বিবিধ

কৃষ্ণনগরে কাজী (দশম পর্ব) [ধারাবাহিক]



ইনাস উদ্দীন


[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]

পর্ব - ১০

কৃষ্ণনগরে এসে ক’দিনের মধ্যেই বেশ চাঙ্গা বোধ করছিলেন নজরুল। সাহেব ডাক্তারের সত্যিই হাতযশ আছে। মধ্যে আরও একবার ওষুধ নিয়ে আসা হয়েছে। গিরিবালা দেবীও শিবেনের সঙ্গে গিয়েছিলেন। ফরমুলা মাফিক কাশীনাথই মিক্সচার বানিয়ে দেন। কিন্তু গিরিবালা দেবী ডাক্তারের সাথে আলাদা করে কথা বলে এসেছেন। কথা বলে তিনিও খুশি। কিন্তু দু'দিন থেকে নজরুলের আবার জ্বর এসেছে। হয়ত ঠান্ডা লাগার কারণেই। কিন্তু নজরুলের ক্ষেত্রে জ্বর শুরু হলে আর সহজে যেতে চায় না। এইবেলা ছাড়ে তো ওইবেলা আবার জাঁকিয়ে ধরে।

ক'দিন বাদেই গফরগাঁওতে প্রজা সম্মেলন। মনের মধ্যে একটা অব্যক্ত উত্তেজনা অনুভব করছিলেন নজরুল। সেই ময়মনসিংহ, সেই ত্রিশাল - কাজির শিমলা - দরিরামপুর গ্রাম - যেখানকার মাঠ, পুকুর, কর্দমাক্ত গ্রামের পথ, বৃষ্টিঝরা রাত - বাঁশের বাঁশি হাতে এক ভাবুক কিশোরের ছবি আজো দুখু মিয়াঁর গোপন কুঠুরিতে ভেসে বেড়ায়। সেই স্মৃতিঘেরা ময়মনসিংহে নজরুল যাবেন না? গান গাইবেন না? তাই কি হয়?

কিন্তু তাই হলো।

ময়মনসিংহে সম্মেলনে তাঁর আর যাওয়া হলো না। মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল। যখন থেকে গফরগাঁওয়ে ময়মনসিংহ জেলা সম্মেলনে যাবার কথা শুরু হয়েছে তখন থেকে নজরুলের মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে আছে। এই ক'বছরে কত সভা- সম্মেলনে তিনি গিয়েছেন, অনেক জায়গায় যাওয়া হয়েও ওঠেনি - কিন্তু এরকম অনুভূতি আগে হয়নি। মাত্র এক বছর আগে বগুড়ায় রাজনীতির বন্ধুরা মিলে গড়ে তুলেছেন নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মেলন। রাষ্ট্রীয় সমাজে যাদের কথা কেউ ভাবেনা, সেই দরিদ্র কৃষক-শ্রমিক আর ক্ষেতমজুরদের মতো সর্বহারাদের নিয়ে সংগঠন গড়ে তোলার স্বপ্ন তাঁদের অনেকদিনের। এরা তো ট্যাক্স দেয়না, সুতরাং এদের ভোট নাই। আর যাদের ভোট নাই তাদের কথা ভাববার দরকারই পড়েনা দেশনেতাদের। এই এক বছরে দিকে দিকে যেরকম সাড়া পড়েছে, তাতে হেমন্ত সরকার আর তার সঙ্গী-সাথীরা রাশিয়ার বলশেভিক জাগরণের মতো স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছেন। মাস খানেক পরেই কৃষ্ণনগরে বার্ষিক রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গিয়েছে। জেলে থেকেই উদ্দীপিত মুজফফর আহমদ - ছাড়া পেয়েই কৃষ্ণনগরে চলে আসবেন বলে জানিয়েছেন। শিগগিরই তার ছাড়া পাবার কথা। এরকম সময়ে ময়মনসিংহ জেলা সম্মেলন নজরুলকে এক অদ্ভুত ভাবে আকর্ষণ করছিল।

শুধুই কি সম্মেলন? ময়মনসিংহ নামটির সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর প্রথম যৌবনের স্মৃতি, আবেগের অস্থিরতা, হঠকারিতা, অভিমান, প্রেম, বিরহ - নিজের কাছেই ব্যাখ্যা না পাওয়া কত অদ্ভুত যন্ত্রনা। নামাপাড়া, বিচুতিয়া ব্যাপারীর বাড়ি, খিদির পন্ডিত, কৈলাস স্যার, শুকনির বিলের ধারে একটা বটগাছ, সেই নির্জন বটগাছের নিচে বাঁশি হাতে এক কিশোর - আর চোখের সামনে সর্বক্ষণ ভেসে বেড়ানো ভীরু হরিণীর মতো দুটি চোখ। অতল সমুদ্রের তলদেশ থেকে ভেসে ওঠা সে চোখের ভাষায় মাত্র দুটি কথা - কাজী, ফের আইবাম তো?

দরিরামপুর থেকে গফরগাঁও কতদূর? কেউ কি আসবে না সম্মেলনে? দরিরামপুর হাই স্কুলের ছাত্র নজরুল ইসলাম এখন বঙ্গবিখ্যাত বিদ্রোহী কবি, অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত তেজোদ্দীপ্ত তার ভাষণ - সে খবর কি পৌঁছায়নি ত্রিশালের নামাপাড়ায়? বীররামপুরে? খিদির পন্ডিত স্যার কি না এসে থাকতে পারবেন? আর নূরজাহান? নিশ্চয় এতদিনে সে গৃহিণী হয়ে গিয়েছে। নূরের জ্যোতিতে ভরিয়ে তুলেছে কারো ঘর। তার কানে কি পৌঁছয়নি এই খবর? গফরগাঁওয়ে নজরুল আসছে শুনে সে কি থাকতে পারবে ঘরে? একবার দেখতে ইচ্ছে করবে না? কিন্তু আসবে কার সাথে? পন্ডিত স্যার কি তাকে সঙ্গে নিতে রাজি হবেন?

যদি দেখাও হয় - কী কথা হবে তাঁর সাথে? কোনোদিনই তো বলতে গেলে তেমন কোনো কথা হয়নি। ইংরেজি বাক্য গঠন আর ফারসি শব্দের অর্থ বুঝিয়ে বলার বাইরে আর কিছু কথা বলবার বা শোনবার অবসর ঘটে নি। বাংলার বুকে ফুটে থাকা অপরূপ সৌন্দর্য্যের একটি গোলাপ - তার সাথে কি কথা বলা যায়? চোখ তুলে তাকানোটাও যেন অস্বস্তিকর।

শরীর জুড়ে কেমন একটা অস্থিরতা। ময়মনসিংহ সম্মেলনের জন্য একটা গান লিখতে হবে। অন্যদিন বারান্দার চেয়ারটায় বসলেই কলমে লেখা চলে আসে। কিন্তু আজ কোনও কিছুতেই যেন মন বসছে না। চোখমুখ ভারি, কেমন উদভ্রান্ত ভাব।

দোলন কিছু বলার জন্য বোধহয় বাইরে এসেছিলেন। নজরুলকে দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলেন। "তোমার তো মনে হচ্ছে আবার জ্বর আসছে!" কপালে হাত দিয়ে দেখলেন - "বেশ গরম তো! চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। এই ঠান্ডায় আর বাইরে বসতে হবে না, ভিতরে চলো।"

বাধ্য ছেলের মতো নজরুল বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। দোলন থার্মোমিটার বার করে জ্বর দেখলেন। ১০২ ডিগ্রি পার হয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন এরকম জ্বর আসেনি। কাপড়ের টুকরো ভিজিয়ে এনে জলপটি লাগালেন। এমন সময় বারান্দায় গলা শোনা গেল - কাজী কই? খবর-সবর কী?

"দোলন, হেমন্তদা এসেছেন!" নজরুল উঠে বসতে গেলেন।

- "তুমি শুয়ে থাকো, আমি দেখছি"। দোলন হেমন্ত সরকারকে ভিতরে ডেকে নিয়ে এলেন। বিছানার সামনে বসার জন্য একটা টুল এগিয়ে দিলেন।

- কদিন তো ভালোই ছিল। কাল থেকে দেখছি কেমন অস্থির। আজকে তো আবার জ্বর এসেছে। অনেকটা জ্বর। দোলনের কণ্ঠে স্পষ্ট একটা উদ্বেগের ছায়া।

হেমন্ত সরকার একটু চিন্তিত স্বরেই জিজ্ঞেস করলেন, "সাহেব ডাক্তারের ওষুধে কাজ হচ্ছে না কিছু? ওষুধ ঠিকঠাক খাচ্ছ তো?"

- কী করে হবে দাদা? সময়মতো তাকে পেলে তো ঠিকঠাক ওষুধ খাওয়াবে? সাতদিন পরে ডাক্তারবাবু তো দেখা করতে বলেছিলেন। তা উনি নিজে না গিয়ে শিবেনকে পাঠিয়ে দিলেন। মা গিয়েছিল, কথা বলে এসেছে। রেস্ট নিতে বলেছেন।

জলপট্টি নামিয়ে রেখে নজরুল বিছানায় উঠে বসেছেন। কিছু বলতে যাবার আগেই হেমন্ত সরকার বললেন, "এটা তো ঠিক করছ না কাজী! নগেন ডাক্তারের উপর আমার ভরসা আছে। ঠিকঠাক মেনে ওষুধপত্র খাও, চাঙ্গা হয়ে উঠতে হবে তো! সামনে অনেক কাজ।"

নজরুল কিছুটা জবাবদিহির সুরে বলার চেষ্টা করলেন, "ওষুধে তো ভালোই কাজ দিচ্ছিল দাদা। আজ আবার হঠাৎ জ্বরটা চলে এলো। ও ঠিক হয়ে যাবে।"

দোলন হেমন্ত সরকারের দিকে একটু অনুযোগের মতো করে বললেন, "দাদা, এর মধ্যে নাকি ময়মনসিংহ যাবার কথা আছে? সেখান থেকে আবার ঢাকা? এই শরীরে যাওয়া ঠিক হবে?"

"দোলন অযথা ভয় পাচ্ছে দাদা! এখনো তো কদিন আছে, ও আমি ঠিক হয়ে যাব। এতো গুরুত্বপূর্ণ জেলা সম্মেলন।" -দোলনের কথার মধ্যেই নজরুল বলে উঠলেন। হেমন্ত সরকার বললেন, "না কাজী। দোলন ঠিকই বলেছে। তোমাকে আর গফরগাঁও যেতে হবেনা। তুমি কদিন বিশ্রাম নাও। সামনে অনেক কাজ আছে। বরং রাজ্য সম্মেলনের কথা ভাবো। তার আগে তোমাকে শরীরটা ঠিক করে নিতে হবে। তুমি বরং ময়মনসিংহ সম্মেলনের জন্য একটা চিঠি লিখে দিও, যাবার সময় নিয়ে যাবো। আর হ্যাঁ, একদম অনিয়ম কোরো না। আমি কিন্তু ঠিক খবর পেয়ে যাবো!"

হেমন্ত সরকার বেরিয়ে গেলেন। নজরুল কোনো কথা না বলে তাকিয়ে রইলেন দরজার দিকে। চুপচাপ। তারপর শুয়ে পড়লেন। বন্ধ চোখের পাতার উপর ভেসে উঠতে থাকল রফিজউল্লাহ দারোগার বাড়ি, সিঁড়ির নিচে দুই বন্ধু মিলে গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়া। কোথায় আসানসোল, আর কোথায় ময়মনসিংহ। রেল-বাস স্টিমার মিলে অনেক পথ পেরিয়ে ত্রিশাল, দরিরামপুর হাই স্কুল। প্রবল বর্ষায় ভেসে যাওয়া মাঠঘাট, খালবিল - গ্রাম বাংলার এই চেহারা আগে কোনোদিন দেখা হয়নি। অদ্ভুত, অপরূপ! একহাঁটু কাদা রাস্তা পেরিয়ে এতোদূরে প্রতিদিন স্কুলে আসা - সে কি সম্ভব? নজরুলের মতো ছাত্রের জন্য ব্যবস্থা হবেনা? পন্ডিত স্যারের শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয়। কিন্তু সেখানে তো ফুল ফুটে আছে - বসরাই গোলাপ। তীব্র তার আকর্ষণ। এতো আকর্ষণ - সে তো বন্দীত্ব! এই মায়ার বাঁধন থেকে পালাতে হবে।পালাতেই হবে! বাঁধনহারা ঘুড়ির মতো জীবন শুধু এক আকাশ থেকে আরেক আকাশ - ভাসতে থাকা, ভাসতে থাকা।

কপালে হঠাৎ একটা শীতল স্পর্শ। চমকে চোখ মেললেন নজরুল।

দোলন জলপটিটা ভিজিয়ে এনে কপালে লাগিয়ে দিলো।

(ক্রমশ)

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।