনে, বিশাল প্রান্তরে, খোলা আকাশের নীচে, ঘাসের ওপর শুয়ে এসব কথা বলত। কৈকেয়ী বলত, " যুধাজিত, তুমি যদি আমাকে না শেখাতে, তাহলে তো আমি এসব কিছুই পারতাম না, সারা জীবন আমি একথা মনে রাখব।,আমার এই শেখা হয়ত কোন কাজে আসবেনা, কিন্ত তুমি রাজা হবে একদিন, বোনের কোনও সাহায্য যদি লাগে, আমাকে অবশ্যই বলবে!"
হঠাৎই একদিন রাজা অশ্বপতি, তোমাদের ডেকে পাঠাল তার নিভৃত বিশ্রাম কক্ষে। তুমি তো খুবই আশ্চর্য হলে, যুধাজিত তাও মাঝে মধ্যে সভাস্থলে গিয়ে বসে, বাবার নির্দেশ অনুযায়ী কিন্ত বাবা আর কৈকেয়ীর মধ্যে সম্পর্কটা বড়ই ক্ষীন! বাবা কোনও দিন খোঁজ রাখেনি, সম্পূর্ণভাবে মন্থরার তত্বাবধানেই তোমার বড় হয়ে ওঠা। আজ যখন বাবার কাছে এসে দাঁড়ালে তখন যেন অচেনা লাগল দুজনেরই দুজনকে!
রাজা অশ্বপতিকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল! সরাসরি যুধাজিতকেই বলল বাবা, "আমাদের শত্রুরা শক্তিশালী হয়ে উঠছে ক্রমশ। সীমান্ত প্রহরা অনেক বাড়াতে হবে। কিছু রাজ্যের রাজাদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে হবে। তুমি বড় হচ্ছ, তোমাকে এসব জানতে হবে, এখন থেকে রোজই তুমি সভায় এসে বসবে, মন্ত্রী পরিষদের সভ্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।" এতক্ষন পর্যন্ত বাবা তোমাকে লক্ষই করেনি। এখন হঠাৎই তোমার দিকে ফিরে বলল, "তোমার ষোলো বছর বয়স হয়েছে, এবার তোমার বিয়ে দেব আমি, আমার কাছে পাশের রাজ্যের রাজা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, তিনি তোমার পানিপ্রার্থী, তোমার কথা দূতের মুখে শুনেছেন!"
যুধাজিত আর তোমার দুজনেরই হতবাক অবস্থা! তুমি তীব্র প্রতিবাদ করতেই যাচ্ছিলে, তার আগেই যুধাজিত বলে উঠল, "না বাবা, আমার একটা পরিকল্পনা আছে, শুনলে, আপনারও পছন্দ হবে, আমি নিশ্চিত"! বাবা নিমরাজী ভঙ্গিতে বলল, "বল শুনি।"
"সবচেয়ে ভাল হবে, যদি আপনি কৈকেয়ীর স্বয়ম্বরের ব্যবস্থা করেন! তাতে করে সবাইকে আপনার ঐশ্বর্য আর ক্ষমতাও প্রদর্শন করতে পারবেন! আর কৈকেয়ীও নিজের পছন্দের স্বামীকে নির্বাচন করতে পারবে!"
তুমি যুধাজিতের চোখে চোখে তাকিয়ে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে!
বাবার মুখ দেখে মনে হল, বেশ পছন্দই হয়েছে প্রস্তাবটা, যুধাজিতের তারিফ করে বলল, "ঠিক আছে, ভালই বলেছ, আমি আমার পরামর্শদাতাদের সঙ্গে আগে আলোচনা করে নিই তারপর, জানাবো তোমাদের"! বাবার কিঞ্চিত প্রসন্নতার সুযোগে তুমি তখন সাহস করে বলে উঠলে, "আমি তো এখনও বিবাহের জন্য প্রস্তুতই নই, আমার আরও একবছর সময় চাই।" বাবা বিস্মিত হল, ভাবেনি, তোমার মতো আপাতনিরীহ একজন মেয়ের মুখে একথা শুনতে হবে!
গ্রন্থের নামঃ কৈকেয়ী (Kaikeyi: A Novel)
লেখিকাঃ বৈষ্ণবী প্যাটেল (Vaishnavi Patel)
ভাষাঃ ইংরাজী
প্রকাশকঃ রেডহুক (Redhook)
বাঁধাইঃ পেপারব্যাক
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫১২ পাতা
মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয় মুদ্রায়): ১,৭৩৪ টাকা
(ক্রমশ)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।